(আগের সপ্তাহের পর) (পর্বঃ ২)
মাসানুর রহমান
কামারপুকুর ছেড়ে কিছুটা যাওয়ার পরই দেখলাম হাওয়ার গতিবেগ বাড়লো। মাটিতে ধুপধুপ শব্দ হচ্ছে। একদল লোক মনে হল জীবন বাঁচানোর জন্য দৌঁড়ে পালাচ্ছে। একটা শোঁ শোঁ আওয়াজ। সঙ্গে বিদ্যুতের ঝিলিক। মেঘের কড়কড় সেই আল্ট্রাভায়োনিক তরঙ্গ। দু ’ এক ফোঁটা বৃষ্টি গায়ে লাগলো। ছাতাটা শক্ত করে ধরলাম। তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠলাম, কে শোনে কার কথা। বুকের কাঁপন বেড়ে গেলো। একটা দমকা হাওয়া ধানক্ষেতে আছাড় খেয়ে পরলাম। কাঁদা জলে পড়ে লেজে-গোবরে অবস্থা। গা, হাত,পা ঝেড়েঝুড়ে উঠে দাঁড়ালাম। বৃষ্টির গতিটা বাড়ল। কেউ যেনো আমাকে ঢিল ছুঁড়ে মারছে। ছাতা খুললাম। হাওয়ার চোটে দু’ তিনবার ছাতা উল্টে গেলো , তাকে সোজা করতে বেশ সময় লাগলো। নিজের ওপর ভীষণ রাগ হচ্ছে। কেনো মরতে এই মাঝরাতে এলাম। তার থেকে কাল রাতের ট্রেনে এলেই ভালো হতো। বৃষ্টির বেগ আরো বেড়ে গেলো। প্রাণপণে ছুটছি। সামনে একটা অশ্বথ গাছ দেখতে পাচ্ছি। ভিজে স্নান করে গেছি। অশ্বথগাছের তলায় একটা মোটা সোটা শেকড়ে একটু বসলাম। অঝোরে বৃষ্টি হয়ে চলেছে। তেমনি হাওয়া সঙ্গে বিদ্যুতের চমক আর মেঘের গর্জন। মাথার ওপর টপ টপ করে জল পরতে শুরু করলো , বুঝলাম গাছের পাতা বেয়ে জল পড়ছে। ছাতা খুলে গুটিসুটি মেরে বসলাম। শীত শীত করছে।
মেঘের এফোঁড়-এফোঁড় করে বিভৎস একটা বিদ্যুৎ চমকালো সঙ্গে সঙ্গে বুক হিম করা মেঘের গর্জন। কিছুটা দূরে সামনের ঝোপটায় চোখ গেলো। স্পষ্ট দেখতে পেলাম। একজন ভদ্রমহিলা এক হাত লম্বা ঘোমটা মাথায় দিয়ে দাঁড়িয়ে। ধবধবে সাদা কাপড় পরহিত। আমি যেখানে বসে আছি। সেখান থেকে ওই ঝোপটার দূরত্ব খুব বেশি হলে বিশ থেকে পঁচিশ গজ দূরে। এতো রাতে ভদ্রমহিলা ! আমি খুব ভালো করে জানি। খুব কম করে এই সামনের আধ কিলোমিটারের মধ্যে কোন বসতি নেই। মাঠের পর মাঠ খালি ধানক্ষেত। বুকের ভেতরটা মৃদু কম্পন অনুভব করলাম। গলা টিপে কিংবা রক্ত চেঁটে যদি আমাকে এই মাঝরাতে মেরেও ফেলে, কাল সকালের আগে কেউ টেরও পাবে না। বিদ্যুৎ চমকেই চলেছে আর আমার চোখ ইচ্ছে না করলেও বার বার ওদিকে চলে যাচ্ছে। হ্যাঁ বিদ্যুতের আলোয় স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি ভদ্রমহিলা মাথা নীচু করে বসে আছেন। কতক্ষণ বসে ছিলাম জানি না। বৃষ্টি থামার কোন লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি না। শুনেছি লোহা কাছে থাকলে ভূতে ধরে না। লোহা নাকি ভূতের যম। আমার ছাতার ডান্ডিটাতো লোহার। ধুর! লোহা তোকে কে বললো , ওটা তো স্টেইনলেস স্টিলের। তাতে কি হয়েছে। স্টেইনলেসস্টিল কি সোনা দিয়ে তৈরি হয়। ওর মধ্যে লোহা আছে। সিলভার আছে। ভ্যাম্পায়ার হলে নিশ্চিত মরবে। আচ্ছা কামারপুকুরের সাথে ভদ্রমহিলার কি কোনো যোগসূত্র আছে ?
