ময়দান প্রদীপ শূন্য। চলে গেলেন প্রদীপকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর। কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে বেশ কয়েকদিন অসুস্থ অবস্থায় ভরতি থাকার পর আজ দুপুর ২টো বেজে ৮ মিনিট নাগাদ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন অশীতিপর ফুটবল কিংবদন্তি। খবর পেয়ে হাসপাতালে পৌঁছেছেন ক্রীড়ামন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস। হাসপাতালে রয়েছেন ক্রীড়া জগতের বিশিষ্টরা।
গত একমাস ধরে বার্ধক্য জনিত অসুস্থতায় কাবু হয়ে পড়েছিলেন। ঠান্ডা লাগার কারণে বেসরকারি হাসপাতালে ভরতি হয়েছিলেন। মাঝে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলেও ফের অসুস্থ হয়ে পড়েন। ২৮ ফেব্রুয়ারি তাঁকে পুনরায় ভরতি করতে হয় হাসপাতালে, তখন থেকেই ICUতে ছিলেন। কয়েকদিন আগেই কোমায় চলে যান তিনি। আজ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
তিনি নিজের পোশাকি নামের চেয়ে ‘পি.কে’ হিসেবেই পরিচিত এবং সমাদৃত । ১৯৩৬ সালের ২৩ জুন জলপাইগুড়িতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় । বাবার চাকরি সূত্রে বিহারের টাটানগরে কেটেছে ছোটোবেলা। সেখনে আর ডি টাটা হাইস্কুলের হয়ে ফুটবল খেলা শুরু করেন। মাত্র ১৫ বছর বয়সে বিহারের হয়ে সন্তোষ ট্রফিতে খেলতে এসে প্রথম নজরে পড়েন। ১৯৫৪ সালে এরিয়ানের জার্সিতে কলকাতা ময়দানে প্রথম খেলতে নামেন। প্রথম বছর থেকেই নজর কাড়া ফুটবল স্কিলে বুঝিয়ে দেন তিনি লম্বা রেসের ঘোড়া।
কলকাতার তিন প্রধানের হয়ে না খেলেও ভারতীয় ফুটবলের নক্ষত্র হয়ে ওঠেন প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। দেশের জার্সিতে কেবল ৮৪টি ম্যাচই খেলেননি, ভারতীয় ফুটবলের কোহিনুর হয়ে আলো ছড়িয়েছেন তিনি। তাঁর ঝুলিতে রয়েছে ৬৫টি গোল। ক্লাব ফুটবলে তিন প্রধানের বাইরে ইস্টার্ন রেল কলকাতা লিগ জয়ের কৃতিত্ব দেখিয়েছিলেন। সেই দলের মূলস্তম্ভ ছিলেন পিকে বন্দ্যোপাধ্যায় ৷ রাইট উইং এবং স্ট্রাইকার হিসাবে খেলতেন। গতি ও জোরালো শটের জন্যে বিখ্যাত ছিলেন তিনি।
১৯৫৫ সালে দেশের হয়ে ঢাকার মাটিতে কোয়াড্রাঙ্গুলার প্রতিযোগিতায় নজরকাড়া ফুটবল উপহার দেন তিনি। এরপর ১৯৫৮, ১৯৬২, ১৯৬৬ সালের এশিয়ান গেমসে খেলেছেন পি কে। ৬২ সালে জাকার্তা এশিয়ান গেমসের সোনা জয়ী ভারতীয় ফুটবল দলের অন্যতম কারিগর ছিলেন তিনি। সেইসময়ে পি কে বন্দ্যোপাধ্যায়, চুনী গোস্বামী ও তুলসী দাস বলরাম ছিলেন ভারতীয় ফুটবলের তিনমূর্তি। তাদের দাপটে কাঁপত অন্য দেশের খেলোয়াড়রা ৷
১৯৫৬ সালের হেলিসিঙ্কি অলিম্পিকে চতুর্থ হয়েছিল ভারত । সেই দলের সদস্য ছিলেন পি কে । ১৯৬০ সালের রোম অলিম্পিকে দেশের নেতৃত্বের ভার ছিল প্রদীপকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপরই । ফ্রান্সের বিরুদ্ধে বলরামের পাস থেকে শুরু করে তাঁর করা গোল- আজও পুরানো ফুটবলপ্রেমীদের মুখে মুখে ফেরে । ১৯৬৭ সালে কলকাতা লিগে ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে তাঁর জোরালো শটে গোলের হদিস পাননি সেদিনের কিংবদন্তি গোলরক্ষক পিটার থঙ্গরাজ । ওই বছরই ছিল ফুটবলার হিসাবে প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের শেষ বছর । এরপর ফুটবলার থেকে প্রশিক্ষক প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের রূপান্তর হয় । কলকাতার মাঠে বাটা স্পোর্টস ক্লাবের হয়ে কোচ প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিষেক হয় ।
