হোক কলরবের ১০ বছর, সেপ্টেম্বরের শহর আজও ভোলেনি প্রতিবাদের স্বর

Spread the love

 

চিরন্তন ব্যানার্জি :-

সে ছিল আজ থেকে দশ বছর আগের এমনই এক সেপ্টেম্বর। বৃষ্টিতে ভেজা, রোদে পোড়া। একইসঙ্গে বিক্ষোভে উত্তাল। ছাত্রযুবর ডাকে কেমন দল-মত-পতাকা ছাড়াই রাজপথ ভেসে যায় জনস্রোতে, তা সেই প্রথম দেখেছিল কলকাতা তথা বাংলা। গোটা দেশের কাছেও সে দেখা ছিল বলতে গেলে প্রথমই। ‘নন-পার্টিজান’ আন্দোলনের ধারায় যেন হাতেখড়ি হয়েছিল বাঙালির। ‘হোক কলরব’। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনের এই স্লোগানেই সেপ্টেম্বরের ২০ তারিখে গোটা কলকাতা কেঁপে উঠেছিল। বাজ পড়ার শব্দও ফিকে হয়েছিল সে গর্জনে।
তার ঠিক দশ বছরের মাথায় দাঁড়িয়ে, আরও একটি বিদ্রোহের সাক্ষী কলকাতা। তিলোত্তমা কলকাতা এবার লড়ছে তার তিলোত্তমারই জন্য। যে তিলোত্তমা আরজি কর হাসপাতালে কর্মরত অবস্থায় ধর্ষিত হয়ে খুন হয়েছে তিলে তিলে কষ্ট পেয়ে। তার জন্য আবারও দফায় দফায় পথে নেমেছেন হাজার হাজার মানুষ। স্লোগান তুলেছেন আকাশ চিরে। বিচার চেয়ে আঙুল তুলেছেন রাষ্ট্রের দিকে। যেন আবারও এক তুমুল ‘কলরব’ উঠেছে কেন্দ্র থেকে প্রান্তে। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে চলেছে প্রতিবাদ, বিক্ষোভ, অবস্থান। প্রকৃতি ও বিপ্লবের আশ্চর্য সমাপতন ঘটেছে ক্যালেন্ডারের পাতায়, ঠিক দশটা বছরের ব্যবধানে।
হোক কলরব আন্দোলনের উৎস খুঁজতে গেলে জানা যায়, ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রীর হেনস্থার অভিযোগ উঠেছিল এবং তার প্রতিবাদে সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা আন্দোলন করছিলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। আন্দোলন প্রতিহত করার জন্য পুলিশি সন্ত্রাস নেমে আসে। আন্দোলনকারীদের বেধড়ক মারধর করা হয় কর্তৃপক্ষের তরফে। এরকম একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু হয় হোক কলরব আন্দোলন। প্রাথমিক দাবি, ভিসি অভিজিৎ মুখার্জীর পদত্যাগ।
হোক কলরব আন্দোলনের অন্যতম এক শব্দবন্ধই ছিল, ‘স্বাধীন বলেই সফল’। স্বাধীন অর্থে, কোনও সংসদীয় দল বা পতাকা বা মূলধারার রাজনীতির মালিকানা এই আন্দোলনকে গ্রাস করতে পারেনি। তবে একথা অস্বীকার করার উপায় নেই, আন্দোলনের ধারা যতই অনন্য হোক, এই আন্দোলনটিকে আদতে প্রাণ এনে দিয়েছিল, এত ব্যাপ্তি এনে দিয়েছিল জনসাধারণের নিঃশর্ত ও নিস্বার্থ অংশগ্রহণ। একই সঙ্গে, ছাত্রযুবদের তরফে চালিয়ে যাওয়া একটা ধারাবাহিকতা।
