এবারে ২০ শে বিষ

Spread the love

পবিত্র চক্রবর্তীঃ

কয়েকদিন একনাগাড়ে বৃষ্টির পর আজ ১৯ তারিখ একদম ঝকঝকে নীল আকাশ । মাঝে পরীক্ষা থাকার জন্য টুটুন আর বেরোতেই পারে নি মামার সাথে । “ থিম্পু গুহা রহস্য”-এর পর মা আর বেঁকে বসেন নি , তাই এবার দ্বিতীয়বার মামার সাথে সোজা হ্যাভলকে । খানিক চুপচাপ বসার পর টুটুন মামার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে, “ ধুস , একেবারে নিরামিষ জার্নি ।” মামা অমলেট খাওয়া থামিয়ে হেসে ওঠে । “ ওমা , তুই আবার আমাদের গোয়েন্দা কবে থেকে ভাবতে বসলি রে ”, মামা ফুট কাটে ।

এটা ঠিক গতবারের টানটান অভিজ্ঞতা সত্যি ভুলবার নয় । তবে মামা সেটাকে কাকতালীয় ছাড়া কিছুই ভাবে না । নিজে লেখক মানুষ , মাঝে মধ্যে অবশ্য নিজেই বলে , “ বুঝলি কিনা টুটুন এমন ঘটনা ঘটলে লেখার খোরাক আপনি জুটে যায় ।”

কতাবার্তার ফাঁকে ডলফিন গেস্টহাউসের ম্যানেজার একটা ছোট্ট খাম দিয়ে গেল । মামার মত আমিও অবাক । খাম খুলতেই এক চিলতে কাগজ । মামার ভ্রূ কোঁচকানো । পড়া শেষে বলে ওঠে , “ কোন বেরসিক কবির কবিতা ।” লেগপুল করতে কার না ভাল লাগে , মামাকে বললাম , “ এখানেও তোমার ফ্যান !” হাত থেকে চিলতে কাগজটা নিয়ে যখন আমি পড়লাম খানিকটা থতমত খেয়ে গেলাম । বাচ্চাদের মত হাতের লেখা , তার উপর আবার ছড়া –

“ ২০ শে দেবে বিষ ।

দিচ্ছি হদিস –

লাইটের তলায় ,

পূর্ণ একে সমাগম হয় ।”

আমার দিকে মামা তাকিয়ে আছে । বুঝলাম আমার মত মামার মাথার  উপর দিয়ে অর্থ বেরিয়ে গেছে ।

তথাগত’দাকে দুপুরের লাঞ্চে মামা কখন বলে রেখেছে জানা ছিল না । উত্তরবঙ্গ অভিযানে এই তথাগত রায়ের ভূমিকা ভুলবার নয় । দাদাকে এখানে দেখেই চমকে উঠলাম । মামা সাদরে অভ্যর্থনা করল । আমি বললাম , “ আপনি মানে তুমি এখানে …!” “ হ্যাঁ , ভাই এক বছর হল পোর্টব্লেয়ারের সিনিয়র ফরেস্ট রেঞ্জার হয়ে বদলি ।” কথায় কথায় ভারতের ঠিক দক্ষিণপূর্বে তিনশোর বেশী খন্ড খন্ড দ্বীপ নিয়ে গঠিত আন্দামানের গল্পে মশগুল হয়ে গেলাম । মজার বিষয় এখানকার অধিকাংশ দ্বীপের অফিসিয়ালি আবিষ্কর্তা ব্রিটিশরা আর তাই তাদের নামেই দ্বীপের নামকরণ ।

তথাগত’দা মামাকে বললেন, “ দাদা কাল ভরা পূর্ণিমা । গেস্টহাউসের থেকে হ্যাভলকের সমুদ্রতীরে রাত কাটান , দারুন অনুভুতি…লাল কাঁকড়া বেরোয় ভরা জ্যোৎস্নায় ।” কথাটা শুনে আমি দারুন উত্তেজিত হয়ে উঠলাম । মনে মনে থ্যাংকস জানালাম ।

মামার মুখও উজ্জ্বল । আংশিক লেখক ভাব যেন আস্তে আস্তে জেগে উঠছে । নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে অস্ফুট গলায় গেয়ে ওঠে –

“ আজি জ্যোৎস্না রাতে…।” গুনগুন করে খানিক গাওয়ার পর তথাগত’দা আর আমার দিকে ফিরে বলে “ আচ্ছা তোমরা সেই ছেলেবেলার এক থেকে দশের গুনতিটা জানো ?”

