“ওয়াজেদ আলি শাহ কলকাতার মেটিয়াবুরুজে আসার পর এ শহরে ঘুড়ির প্রচলন ব্যাপক হয়েছিল ”
তপন মল্লিক চৌধুরী : রেশন দোকানের চাল সেদ্ধ করে তাতে সামান্য গঁদের আঠা মিশিয়ে কাটা বাল্ব বা টিউবের মিহি গুড়ো মেশানো মাঞ্জার ধার হয় বেশি। কারও প্রেসক্রিপশন শিরিষের আঠা, কারও মত মোটা কাচের গুড়ো যত মিহি হবে মাঞ্জার ধার হবে তত বেশি। মাঞ্জাবিদদের ধার বাড়ানোর এই সব তত্ত্ব আসলে এক ধরনের শিল্প, আর সে শিল্প হল গুহ্যশিল্প। সেপ্টেম্বর মাসের গোড়া থেকেই তখন সেই শিল্পচর্চা শুরু হয়ে যেত। চর্চায় ক্লাইমেট একটা বড়ো ফ্যাক্টর কারণ, তার ওপরই নির্ভর করবে শিরিষ না সাবু। যুগ পালটে গেছে। বহুতলের ভিড়ে আকাশ ঢাকা পড়েছে অনেকখনি। এক চিলতে আকাশ কাড়তে পারেনি তবু পেটকাঠি-চাঁদিয়াল-মোমবাতি-বগ্গাদের। কাগজে তৈরি ছয়দশ, বোয়াল, ময়ূরপঙ্খী, আড়া-র জায়গা নিয়েছে প্লাস্টিকের পাগলু-খোকাবাবু-শচীন-বিরাট-ডোনাল্ড ডাক-মিকি মাউসের ছবি দেওয়া ঘুড়ি। উন্মাদনা নেই। এলাকাভিত্তিক ঘুড়িয়ালরাও উধাও তাই ঢিলা, ভলকা, টাইট, খিঁচ, আনখিঁচ, গদ্দা এই সব প্যাচের রেওয়াজ উঠে গেছে। যদিও এগুলি ছিল লোকাল টেকনিক তবে টাংকিবাহার-লাটাইগোরির প্যাচে পড়তে হত সব ঘুড়িকেই। পুরোনো কলকাতায় ঘুড়ি ভোকাট্টা হত ওই প্যাচেই। আর সমস্বরে ভেসে উঠত ‘ভোম্মারা’।
বিশ্বকর্মা পুজোর দিন আকাশ কেন রঙিন ঘুড়িতে সেজে ওঠে তার কারণ খুব ঠিকভাবে কেউই জানাতে পারেননি। ওয়াজেদ আলি শাহ কলকাতার মেটিয়াবুরুজে আসার পর এ শহরে ঘুড়ির প্রচলন ব্যাপক হয়েছিল। বিশ্বকর্মা এমনকী সরস্বতী পুজোর দিনও ঘুড়ি ওড়ানোর চল খেয়াল করা যায় গত শতকের তিনের দশক থেকে। ওই সময় ময়দানে এক সপ্তাহ ধরে চলত ঘুড়ি প্রতিযোগিতা। বছর পনেরো সেটা নিয়ম করেই ঘটেছিল। সরস্বতী পুজোর দিন ঘুড়ি উড়তো উত্তরবাংলাতেও। ঘুড়ির উৎসব হত উত্তরভারতে দশেরার দিন। হনুমান চতুর্থীতে বিহারে, দক্ষিণ ভারতে ওনাম-এর দিন ঘুড়ি ওড়ে। বছর পঁচিশ ধরে গুজরাতের আমেদাবাদে উত্তরায়ণ বা মকর-সংক্রান্তি উপলক্ষে শুরু হয়েছে আন্তর্জাতিক ঘুড়ি উৎসব। এর পিছনে অবশ্য গুজরাতের পর্যটন একটা বড়ো কারণ। বছর বছর ওই ঘুড়ি উৎসবের আকর্ষণ ও জৌলুস লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। নতুন বছরের দ্বিতীয় সপ্তাহে গুজরাতের আকাশ প্রায় ঢেকে ফেলে মালয়েশিয়ার ওয়াউবালং, ইন্দোনেশিয়ার লায়ং-লায়ঙ্গাভে, জাপানের রোককাকু, চিনের ড্রাগন আবার সন্ধ্যার তারা ভরা আকাশ ছেয়ে যায় সাদা ঘুড়িতে। আন্তর্জাতিক ঘুড়ি উৎসব হয় রাজস্থানে, পৃথিবীর আরও বহু দেশে। এদের মধ্যে বলা যায় ওয়াশিংটন মনুমেন্ট গ্রাউন্ডে ন্যাশনাল চেরি ব্লসম উপলক্ষে স্নিথগোনিয়ান কাইট ফেস্টিভ্যাল, কানাডার শুইট কারেন্ট-এ উইন্ডস্কেপ কাইট ফেস্টিভ্যাল, ইংল্যান্ডের পোর্টসমাউথে কাইট ইন্টারন্যাশনাল। এরকম আরও জনপ্রিয় ঘুড়ি উৎসব হয় সিঙ্গাপুরে। জাপানের হামামাৎজুতে মে মাসে, এপ্রিলে চিনের ওয়েইফাঙে, জুলাই মাসে জাকার্তায়।
