জ্যোতিবাবুর শেষ যাত্রা ছিলো ‘জৌলুস’, বুদ্ধবাবু গেলেন ‘ট্রাজিক নায়ক’-এর মতোন

Spread the love

চিরন্তন ব্যানার্জি:-

‘কমরেড’ শব্দটা অনেক বছর পর ফের শহরের রাজপথে শোনা গেলো। আবারও দেখা গেলো শ্রাবণের দুপুরের ঠা ঠা রোদে সিপিএমের থিক থিকে ভিড়। কারণ যে একটাই ‘বুদ্ধবাবু’।
সিপিএমের রাজ্য দফতরে তখন শায়িত বুদ্ধবাবুর নশ্বর দেহটা। আর বাইরে মল্লিকবাজার থেকে শিয়ালদহের দিকে যাওয়ার রাস্তটা দখল নিয়েছে গরমে ঘেমেনেয়ে বহু বামপন্থী ও সাধারণ জনতা। আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের পার্টি অফিসে বারবার মাইকে কমরেডরা ঘোষণা করছেন কেউ দাঁড়াবেন না শ্রদ্ধা জানিয়ে এগিয়ে যান। কারণ তখন বাইরে রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীকে শেষবারের মতো শ্রদ্ধা জানাতে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতম লাইন। বারবার বলতে শোনা যাচ্ছে মানুষের লাইন সিপিএমের ছাত্রযুব সংগঠন ডিওয়াইএফআইয়ের সদর দফতর দীনেশ মজুমদার ভবন ছাড়িয়ে তার লেজ গিয়ে পড়েছে মৌলালির কাছে এসএন ব্যানার্জি রোডে। আর তার কয়েক ঘন্টা পর ‘অমর রহে’, ‘ভুলছি না, ভুলব না’, ‘লাল, লাল, লাল সেলাম’-এর গর্জনের ঢেউয়ে সওয়ার হয়ে চিরদিনের মতো আলিমুদ্দিন স্ট্রিট ছাড়ছেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য।
দেখতে দেখতে কেটে গেল ১৪টা বছর। চলে গেলেন বাম জামানার দুই মুখ্যমন্ত্রীই। আজ বুদ্ধবাবুর শেষ যাত্রায় থাকতে থাকতে বারবার মনে পড়ছিলো ২০১০ সালের ১৯ জানুয়ারির কথা। আজ হয়তো কর্ম সূত্রে বুদ্ধবাবুর অন্তিম যাত্রায় প্রথম দিন থেকে থাকার সুযোগ হয়েছে সব জায়গায়, কিন্তু জ্যোতি বসুর শেষযাত্রায় উপস্থিত হয়েছিলাম একজন সাধারণ কলেজ পড়ুয়া হিসাবে শেষবার রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীকে দেখার আগ্রহে। আর সেদিনের শেষযাত্রায় থাকা আর আজকের শেষযাত্রায় থাকার তুল্যমূল্য অভিজ্ঞতা থেকেই কলম ধরতে ইচ্ছা হল।
জ্যোতিবাবুর মতো, বুদ্ধবাবুও মরণোত্তর দেহদানে অঙ্গীকারবদ্ধ ছিলেন। ১৪ বছর আগে কলকাতার বিভিন্ন রাজপথ দখল নিয়েছিল বাম জনতা। সেই দিনের কারণ যে জ্যোতিবাবু। বসুর দেহ দান করা হয়েছিল এসএসকেএম হাসপাতালে। বুদ্ধদেবের এনআরএসে। বসুর বিদায় হয়েছিল রাষ্ট্রীয় মর্যাদায়।
জ্যোতিবাবুর শেষ যাত্রা শুরু হয়েছিল সকাল ৭টা থেকে জাতীয় পতাকায় মোড়া দেহ সেনাবাহিনীর সজ্জিত ‘গান ক্যারেজে’। আর বুদ্ধবাবুর অন্তিম বাহন হয়ে রইল তারই জীবন যাপনের মত সাদামাঠা একটি ‘শববাহী গাড়ি’। এদিন দেখা গেল বুদ্ধবাবুর সেই সাদা অ্যাম্বাসেডরটা দাঁড়িয়ে রইলো দীনেশ মজুমদার ভবনের সামনে, আর শেষবারের মতো আলিমুদ্দিন ছেড়ে বেরোলেন বুদ্ধবাবু একটি বেসরকারি সংস্থার গাড়িতে। জীবনের শেষ দিন ওই বেসরকারি সংস্থার গাড়িতে করেই রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী চলে গেলেন লোকচক্ষুর আড়ালে।