আমি ইংরাজি মিডিয়ামের । তথাগত’দা হেসে বললেন “ না জানার কি আছে দাদা । ওই তো একে চন্দ্র , দুয়ে পক্ষ…।” মামা পুরোটা শুনলেই না , তার আগেই বলে উঠল , “ সুনামির পর আমি এখানে এসেছিলাম । স্থানীয় ক্ষয়ক্ষতি তো হয়েছিলই তারসাথে নষ্ট হয়েছিল সমুদ্র তলদেশ ।” তথাগত’দা মাথা নেড়ে সম্মতি জানান । আমি নিশ্চুপ । মামা এসব বলতে শুরু করলো কেন কে জানে ! একবুক নিঃশ্বাস নিয়ে আবার বলে , “ বুঝলে তথাগত মানুষের লোভের উপর কত আর নিষেধাজ্ঞা চাপাবে , যত চাপানো হবে ততই বাড়বে …।”

বেলা চারটে নাগাদ সরকারী বোটে করে পোর্টব্লেয়ারের দিকে রওনা দিলেন দাদা । যাওয়ার আগে মামা তথাগত’দাকে বললেন, “ রাতে একবার তোমায় ফোন করব , কথা আছে আর পারলে কাল-পরশু একটু ফ্রি থাকার চেষ্টা কর ।”

মামার মতিগতি দেখে কেন জানি না মনে হল কিছু একটা ঘটতে চলেছে । রাতের খাওয়া সেরে দুজনা সামনের খোলা ব্যালকোনিতে দাঁড়ালাম । অদূরে ঢেউয়ের মাথায় ফসফরাস চিকচিক করছে । রাতের অন্ধকার ঠেলে বহুদূর থেকে জাহাজের ভোঁ সাইরেন । মামা আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলো , “ বলত , রাতে জাহাজের পথ দেখায় কে ?”

“ লাইট হাউস ।”

এখানে মিশ্র সংস্কৃতি , মিশ্র ভাষা । তার ইতিহাসও আছে । মামার যেহেতু লেখার স্বভাব তাই রাতের দিকে দুধ ছাড়া চা খায় । এক মাত্র বেয়ারা , নাম প্রভু , পূর্বপুরুষ বাংলাদেশী । তাকে ডেকে মামা চা দিতে বলল । ছেলেটি বেশ মিশুকে । নানা গল্প শুরু করল মামা । ছেলেটি মামাকে বলল , “ ছ্যার বিশ টহা আছে ?” বিশ টহা মানে কুড়ি টাকা । মামা চোখ গোল করে বলল, “ তা আছে ।” “ দ্যান ।” আমি ওদের দিকে তাকিয়ে থাকলাম । ছেলেটি লাল কুড়ি টাকা হাতে নিয়ে বলল , “ ছ্যার টহাটার উল্টা দিহে দ্যাখেন ।” দেখলাম, কিছু জঙ্গল আর …। মামা ছোঁ মেরে ভাল করে দেখেই উৎফুল্ল হয়ে ছেলেটির পিঠ চাপড়ে বলে উঠলো “সাবাস” । মোবাইলের বোতাম টিপে ফোন করে কি যেন বেশ বলল তথাগত’দাকে ।

সেই রাতে অনেকক্ষণ হা করে তাকিয়ে থাকলাম মামার দিকে । মামা শুধু বলল , “ টুটুন প্রবাল চোর বুঝলি…।” ব্যাস আর হাজারও খুঁচিয়ে মামার ঝুলি থেকে বিশেষ কিছু বার করতে পারলাম না ।

কথা মত সকাল দশটার মধ্যে হ্যাভলক ছাড়লাম । প্রভু হাতে হাতে আমাদের কিছু জিনিষ তথাগত’দার সরকারী বোটে তুলে দিল । নীল জলরাশি চিরে এগিয়ে চলল তীব্র গতিতে । বাঁ পাশে ক্রমশ বিন্দুতে পরিনত হতে লাগল নেল-হ্যাভলক আইল্যান্ড । বেশখানিক্ষণ পর দাদা মামাকে কাজের হিসাব দিয়ে বললেন, “ দাদা যা বলেছিলেন সবই রেডি । ইন্সপেক্টর শ্রীনিবাসন লোকজন নিয়ে টুরিস্ট হিসাবে থাকবেন ।” মন দিয়ে শুনল বটে কিন্তু মামা চুপচাপ ।