কেবল ঘুড়ি উৎসব নয় ঘুড়ি নিয়ে প্রবল উদ্দীপনার নজির ছড়িয়ে আছে দুনিয়ার সাহিত্যে-চলচ্চিত্রে এমনকী শুধুমাত্র ঘুড়ি মিউজিয়ামের সংগ্রহে। ঘুড়ি নিয়ে এ পর্যন্ত আখ্যানমূলক ও নিবন্ধমূলক বইয়ের হিসাব দাঁড়াবে শতাধিক। ফিলিপিনসের চাপি-চাপি ঘুড়ি দেখা যায় ১৯৯৯ সালে গিল পেরটেসের চলচ্চিত্র ‘সারঙ্গগোল’-তে। আফগানিস্তানের দারি বা গুড্ডিপারান বাজি-র কথা পাওয়া যায় খালেদ হোসিনির জনপ্রিয় আখ্যান ‘কাইট রানার’-এ। পৃথিবীর ছাব্বিশটি দেশের প্রায় দেড় লক্ষ রকম ঘুড়ি সংরক্ষিত আছে ওয়াশিংটনে ওয়ার্ল্ড কাইট মিউজিয়ামে। আমাদের দেশের আমেদাবাদেও রয়েছে ঘুড়ি মিউজিয়াম। সেখানকার সংগ্রহ সংখ্যাও বিরাট। এখনও পর্যন্ত বিশ্বের সবথেকে বড়ো ঘুড়ির নাম ‘ফেনকিস’ বা ‘কুয়েতি ফ্ল্যাগ’, এটি তৈরি করেছেন পিটারলাম।
ঘুড়ির রঙিন ইতিহাস-ভূগোলে পিছিয়ে নেই কলকাতা। দুই অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ঘুড়িবাজ ম্যাক সুইনি আর চেটারের নাম পাওয়া যায় ১৯২০-২২ সালে ঘুড়ি নিয়ে একটি লেখায়। ওই দুই ঘুড়িবাজের ডেরা ছিল ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে। তালতলা অঞ্চলে কাল্লুর সঙ্গে ঘুড়ির প্রতিযোগিতা ঘিরে চলতো ব্যাপক জুয়া। বউবাজার এলাকার মণীন্দ্র ধর ছিলেন ম্যাক সুইনির চেলা পরবর্তীতে তিনিও হয়ে উঠেছিলেন ওস্তাদ। কলেজ স্ট্রিট পাড়ায় মণীন্দ্র ধর ও যতীন্দ্র ধর-এর ফাউন্টেন পেনের দোকান ধর ব্রাদার্সেই পাওয়া যেত ‘ডি’ ট্রেডমার্ক-এর ঘুড়ি। গত শতকের চার-এর দশকে এই শহরে ঘুড়ি প্রেমিকরা গড়ে তুলেছিল বেশ কিছু ক্লাব। ১৯৫৪-তে সেই ক্লাবগুলিকে এক ছাতার তলায় নিয়ে এসেছিলেন বিখ্যাত মিষ্টান্ন ব্যবসায়ী ভীম নাগের উত্তরাধিকার অনুপ ও দিলীপ নাগ। জেলিয়া পাড়ায় ছিল ওয়েস্ট বেঙ্গল কাইট অ্যাসোসিয়েশনের অফিস। এদের উদ্যোগে একসময় কলকাতায় ঘুড়ি প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিল। ঘুড়ি তৈরির জন্য বিখ্যাত হয়েছিলেন মদন দত্ত। তাঁর নির্মাণকৌশল একদিন পাইরেট করে ফেলেন নিমাইচাঁদ সেন। তিনিও বিপ্লবী সূর্য সেন কাইট ক্লাব তৈরি করেছিলেন। কলকাতার ঘুড়ি ট্র্যাডিশন অবশ্য অনেকটাই ফিকে তবে এখনও বিশ্বকর্মা পুজোয় ঘুড়ি চেত্তা খায়, কেউ কেউ বলে ওঠে ভোকাট্টা…।
Be the first to comment