আমরা যদি ইতিহাসে ফিরে যাই, তাহলে দেখব সেপ্টেম্বর থেকে শুরু করে জানুয়ারি, এই পাঁচ মাস বিভিন্ন উৎসবের মধ্যে দিয়ে গেছে। দুর্গাপুজো হয়েছে কালীপুজো হয়েছে, নববর্ষ হয়েছে। এসবের মাঝেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সেমিস্টারও হয়েছে। কিন্তু যখন যখন এই উৎসবগুলো এসেছে বা সেমিস্টারের মরশুম এসেছে তার মধ্যে দিয়ে কিন্তু আসতে আসতে আন্দোলনটা এগোতে এগোতে গেছে। ছাত্রছাত্রীরা পরীক্ষা দিয়েছে, আবার দ্বিগুণ উদ্দীপনা নিয়ে, প্রতিরোধ নিয়ে আন্দোলনে সামিল হয়েছে। নিজেদের মধ্যে কথা বলে, জিবি করে, মতামত বিনিময় করে আন্দোলন নিজের মতো করে এগিয়ে গেছে। আন্দোলনের ভবিষ্যৎ ঠিক হতে হতে গেছে। এটা একটা অভাবনীয় বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছিল আন্দোলনের।
শুধু তাই নয়, এই হোক কলরব আন্দোলন দশ বছর আগে বহু ছাত্র-ছাত্রী যুবর মধ্যে পারস্পরিক পরিচয় ঘটিয়েছিল স্বাভাবিক ভাবেই। পথ দেখিয়েছিল যাদবপুর। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে একসঙ্গে রাজপথে হাঁটিয়েছিল বহু তরুণ-তরুণীকে। প্রতিবাদ করতে শিখিয়েছিল। আর সেখান থেকেই কারও কারও রাজনৈতিক সফরও শুরু হয়েছিল। তাই আজ তাঁদের মধ্যেই অনেককেই দেখা যায়, সোশ্যাল মিডিয়া, আন্দোলনের মঞ্চ থেকে শুরু করে, মিছিলে মিডিয়াতে অতি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে। এটাও কিন্তু ওই হোক কলরব আন্দোলনেরই একটা ফলাফল বা বলা ভাল একটা ধারা নির্মাণ করেছে।
শুধু তাই নয়। কলরবিরা মনে করছেন, হোক কলরব আন্দোলনে যে তৎকালীন ভিসির পদত্যাগ ঘটে ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে, সেটা আন্দোলন জয় এবং আন্দোলনের শেষ হিসেবে সূচিত হলেও, তার রেশ থেকেই গেছিল। সেটা যে কোনও সামাজিক প্রতিবাদের মধ্যে দিয়ে হোক, এসএসসি আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে হোক। নিজেদের দাবিগুলি নিজেদের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে নির্মাণ করার ও তাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মূল ভাবনার একটা জায়গা তৈরিই হয়েছিল হোক কলরব আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে।
এই জায়গা থেকেই হোক কলরবের সুর প্রতিধ্বনিত হয়েছে আরজি কর আন্দলনেও। তাই আরজি করে ছাত্র-ডাক্তাররা যখন প্রথম শোনেন, এরকম একটা মৃত্যু হয়েছে, তখনই একজন-দুজন করে জড়ো হয়ে নিজেদের সন্দেহের কথা জানান। জুনিয়র ডাক্তাররা দাবি করতে থাকেন, ম্যাজিস্ট্রেট না আসা পর্যন্ত দেহ বেরোতে দেওয়া হবে না। আইনের হস্তক্ষেপ চান তাঁরা। জুডিশিয়াল এনকোয়্যারি দাবি করেন। দাবি করেন, পোস্টমর্টেমের ভিডিওগ্রাফি করতে হবে। প্রথম প্রতিরোধ জুনিয়ররা এভাবেই করতে শুরু করেন।