ঠিক এই সময়ে আমাদের বোটের ডান পাশ দিয়ে আরেকটি বোট গর্জন করতে করতে বেরিয়ে গেল । অদ্ভুত চিন্তাহীন গলায় মামা বলল, “ অবাক হওয়ার কিছু নেই ,নেল আইল্যান্ডেরও হতে পারে ।” কিন্তু তথাগত’দার কপালে ভাঁজ পরলো ।

পোর্টব্লেয়ারে এসে মামা একবারই আমাকে শুধু বলল, “ টুটুন ছড়াটা আর যেমনই হোক , বুদ্ধির বুঝলি আর হ্যাঁ শোন পারলে বাজার থেকে একটা চিলি স্প্রে কিনিস কাজে লাগবে ।” মুখে প্রশ্নের ছাপ উঠতেই মামা ঠোঁটে আঙুল দিয়ে চুপ থাকতে ঈশারা করল ।

রস আইল্যান্ডকে ডান পাশে রেখে উত্তর-পশ্চিম দিকে আমাদের বোট প্রায় মাঝ সমুদ্রে দাঁড়িয়ে পড়ল । সিঁড়ি বেয়ে আমরা নামলাম একটা স্থানীয় নৌকায় । শ্রীনিবাসন আর তার লোকজন অন্য একটিতে ।

সূর্য কিছুক্ষণ আগেই ডুবে গেছে । স্থানীয় একটা দুটো বাসিন্দার ঘরে টিমটিমে আলো । ম্যাপ বার করে মামা আর আমরা পূর্ব নির্দেশ মত এগোলাম দ্বীপটার ঠিক উত্তরপূর্ব দিকে লাইটের হাউসের দিকে । অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে থাকলাম । এখানেও মশাদের হাত থেকে নিস্তার নেই । আকাশে ভরা পূর্ণিমা । কিন্তু অনেকক্ষণ বসে থেকেও লাভ হল না । সুতরাং খানিকটা নিরাশ হয়ে ফিরতে শুরু করলাম । তথাগত’দা আর আমরা কিছুটা এগিয়ে যাই । মামা ধীর পায়ে এগোচ্ছে । হাল্কা আলোয় বুঝলাম মামার মনে ঝড় ।

-“ হ্যান্ডস আপ মিঃ লেখক , বহত হুয়া এখন মরতে হবে ” , গলাটা শুনেই পিছন ফিরে তাকালাম । একি ! এ যে চ্যাং ! ভেম্পু গুহায় জ্বালিয়েছিল ! আমরা এগিয়ে আসতেই দাত খিঁচিয়ে বলে উঠল, “ গো ব্যাক , আই উইল কিল হিম ।” দেখি মামার মাথায় ঠাণ্ডা পিস্তল ঠেকানো । মামা আমাদের পিছনে থাকাতেই কোন ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে আগের অভিযানের প্রতিশোধ নিতে এসেছে । মাথাটা গুলিয়ে উঠল । আমার হাতটা অলক্ষ্যে জিনসের পকেটে রাখা স্প্রেতে ঠেকল । মামা নির্বিকার । আশ্চর্য মানুষ । মামা শুধু বলে উঠল শান্ত গলায় , “ চ্যাং ইউ আর ডুইং রঙ এগেন ।” সকলের চোখের আড়ালে আমি একটু একটু করে এগোতে লাগলাম উত্তরবঙ্গের সেই কুখ্যাত চিত্র চোরের দিকে । আলোআঁধারিতে কাছে এসেই চ্যাং-এর মুখে সোজা লঙ্কা স্প্রে । “ বাপস” বলে মুখ ঢেকে বসে পড়তেই বাঘের মত ঝাঁপিয়ে পরে শ্রীনিবাসন আর তার দলবল । আকস্মিক সমুদ্রতীর থেকে সোরগোল ভেসে এল । মামা সহ আমরা ছুটে গেলাম জলের দিকে । চারিদিকে ফ্লাড লাইটের আলো । মাছকে যেমন জল থেকে তোলে ঠিক তেমনই গোটা চারেক লোককে জল থেকে তুলছে নেভির লোকজন । কাজ শেষ । সবকটাকে পিছ মোরা করে তোলা হল পুলিশের নৌকায় । যাওয়ার আগে চ্যাং গোঙাতে গোঙাতে বলে গেল , “ আই উইল সি ইউ…।”

