রোজদিন ডেস্ক :- উৎকলখণ্ড’এবং ‘দেউল তোলা’নামক ওড়িশার প্রাচীন পুঁথিতে জগন্নাথদেবের রথযাত্রার ইতিহাস প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে এই রথযাত্রার প্রচলন হয়েছিল প্রায় সত্যযুগে। সে সময় আজকের ওড়িশার নাম ছিল মালবদেশ। সেই মালবদেশের অবন্তীনগরী রাজ্যে ইন্দ্রদ্যুম্ন নামে সূর্যবংশীয় এক পরম বিষ্ণুভক্ত রাজা ছিলেন, যিনি ভগবান বিষ্ণুর এই জগন্নাথরূপী মূর্তির রথযাত্রা শুরু করার স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন। পরবর্তিকালে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন পুরীর এই জগন্নাথ মন্দির নির্মাণ ও রথযাত্রার প্রচলন করেন।
পুরীর রথযাত্রা উৎসব হচ্ছে বড় ভাই বলরাম বা বলভদ্র ও বোন সুভদ্রাকে সঙ্গে নিয়ে শ্রীকৃষ্ণের বৃন্দাবন যাত্রার স্মারক। তিন জনের জন্য আলাদা আলাদা তিনটি রথ। রথযাত্রা উৎসবের মূল দর্শনীয় হল এই রথ তিনটি। প্রথমে যাত্রা শুরু করে বড় ভাই বলভদ্রের রথ। এই রথের নাম তালধ্বজ। রথটির চোদ্দোটি চাকা। উচ্চতা চুয়াল্লিশ ফুট। রথের আবরণের রঙ নীল। তারপর যাত্রা করে সুভদ্রার রথ। রথের নাম দর্পদলন। উচ্চতা প্রায় তেতাল্লিশ ফুট। এই রথের মোট বারোটি চাকা। যেহেতু রথটির ধ্বজা বা পতাকায় পদ্মচিহ্ন আঁকা রয়েছে তাই রথটিকে পদ্মধ্বজও বলা হয়ে থাকে। রথের আবরণের রঙ লাল। সবশেষে থাকে জগন্নাথদেবের রথ। রথটির নাম নন্দীঘোষ। পতাকায় কপিরাজ হনুমানের মূর্তি আঁকা রয়েছে তাই এই রথের আর একটি নাম কপিধ্বজ। রথটির উচ্চতা পঁয়তাল্লিশ ফুট। এতে ষোলোটি চাকা আছে। প্রতিটি চাকার ব্যাস সাত ফুট। রথটির আবরণের রঙ হলুদ। তিনটি রথের আবরণীর রঙ আলাদা হলেও প্রতিটি রথের উপরিভাগের রঙ লাল।
জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা পালিত হচ্ছে আজ ৭ জুলাই। এদিন রথে চড়ে মাসি গুণ্ডিচার বাড়ি যাবেন জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা। প্রতি বছর রথযাত্রা উপলক্ষ্যে পুরীতে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার জন্য তিনটি পৃথক রথ প্রস্তুত করা হয়। অক্ষয় তৃতীয়া থেকে শুরু হয় রথ নির্মাণের কাজ।
শাস্ত্র অনুসারে বিষ্ণুর চার ধামের অন্যতম হল পুরী। বাকি তিনটি ধাম হল বদ্রীনাথ, দ্বারকা ও রামেশ্বরম। প্রচণ্ড গরমে শান্তি পেতে জ্যৈষ্ঠ পূর্ণিমা তিথিতে ১০৮ কলসি জল ঢেলে স্নান করানো হয় জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রাকে। প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে এরপর জ্বর আসে তিন ভাই বোনের। সর্দি জ্বরের কারণে ১৫ দিন তাঁদের অন্য একটি কক্ষে আলাদা রাখা হয়। রাজবৈদ্যের দেওয়া পাঁচন খেয়ে তাঁরা সুস্থ হন। এরপর রথে চড়ে মাসির বাড়ি বেড়াতে যান জগন্নাথ,বলরাম ও সুভদ্রা। তাঁদের এই যাত্রাই রথযাত্রা নামে পরিচিত।
প্রতি বছর কাঠ কেটে নতুন রথ তৈরি করা হয়। অক্ষয় তৃতীয়া থেকে শুরু হয় রথ নির্মাণের কাজ। কোনও সাধারণ কুঠার দিয়ে এই কাঠ কাটা হয় না। প্রথা মেনে এই কাঠ কাটা হয়ে থাকে সোনার কুঠার দিয়ে।
প্রাচীন কাল থেকেই একই বিধি ও প্রথা মেনে পালিত হয়ে আসছে জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা। এই রথযাত্রা উপলক্ষ্যে প্রাচীন কালে যে সব বিধি আচার পালন করা হত, আজও সেই সব বিধি আচার পালন করা হয়ে থাকে। প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে জগন্নাথ দেব হলেন পুরীর রাজা। রাজার জন্য রথ নির্মাণের কাঠ তাই সোনার কুঠার দিয়েই কাটা হয়ে থাকে।
অক্ষয় তৃতীয় থেকে শুরু হয়ে পুরো ২ মাস সময় লাগে তিনটি রথ প্রস্তুত করতে। কোন গাছ রথ তৈরিতে ব্যবহার করা হবে, তা আগে চিহ্নিত করা হয়। নির্দিষ্ট গাছটি কাটার জন্য মন্দির কমিটিকে বন বিভাগের থেকে অনুমতি নিতে হয়। এরপর মন্দিরের প্রধান পুরোহিত জঙ্গলে যান এবং যে গাছ কাটা হবে, তার পুজো করেন। যে ছুতোর পরিবার বংশানুক্রমে রথযাত্রার জন্য গাছ কেটে আসছে, সেই পরিবারের সদস্য প্রথমে সোনার কুঠার জগন্নাথ দেবের পায়ে স্পর্শ করেন, তারপর জগন্নাথের আশীর্বাদ নিয়ে গাছ কাটেন।
রথ নির্মাণ করতে কোনও পেরেক বা কাটা কাঠ ব্যবহার করা যায় না। রথের কাঠ হতে হবে সোজা ও খাঁটি। রথ নির্মাণের কাজ সম্পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত কারিগররা মন্দির চত্বরেই থাকেন এবং তাঁদেরও অনেক নিয়ম মেনে চলতে হয়। এই সময় কারিগরদের নিরামিষ খেতে হয় ও ব্রহ্মচর্য পালন করতে হয়। কোনও কারিগরের পরিবারের এই সময় কোনও অশুভ ঘটনা ঘটলে তাঁকে রথ তৈরির কাজ থেকে সরে আসতে হয়।
Be the first to comment