১০ তারিখ যখন খবর পেয়ে সারা রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তের ডাক্তাররা পৌঁছন আরজি করে, তাঁদের মারধরের অভিযোগ ওঠে ওই হাসপাতালের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষের ঘনিষ্ঠদের দিকে। এরপরে জুনিয়র চিকিৎসকদের কথায়, “জিবি মিটিং ডাকি, সেটাও ভেস্তে দেওয়া হয়। তবে পরের দিন আমরা ‘গাছতলা মিটিং’ করি। এটাই ছিল ঐতিহাসিক জিবি। সেখান থেকেই সিদ্ধান্ত হয়, আমরা কর্মবিরতিতে যাব, শেষ দেখে ছাড়ব। চরম ভয়ের আবহে এই জেদ খুব সহজ ছিল না। এটাই ছিল গেমচেঞ্জার।’ এই ‘গেমচেঞ্জার’ জিবি যাদবপুরে শুরু হয়েছিল সেই হোক কলরবেরও আগে থেকে।
হোক কলরব আন্দোলন মূলত যাদবপুরের ছাত্রছাত্রী, যুবদের নিজস্ব মতামত ও দাবি সহযোগে শুরু হলেও এতে পরোক্ষভাবে জনসাধারণের বিপুল সমর্থন ছিল। এবার সেটা মাথায় রেখে আরজি কর কাণ্ডের প্রতিবাদে যদি ১৪ আগস্টের রাতের বিপুল জনসমর্থন দেখা হয় তাহলে দেখা যায় আট থেকে আশি সমস্ত স্তরের মানুষ রাস্তায় নেমেছিলেন। পরবর্তী সময়েও যে জনসমর্থন দেখা গেছে সেটা অভাবনীয়। তাই হোক কলরবের ব্যাপ্তির চেয়ে অনেক বেশি বিস্তার করেছে এই আন্দোলন।
উল্লেখ্য, প্রথম দিকে যাদবপুরের অন্দরেই এই যৌন হেনস্থার ঘটনা এবং তার প্রতিবাদ– এই নিয়ে কিছু মতবিরোধও ছিল। আন্দোলন বিচ্ছিন্ন ছিল খানিকটা। কিন্তু পুলিশি অত্যাচারের পরেই গোটা বিশ্ববিদ্যালয় একসঙ্গে গর্জে ওঠে, তৎকালীন ভিসি অভিজিৎ মুখার্জীর বিরুদ্ধে।
প্রসঙ্গত, ২০০৫ ও ২০১০ সালেও পুলিশি মারধরের ঘটনা ঘটেছিল যাদবপুরে। কিন্তু ২০১৪ সালের ঘটনা মানুষকে অনেক বেশি নাড়া দেয়। সেই কারণেই এই আন্দোলন আর যাদবপুরের আন্দোলন ছিল না, গোটা শহরের, গোটা রাজ্যের আন্দোলন হয়ে ওঠে। মনে আছে ‘২০ সোপ্টেম্বর কর্মসূত্রে মেট্রো করে হোক কলরব মিছিলে গিয়েছিলাম কভারেজের জন্য, দেখেছিলাম গোটা মেট্রোর সব লোকই সেদিন মিছিলমুখী ছিলেন।’
বলাই বাহুল্য জানুয়ারি মাসে ছাত্রছাত্রীদের অনশনের পরে ভিসি পদত্যাগ করেন ঠিকই। কিন্তু যেই নিয়ে গোটা ঘটনা শুরু হয়েছিল, ছাত্রীর যৌন হেনস্থা, তা নিয়ে সেই অর্থে কোনও ‘বিচার’ মেলেনি। এক্ষেত্রে আরজি করের ঘটনাতেও তেমনটা হবে না তো? কারণ বদল বা বদলি বা অপসারণ কোনও সমাধান হতে পারে না।
যাদবপুরে তারা ৫ মাসের আন্দোলন করে আংশিক জয় পেয়েছিল। সমাজের সমস্ত স্তর থেকে মানুষ পাশে ছিল। কিন্তু হোক কলরব যদি এই নতুন ধারার আন্দোলনের অঙ্কুরোদ্গম হয়, তাহলে আরজি কর আন্দোলন আজ একটা বৃক্ষ। সেদিন ছাত্র-ছাত্রীরা কর্তৃপক্ষের দিকে আঙুল তুলে প্রশ্ন করেছিল বলেই, আজ রাজ্যের থেকেও কৈফিয়ত চাওয়ার স্পর্ধা রাখছেন আন্দোলনকারীরা।
তবে আরজি করের ঘটনার প্রভাব ও তীব্রতা অনেক বেশি। কারণ একটা প্রাণ চলে গেছে নির্মম ভাবে, তা আর ফিরে আসবে না। কিন্তু তার জেরে যে বিপুল আন্দোলন আছড়ে পড়েছে, তাতে আগামীদিনে এই ধরনের ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা অবশ্যই কমবে।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*