হ্যাভলকের সকাল । মিষ্টি হাওয়া । পুলিশ আঙ্কেল , দাদা আর আমি ঘিরে ধরেছি মামাকে । প্রভু চা নিয়ে এসেছে । মামা প্রভুর দিকে সস্নেহে তাকিয়ে বলল, “ তোমাগো জন্যেই দ্বীপটা বাঁচল ।” আমরা তাকিয়ে আছি ফ্যালফ্যাল করে । মামা হেসে বলল , “ প্রথমে আমিও বুঝিনি । আসলে ধাঁধাঁটায় ‘বিষ’ কিছু না , জাস্ট সতর্কতা । গত পড়শু তথাগত যখন বলল ২০ তারিখ পূর্ণিমা আর প্রভু ওই কুড়ি টাকার নোটের কথা বলতেই ধীরে ধীরে জট খুলল ।”

আমি জানতে চাইলাম “ কেমন করে ?”

“ আরে , অনেকেই জানেন না কোরাল আইল্যান্ডের স্থানীয় নাম বিশ আইল্যান্ড । লাইট হল লাইট হাউস আর একে কি হয় ?” বলে মামা ভ্রূ নাচালো ।

তথাগত’দা বলে উঠল, “ একে চন্দ্র । পূর্ণ এক মানে পূর্ণিমা । অর্থাৎ পূর্ণিমার রাতে লাইট হাউসে জমায়েত হবে আর বিশ আইল্যান্ড থেকে কোরাল চুরি করবে ।”

“ ব্র্যাভো ” বলে উল্লসিত হল মামা ।

শ্রীনিবাসন বললেন “ কিন্তু কে আর কেন আপনাকে জানালো চিরকুট দিয়ে ?” উত্তরে মামা প্রভুর দিকে তাকিয়ে বললেন , “ প্রভু কিছু কইবা , তোমাগো হাতের ট্যারাব্যাকা উল্কি কী কয়?”

প্রভু হাউমাউ করে কেঁদে উঠল । মামা অর পিঠে হাত বুলিয়ে বলল, “ অর কিছু দোষ নেই । আমরা এখানে আসার আগেই চ্যাং এখানে আসে আর আমাকে দেখতে পেয়েই জাগে বাঁদরামি বুদ্ধি । ওই প্রভুকে দিয়ে ছড়াটা লেখায় , জানায় আমাকে খোলা চ্যালেঞ্জ । ভাবতে পারে নি ধরা পরে যাবে তোমাদের কিছু কিছু কথায় ।” কথা যেন ফুরাতে চায় না । আমি জিজ্ঞাসা করলাম , “ কিন্তু বাকী লোকগুলো ধরা পড়ল কীভাবে ?”

“ ওটার কৃতিত্ব পুরোটাই যাবে শ্রী আর তথাগতর উপর । আমার কথা মত ওই প্রবাল চুরি ঠেকাতে নেভিকেও জানিয়ে ফাঁদ পেতে রেখেছিল জলে ।”

এখন রাত । মামা আমার পাশে দাঁড়িয়ে । বলল , “ আগের বারের মত এবারও তোর জন্যই বেঁচে গেলাম রে ।” “ মামা একটা কথা বলব ?”

“ বল ।” “ ওই বোটটা কাদের ছিল ?” মামা নীরবে আমার দিকে তাকিয়ে বলল , “ চ্যাং –এর সঙ্গীদের , আমরা আসছি কিনা কনফার্ম করার জন্য ।” আমি আর এরপর কথা বলি নি । ভরা পূর্ণিমায় প্রকৃতির কোলে কথা বলতে থাকলাম আর আমার ভবঘুরে মামার উদ্দ্যেশে মনে মনে বললাম “ ইউ আর গ্রেট ।।”

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*