জ্যোতি বসুর শেষযাত্রায় উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উপস্থিত ছিলেন সোনিয়া গান্ধী, প্রণব মুখোপাধ্যায়, লাল কৃষ্ণ আদবানি, সহ জাতীয় রাজনীতির একাধিক হেভিওয়েটরা। কিন্তু, বুদ্ধবাবুর অন্তিম যাত্রায় বাম জনতার সাথে পা মেলালেন প্রকাশ করাত, বৃন্দা কারাত, ত্রিপুরার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার, বিমান বসুরা। শববাহি সকেটের সামনে এদিন পুরোটা হাঁটতে দেখা গেল ঘামেভেজা মহম্মদ সেলিমকে।
এদিন শেষযাত্রায় হাটতে হাটতে মনে হচ্ছিল মাত্র ১৪টা বছরের পার্থক্য। তারইমধ্যে কী অদ্ভুত বদল। জ্যোতিবাবু শেষযাত্রা ছিল বর্ণাঢ্য, তার রাজনৈতিক জীবনের মতই জৌলুসে মোড়া। আর বুদ্ধবাবুর শেষযাত্রা হল জৌলুসহীন, তাঁর সাদামাটা জীবনের মতই। খানিকটা ট্রাজিক নায়কের মতই বিদায় নিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। কিছু খালি গলায় শুধুই থাকলো ‘কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল’।
১৪ বছর আগে সিপিএম ক্ষমতাসীন। ১৪ টা বছর পর সিপিএম ক্ষমতাহীন। ২০১০ সালে ২৩৫টি আসন নিয়ে ক্ষমতায় বাম সরকার। ১৪টা বছর পর ২০২৪ সালে শূন্য বামেরা। আর তারই ছাপ দেখা গেলো বামদুর্গের শেষ অধিপতির অন্তিম যাত্রায়।
জ্যোতিবাবুর ‘পিস হাভেন’ থেকে সকাল ৭টায় শুরু হয়েছিল অন্তিম যাত্রা। প্রথম তাঁকে সোজা নিয়ে আসা হয়েছিল আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে। যদিও সেদিন অত বড় গাড়ি ঢুকতে পারেনি সিপিএমের রাজ্য দপ্তরের গেটের সামনে। পলিটব্যুরো সদস্যেরা স্ট্রেচারে শায়িত বসুকে বহন করে নিয়ে গিয়েছিলেন পার্টি অফিসের ভিতরে। সেখানে শুধুই মাল্য দান করেছিলেন সিপিএম এবং বামফ্রন্টের প্রবীণ নেতারা। এরপর সকাল ৯টার কিছু পরে বসুর নশ্বর দেহ তোলা হয়েছিল বিশাল ট্যাবলো লরিতে। সেই লরির পাশে পাশে ঝকঝকে মোটর সাইকেলে কলকাতা পুলিশের সার্জেন্টরা। বসুর মাথার কাছে দাঁড়িয়ে তাঁর আপ্ত সহায়ক জয়কৃষ্ণ ঘোষ এবং তখন সদ্য পঞ্চাশ-পেরোনো সেলিম। সটান মহাকরণের পথে। সকাল ১০টায় মহাকরণে মালা দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এবং তৎকালীন মুখ্যসচিব। সেখান থেকে ঢিল ছোড়া দূরের বিধানসভা ভবনে। গাড়ি-দূরত্বে পাঁচ মিনিটের ওইটুকু পথ যেতে লেগেছিল আধ ঘণ্টারও বেশি। বেলা পৌনে ১১টা থেকে পৌনে ৪টে পর্যন্ত বিধানসভায় শায়িত ছিলেন জ্যোতিবাবু। সেখানেই তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন হাসিনা, সনিয়া, আদবানী, প্রণবেরা। তাঁদের পরে কাতারে কাতারে সাধারণ মানুষ। বেলা ৩টেয় বন্ধ হয়েছিল বিধানসভার ফটক। বাইরে তখনও থিকথিক করছে মানুষ। বেলা পৌনে ৪টের সময় সেনা তত্ত্বাবধানে সুসজ্জিত ফৌজি শকটে বসুর দেহ রওনা হয়েছিল মোহরকুঞ্জের পথে। তত ক্ষণে গোটা মধ্য কলকাতা জনতার দখলে। জনজোয়ার ঠেলে মোহরকুঞ্জে। সেখানে ভিড়ে-ঠাসা মেকশিফ্‌ট গ্যালারির সামনে ‘গান স্যালুট’ রাজ্য পুলিশের। বসুর দেহদানের অঙ্গীকারপত্র দেওয়া হয়েছিল বিমান বসুর হাতে। সেখান থেকে সোজা এসএসকেএমের অ্যানাটমি বিভাগে।
শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টা নাগাদ বুদ্ধবাবুর শেষযাত্রা শুরু হয় ‘পিস ওয়ার্ল্ড’ থেকে। কাচ-ঢাকা সাধারণ শকটে লাল ঝান্ডায় মোড়া। সেখান থেকে সোজা বিধানসভা। কোনও আড়ম্বর নেই। তেমন একটা ভিড়ভাট্টা পরল না চোখে। সাদামাঠা শ্রদ্ধাজ্ঞাপন রাজ্যের মন্ত্রী, শাসক এবং বিরোধী দলের বিধায়কদের। বেলা ১১টা থেকে যে আধ ঘণ্টা রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীকে রাখা হয়েছিল বিধানসভায়, ততক্ষণই ঠায় সেখানে দাঁড়িয়েছিলেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। ছিলেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীও। ঘটনাচক্রে, সেখানেই শ্রদ্ধা জানাতে গিয়েছিলেন একদা বুদ্ধদেবের স্নেহভাজন সিপিএমের প্রাক্তন রাজ্যসভার সাংসদ এবং বর্তমানে তৃণমূলের শ্রমিকনেতা ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়। ১২টার কিছু পরে বেরিয়ে বুদ্ধবাবুকে আনা হয় আলিমুদ্দিনে। সেখানে অবশ্য ভিড় ভেঙে পড়েছিল। সেই ভিরের মধ্যেই দেখা গেল অভিনেতা দেবদূত ঘোষ, অভিনেত্রী উষসী চক্রবর্তীদের। পার্টি অফিসে শ্রদ্ধা জানাতে কলকাতা পৌরসভার একমাত্র কংগ্রেসের পৌরপিতা সন্তোষ পাঠককে সঙ্গে নিয়ে এলেন প্রাক্তন বিরোধী দলনেতা আব্দুল মান্নান।
বুদ্ধবাবুর শেষ দিনে দেখা গেল আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের মোড়ে, এজেসি বোস রোড়ের উপর একচিলতে ছোট মঞ্চ। যেখান থেকে মাইক হাতে নিয়ে ভিড় নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছেন কখনও মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়, আবার কখনও মধুজা সেনরায়রা। তখন আলিমুদ্দিনের ওই সংকীর্ণ গলি ভিড়ে ঠাসা। কারও হাতে পোস্টার। কারও হাতে ফুলের তোড়া। আবার কেউ একেবারেই খালি হাতে। এদিন রাস্তার উপর পসরা বসেছিল কাস্তে-হাতুড়ি আর বুদ্ধদেবের ছবি সম্বলিত চাবির রিংয়ের। যদিও খুব একটা বিকোতে দেখা গেলো না।
বেলা সাড়ে তিনটে নাগাদ শেষ বারের মতো আলিমুদ্দিন ছাড়লেন বুদ্ধ। একেবারে প্রথমে দু’টি অর্ধনমিত লালঝান্ডা বাঁধা একটি অটো রিকশা, তার পরে ৮০ জন অর্ধনমিত লালঝান্ডা নিয়ে স্বেচ্ছাসেবকের সারি। তাঁদের পিছনে একচিলতে ভিড়। তারও পিছনে সিপিএমের ছাত্র-যুব সংগঠন ডিওয়াইএফআইয়ের অর্ধনমিত ঝান্ডা-হাতে সারিবদ্ধ কর্মীরা। তারও পিছনে আসছিলেন বুদ্ধদেব। রাস্তার দুধারে দাঁড়িয়ে অগুনতি মানুষ, যারা কাছে যেতে পারেন নি তাদের মধ্যে কেউ কেউ ভিড়ের মধ্য থেকে ছুড়ে দিচ্ছিলেন রজনীগন্ধার মালা। যা জমতে জমতে পড়ন্ত রোদটা নিষ্প্রাণ লোকটার মুখটাকে কিছুটা ছায়া দিচ্ছিল।
কথা ছিলো আলিমুদ্দিন থেকে বেরিয়ে দীনেশ মজুমদার ভবনে ১০ মিনিটের জন্য নামানো হবে, কিন্তু সময়ের অভাবে এবং ভিড়ের চাপে সেটাও হল না। বারংবার ঘোষণা হচ্ছিল, বিকেল ৪টের মধ্যে এনআরএস পৌঁছতে হবে শেষযাত্রা। যা শেষমেশ পৌঁছল বিকেল ৫টায়। যেটা অন্যদিন যানজট কাটিয়েও দশ, পনেরো মিনিটে যাওয়া যায়, আজ যেতে সময় লাগল প্রায় পৌনে দু’ঘন্টা। বিকেল ৫টা ৩ মিনিটে এনআরএসের ফটক পেরিয়ে ঢুকে গেল শববাহী শকট।
প্রমোদ দাশগুপ্তের সেই সপ্তরথীর মধ্যে আজ বিমানকে শূন্য করে চলে গেলেন সিপিএমের শেষ বিগ্রহটা।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*