১৯৭২ সালে ইস্টবেঙ্গলের কোচ হয়ে আসার পরে তাঁর কোচিং জীবনের সেরা পর্বের শুরু । ম্যান ম্যানেজমেন্ট, গেম রিডিং- সব জায়গাতেই সেই সময় নতুন ভাবনার আমদানি করেছিলেন তিনি । ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত ইস্টবেঙ্গলের দাপুটে ফুটবলের কারিগর ছিলেন । ১৯৭৬ সালে মোহনবাগানে গিয়েও তিনিই ছিলেন ভারতীয় ফুটবলের ‘‘টপ বস’’ ।
১৯৭২ সালে ইস্টবেঙ্গলকে যেমন ত্রিমুকুট এনে দিয়েছিলেন, ১৯৭৭ সালেও একইভাবে মোহনবাগানকে ত্রিমুকুট দিয়েছিলেন । ১৯৮০ সালে ইস্টবেঙ্গলের কোচ হিসেবে ফের সেরা হিসাবে নিজেকে প্রমাণিত করেন তিনি । সেই বছর ভাঙাচোরা ইস্টবেঙ্গল দলকে সারাবছর অপরাজিত রেখেছিলেন মজিদ বিসকার, জামশেদ নাসিরি এবং মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যের দুরন্ত ফুটবলের উপর ভর দিয়ে । ১৯৮৫ সালে ইস্টবেঙ্গলকে এশিয়ান মানদণ্ডের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছিলেন তিনি । নয়ের দশকে প্রধানের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি মহমেডান স্পোর্টিং ক্লাবের প্রশিক্ষণের দায়িত্বও সামলেছিলেন পি কে ।
প্রশিক্ষক অমল দত্তের সঙ্গে তার ফুটবল বুদ্ধির টক্কর ভারতীয় ক্লাব ফুটবলের বিশেষ চর্চিত বিষয় । অমল দত্তের ডায়মন্ড সিস্টেমকে টেক্কা দেওয়ার জন্য সেরা লোক ছিলেন প্রশিক্ষক প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় । ১৯৭২ সালে মিউনিখ অলিম্পিকগামী ভারতীয় দলের কোচ ছিলেন প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় । ১৯৮২ এবং ১৯৮৬ সালের এশিয়ান গেমসেও ভারতীয় দলের কোচের দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি । ফুটবলের বাইরেও ছিল তার প্রতিভা ৷ অসম্ভব ভালো বাগ্মী মানুষটি ধারাভাষ্যকার হিসেবেও সফল ও পরিচিত হয়েছিলেন । ফুটবলের কলম লিখিয়ে হিসেবেও তিনি সমাদৃত । চলচ্চিত্র অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের অভিন্ন হৃদয় বন্ধু ছিলেন তিনি ৷ জমাটি আড্ডায় মধ্যমণি হিসাবেই উপস্থিত থাকতেন । বিভিন্ন সামাজিক বিষয়ে অনর্গল বলে যাওয়ার বিরল ক্ষমতা ছিল পি কে বন্দ্যোপাধ্যায়ের ।
তিনি অবসর সময়ে সচিন কর্তার গান গাইতে এবং শুনতে ভালোবাসতেন । আড্ডায় অনুরোধে কয়েক কলিও গাইতেন তিনি । কয়েকমাস আগে রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড় তাঁর বাড়িতে দেখা করতে গিয়েছিলেন । প্রদীপকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় একা নন, তাঁর ভাই প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ও ফুটবলার ছিলেন । কিন্তু প্রশিক্ষক প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সবচেয়ে বড় গুণ ছিল নিরপেক্ষতা । ১৯৬১ সালে তিনিই প্রথম ফুটবলার হিসাবে অর্জুন পুরস্কার পান । ১৯৯০ সালে পদ্মশ্রী সম্মানেও ভূষিত হন । ২০০৪ সালে FIFA প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়কে ভারতের ‘শতাব্দী সেরা ফুটবল ব্যক্তিত্ব’ হিসেবে সম্মানিত করে।
বুদ্ধির পাশাপাশি ফুটবলারদের থেকে নিজেদের সেরাটা বের করার জন্যে তাঁর ভোকাল টনিক এখনও চর্চিত । ‘‘জার্সি মা ’’,‘‘মায়ের সম্মান রক্ষায় নিজেকে উজাড় করে দাও’’ – তাঁর এমন কথায় ফুটবলাররা উদ্বুদ্ধ হয়ে যেতেন । তার বিখ্যাত উক্তি ছিল ‘‘ডাঁটা চচ্চড়ির মশলা দিয়ে বিরিয়ানি রান্না করা যায় না’’, তা আজও অমর । তবে ডাঁটা চচ্চড়ির মশলা দিয়ে বিরিয়ানি রান্না করতে হলে যে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে হয়, তা গ্রহণ করেছিলেন প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় ৷ সদা বর্ণময়, বাগ্মী, ফুটবলপটু প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় ইহলোকের মায়া কাটিয়ে গমন করলেন পরলোকে । নিভে গেল ভারতীয় ফুটবলের উজ্বল প্রদীপ ।
Be the first to comment