প্রসিত দাস :- ‘যারা প্রতিনিয়ত কষ্ট ও যন্ত্রণায় কাতর, এই পুস্তক তাদের জন্য বিস্ময়করভাবে কার্যকরী। যখন আমাদের সমগ্র সম্প্রদায় দুর্দশা ও উদ্বেগের মধ্যে কাটাচ্ছে, এই বই নিঃসন্দেহে একমাত্রা সুঔষধের কাজ করবে’।
যে-বইয়ের ভূমিকায় মানব আত্মার ব্যথা নিরাময়ের এমন আশ্বাস, সেই বইয়ের পাতা উল্টোলে অশান্ত হৃদয় যে খানিক প্রশান্তির পথ খুঁজে পাবে, তা বলাই বাহুল্য।
বইয়ের নাম— বিশ্ব মনের প্রতিবিম্ব। লেখক স্যুই মো। বাংলায় বইটির তর্জমা করেছেন দেব চৌধুরী। সম্পর্ক পাবলিশিং হাউস থেকে প্রকাশিত বইটি হাতে নিয়ে পড়লে আজকের বিশ্বে সর্বব্যাপী অসুখী হৃদয় খানিকক্ষণের জন্য হলেও সুখের পথ নিয়ে যাবে। আর সেই সুখ, ক্ষণিকের পার্থিব সুখ নয়, বরং বৌদ্ধদর্শনের আধারে আধারিত এক জীবন-দর্শনের মধ্যে খুঁজতে থাকা সুখ।
বৌদ্ধসূত্রের একটি বাণীতে বলা রয়েছে, ‘কেউ যদি অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সমস্ত বুদ্ধকে বুঝতে চায়, তাহলে তাকে বস্তু ও জগতের প্রকৃত প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করতে হবে, যে সব কিছু মনেরই সৃষ্টি’।
বিশ্বায়নের হাত ধরে বাজার-অর্থনীতি যখন প্রতিনিয়ত কেনাকাটার এক নিরবিচ্ছিন্ন ইতিহাস তৈরি করছে, ঠিক তখনই কিন্তু নতুন করে সুখের সন্ধানে নেমেছেন লেখক-দার্শনিক-অর্থনীতিবিদরা। অর্থনীতিবিদ রিচার্ড লেয়ার-এর লেখা বই হ্যাপিনেস পাঠকমনে তোলপাড় ফেলেছে বেশ কয়েকবছর হলো। অর্থনীতি, আয় ও উপার্জনের নিরিখে সুখের সন্ধানে যেতে গিয়ে কীভাবে স্ববিরোধের সম্মুখীন হচ্ছি আমরা প্রতিনিয়ত, তা চমৎকার দেখিয়েছেন লেয়ার্ড। একেবারে বিশুদ্ধ দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকেও এই সুখ-দুঃখের অন্ধকারে আলোকপাত করে চলেছেন অরিন্দম চক্রবর্তীর মতো দার্শনিকরা। উপনিষদ আর রবীন্দ্রনাথকে আশ্রয় করে আমাদের বিশ্বব্যাপী অ-সুখের ক্ষতে খানিক শান্তির বারিধারা ঝরতে দেখা যাচ্ছে কোথাও-কোথাও। ঠিক এই পরিস্থিতিতেই, মানুষের চাওয়া-পাওয়া আর ভোগবাদের চূড়ান্ত বিস্ফোরণের যুগে বৌদ্ধদর্শনকে আশ্রয় করেও প্রকৃত সুখের সন্ধান করা হয়েছে এই বইয়ে। আর সেই সন্ধান-সূত্র বেশ সাবলীলভাবে আলোচনা করেছেন লেখক স্যুই মো, এই আলোচ্য বইতে। বলে রাখা যেতে পারে, স্যুই মো-র অতীত জীবনের শিকড় রয়েছে একদা সেই ‘বোকা বুড়ো’র চিন দেশে, যা এখন সমাজতন্ত্রের আস্তরণে পুঁজিবাদের