অনেকক্ষণ বসে থাকার পর সিদ্ধান্ত নিলাম, ঢের হয়েছে! আর নয়। মুখের বুলিতে সাহস আসলেও সামনে আগানোর সাহস পেলাম না। বৃষ্টির রাত। চারদিকে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামছে। অশ্বথগাছের নিচ থেকে উত্তরদিকের শ্বশানটা দেখা যাচ্ছে। আজ মনে হয় চিতা পুড়িয়েছে, ধোঁয়ার কুন্ডলী আকাশের দিকে উড়ে উড়ে যাচ্ছে। শ্বশানের ভয়টুকু আরো মনে আঘাত হানলো। হঠাৎ মনে হলো, ধবধবে সাদা কাপড় পরা মহিলা আমার দিকেই এগিয়ে আসছে। গাছের উপর থেকে একজোঁড়া বাঁদুড় চিৎকার করে উঠলো। বাদুড়ের আওয়াজে যেনো, আমার হৃদপিন্ডটা এখুনি বুকের খাঁচা থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। নিজেকে শান্ত রাখার ব্যর্থ চেষ্টা চালালাম। ঝিঁঝিঁপোকার আওয়াজ থেমে গেছে, বৃষ্টি তখনও হয়েই চলেছে।
হাতের মুঠোয় ব্যাগটা শক্ত করে ধরলাম। ঝুট এক দৌড় লাগালাম। তারপর ব্যাগটা একটু দূরে ছিঁটকে পড়লো। হাতের ছাতাটা বাতাসের বেগে ডানপাশের জমিতে উল্টো হয়ে পড়লো। কিছুক্ষণ চুপচাপ ওভাবেই থাকলাম। কানের কাছে হঠাৎ মিনমিনে সুরে কে যেনো বলে উঠলো,
“কি রে মিনসে থাকবি আমার সাথে, তোর একদলা মাংস আমার খুব পছন্দ হয়েছে !! “
শরীর যেন অবশ হয়ে আসছিলো। আধশোয়া হয়ে উঠে বসলাম, কামারপুকুরের দিকে সাদা আলোর ছটা দেখা যাচ্ছে। পেছনদিকে এবার ব্যাগ নেওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালাম। কাঁদাপানিতে সাদা শার্ট বাদামী রঙের হয়ে গেছে। ব্লু জিন্সের কথা নাইবা বললাম। পাম-সু এর ভেতরে চিংড়ির হ্যাচারি করা যাবে। ব্যাগটা হাঁতড়াতে হাঁতড়াতে খুঁজে নিলাম। মেঘের বর্জ্রপাতের আলোয় অনেক কষ্টে ছাতাটাও বের করলাম। সাদা কাপড় পড়া ভদ্রমহিলা তখনও ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। ছাতাটা শক্ত হাতে ধরে এবার মহিলা বরাবর ছুট লাগালাম। অনেক সহ্য করেছি আর। দৌড়ে বেগুন ক্ষেতে ঢুকে পড়লাম। ছাতিটার ডান্ডা উঁচু করে ধরে একদম বুক বরাবর সেঁধিয়ে দিলাম। ঠুস করে একটা শব্দ হলো। বেগুন ক্ষেতে আবার আছাড় খেয়ে পড়ে গেলাম। সোজা বাঁশের চিকন কঞ্চি দেয়া বেড়ার উপর। অল্পের জন্য চোখটা বেঁচে গেল। পেঁছন ফিরে তাঁকালাম, ভদ্রমহিলা তখনও ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। আকাশের বুক চিরে বিদ্যুৎ চমকে উঠলো। বিদ্যুত চমকানোর আলোয় যা দেখলাম তাতে শরীরে আগুন জ্বলে উঠলো। কাকতাড়ুয়া, সাদা কাপড় পড়ানো। মাথার দিকটায় সিলভারের প্রলেপ দেয়া বিস্কুটের কাগজ দিয়ে বাঁধানো। পাটের জটা দিয়ে চুলের মত করে বানানো।
রাগে গজগজ করতে করতে চোখ মেলে সামনে তাকালাম। মেঘটাও রাগে গর্জন করে উঠে। সারাটা শরীর কাঁদায় মাখামাখি। হাতের ব্যাগটা দূরে কোথাও ছিটকে পরেছে। ছাতাটা তখনো আমার হাতের মুঠোয়। আবার বিদ্যুৎ চমকে উঠলো। ব্যাগটাকে কোনরকমে খুঁজে পেলাম। হামাগুড়ি দিয়ে ব্যাগটাকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম। ভিজে চপচপে হয়ে গেছে। ব্যাগটা হাতে নিয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছি ঐযে দূর টিনের চালায় একটা হলুদ বাতি জ্বলছে, ওখানে। গন্তব্যস্থান ঐ হলুদ বাতিওয়ালা বাড়ি। চারপাশে তখনো অবিরাম ধারায় বৃষ্টি ঝরছে। এই মুহূর্তে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টির জল গায়ে মাখতে ভীষণ ভালোই লাগছে।
Be the first to comment