স্বর্গরাজ্য আর রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন ও একনায়কতন্ত্রের ‘তিয়েন আন মেন স্কোয়ার’। একদা এই চিন ও তার লাগোয়া তিব্বতে বৌদ্ধধর্ম কীভাবে বিস্তার লাভ করেছিলো, সে ইতিহাস কমবেশি সকলেরই জানা। আর সেই বৌদ্ধ-চিনের মাটিতেই গভীরভাবে শিকড় গাঁথা রয়েছে ফুদান বিশ্ববিদ্যালয়ের মানববিদ্যার অধ্যাপক স্যুই মো-র। তাই শুধু প্রবন্ধেই নয়, তাঁর কবিতা, উপন্যাসেও প্রতিফলিত হয় এক দার্শনিক উপলব্ধি। আলোচ্য বইতে তাঁর সেই দার্শনিক-আশ্বাস পাওয়া যায় পুরোদস্তুর, যখন তিনি লেখেন — অস্থিরতাকে প্রতিরোধ করার কোনো উপায় নেই, কিন্তু তাতে ভয়ের কিছু নেই।
স্যুই মো লিখছেন, “বেশিরভাগ লোকই চায় নিশ্চিত নিরাপত্তা, তারা চায় সবকিছু যেন শুরুর অবস্থাতেই থাকে। কোনো ‘ক্ষয়ের’ সম্ভাবনা তাদের বিচলিত করে”। সত্যিই তো। এই ‘নিশ্চিত নিরাপত্তা’র গভীরে গেলেই আসে অনিশ্চিত জীবনের আশঙ্কা। হয়তো-বা মৃত্যুর আশঙ্কাও। স্যুই মো লিখছেন, ‘জীবন একটা রেলগাড়ির মতো, যার শুরু নেই, শেষও নেই। মনে থাকে না, কখন সেই ট্রেনে চড়ে বসেছো। শুধু জানো যে, কী পোশাক পরেছো তুমি, কিছু লোকের সঙ্গে কথা বলেছো তুমি আর পাশ দিয়ে যাওয়া কিছু লোকের সঙ্গে কাঁধে ঘষা লেগেছে…। তুমি জানো যে, যেতে-যেতে কিছু গল্প তৈরি হয়েছে, কিন্তু সেই গল্প ভুলে যাওয়া কি খুব কঠিন? তারপর হঠাৎ একটা সময় আসে, তুমি খুব ক্লান্ত হয়ে পড়ো, তোমার মৃত্যু হয়। এক মুহূর্তের স্তব্ধতা, তারপর আবার সবকিছু নতুন করে শুরু হয়। কিন্তু সেই শুরুটা তোমার মনে থাকে না। আগের যাত্রার কথা, তখন তোমার পোশাক কেমন ছিলো, কাদের সঙ্গে কথা হয়েছিলো, কাদের সঙ্গে দেখা হয়েছিলো, কী কী ঘটনা ঘটেছিলো, কিছুই আর একেবারে মনে পড়ে না। তুমি মনে করো এটাই তোমার একমাত্র যাত্রা আর এটাই শুরু’।
এভাবেই লেখক বোঝাচ্ছেন, ‘এই হলো বৌদ্ধমতে জন্মমৃত্যুর চক্র’।
অনিশ্চিয়তা কি শুধু মৃত্যুকে নিয়ে? জীবনকে নিয়েও তো কম অনিশ্চিয়তা নেই। স্যুই মো লিখছেন, ‘অসঙ্গতি দেখা যায়, যখন উন্মাদের মতো অর্থোপার্জন, ধূমপান, মদ্যপান করে ভোগের উন্মত্ততায় মেতে থাকি…’। এই ভোগের শেষ কোথায়? উত্তর মেলা কঠিন। তবে সুখের সন্ধান পেতে গেলে এর উত্তরও কম জরুরি নয়।
বিশ্ব মনের প্রতিবিম্ব
লেখক: স্যুই মো
অনুবাদ: দেব চৌধুরী
প্রকাশক: সম্পর্ক পাবলিশিং হাউস
প্রথম প্রকাশ: ২০২৩
দাম: ৩৫০ টাকা
Be the first to comment