অংশু প্রতিম দেঃ
-“আমার ফিরতে দেরী হবে আজ। তোমরা খেয়ে নিও” অফিসে বেরোচ্ছে শেখর।
-“কোথায় যেন প্রোগ্রাম তোমাদের?” রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে মেঘা। কপালে, গালে ঘাম। ফর্সা মুখটায় লালচে আভা। মেঘার এই রূপটা একটুক্ষণ তাকিয়ে দেখল শেখর। একটা ভাললাগা ছড়ায় ওর মধ্যে।
-“অমিতের ফ্ল্যাটে। একেবারে ডিনার করেই ফিরব।”
-“পানাহার। তাই তো! ড্রিংক্সের কথাটা বাদ দিচ্ছ কেন?” মেঘার মুখেচোখে বিরক্তি ফুটে উঠল। বন্ধুরা আড্ডায় বসা মানে কেন যে বোতল খুলতেই হবে!
-“সেরকম কিছু না! ওই একটু হাল্কার ওপর দিয়ে…”
-“তোমার তো লেগেই আছে। কখনো কলিগ তো কখনো বন্ধুদের সাথে। আজকের মোচ্ছবের উপলক্ষ্যটা কি শুনি?”
-“উপলক্ষ্য কিছু না! বন্ধুরা একসাথে অনেকদিন বসি না তো, তাই।”
-“আমিও দুপুরের দিকে শপিং এ বেরোবো ভাস্বতীদের সাথে।” মেঘার স্কুলের বন্ধুদের একটা গ্রুপ আছে। মাঝেমধ্যে একে অপরের বাড়ীতে আড্ডার আসর বসে। একসাথে শপিং করা, সিনেমা দেখার প্রোগ্রামও লেগেই থাকে।
-“ঠিক আছে।” কেনাকাটা করবে মানে কিছু গচ্চা যাবে আজ! যাক। শপিং করলে মেঘা খোশমেজাজে থাকে। শেখরের দারুসেবন নিয়ে মেঘা আজ রাতে আর খ্যাচখ্যাচ করবে না।
-“খুব বেশী রাত করিস না, বাবা।” টুবলুকে কোলে নিয়ে মাও ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছেন।
-“না, না। দেরী করব না।” শেখর জানে ফিরতে ভালোই রাত হবে। তবু কথাটা বলে মাকে আশ্বস্ত করে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে হাসিমুখে একবার পেছন ফিরে তাকালো শেখর। মায়ের কোলে বসে টুবলুও টাটা করছে তাকে।
বাড়ী থেকে একজন চলে গিয়ে আরেকজন এসেছে। বাবা মারা গেছেন দু বছর আগে। সেইবছরই টুবলু জন্মালো। বড় হওয়ার সাথে সাথে টুবলু ওর দুষ্টুমি আর নতুন নতুন কীর্তিতে বাড়ী মাথায় করে রাখে সর্বক্ষণ। টুবলুকে পেয়ে মা, বাবার শোকটাও বেশ ভুলে থাকেন, জানে শেখর।
বাঁশদ্রোণীর দীনেশপল্লীতে রাস্তার ধারে কালীমন্দির আর একটা বড় পুকুরের মাঝের রাস্তা দিয়ে কয়েক পা হাঁটলেই বেশ অনেকটা জায়গা জুড়ে শেখরদের বাড়ী ছিল। দাদুরা তিন ভাই বাংলাদেশ থেকে এসে সাত–আট কাঠা জায়গা জুড়ে বাড়ী বানিয়েছিলেন। জয়েন্ট ফ্যামিলি। তিন দাদু, ঠাকুমা, কাকা, কাকীমা, খুড়তুতো ভাই বোন, হৈ চৈ হুল্লোড়ে শেখরের ছোটবেলা কেটেছে। লোকজনের ভীড়ে ওদের বড় বাড়ীটা জমজমাট থাকত। সময়ের নিয়মে সে বাড়ী ভেঙ্গে ফ্ল্যাট উঠলে বাবা, মা, আর শেখর একটা তিন বেডরুমের ফ্ল্যাটে আলাদা হয়ে গেছিল। এই ফ্ল্যাটে আসার পরেই শেখরের বিয়ে হয়। লম্বা, ফর্সা, ছিপছিপে চেহারার রীতিমত সুন্দরী মেঘাকে শেখরের বাবা ছেলের বৌ হিসেবে পছন্দ করেছিলেন।
মাষ্টারদা সূর্যসেন মেট্রোস্টেশনে দাঁড়িয়ে রয়েছে শেখর। অফিসে মেট্রোতেই যাতায়াত করে ও। এলগীন রোডে শেখরের অফিস। মেট্রোতে রবীন্দ্রসদনে নেমে সাত মিনিটের হাঁটা পথ। ফোরাম ছাড়িয়ে ডানদিকে ঘুরে রাস্তার বাঁদিকে একটা বড় বিল্ডিং, তার ফোর্থ ফ্লোরে।
ট্রেণের ঘোষণা হয়ে গেছে, পকেটে রাখা মোবাইল ফোনে একটা মেসেজ ঢুকল।
-“আমার পৌঁছতে সাড়ে সাতটা হয়ে যাবে। তোরা আগে পৌঁছে গেলে শুরু করে দিস” মেসেজটা পড়ে শেখরের মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল। অনেকদিন বাদে আজ আবার বন্ধুরা একসাথে বসতে চলেছে।
২
লাঞ্চ করে অফিসের স্মোকিং জোনে এসে ঋজু একটা সিগারেট ধরালো। একটা খুনের কেস নিয়ে কয়েকদিন ধরে বেশ ঝামেলায় রয়েছে। যাদবপুর থানার অফিসার-ইন-চার্জ ঋজু। তিনদিন আগে ওদের থানার কাছে প্রিন্স আনোয়ার শা রোডের ধারের এক বিল্ডিং কমপ্লেক্সে এক মধ্যবয়স্ক ব্যক্তিকে তাঁর ফ্ল্যাটে মৃত পাওয়া গেছিল। বিপুল শিকদার, বয়স পঞ্চান্নর আশেপাশে, বিপত্নীক। একাই থাকতেন ফ্ল্যাটে। একমাত্র মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। সকালে কাজের লোকের হাজার ডাকাডাকিতে ফ্ল্যাটের দরজা না খোলায় ওই বিল্ডিং এর অন্যান্য ফ্ল্যাটের কয়েকজন মিলে সিদ্ধান্ত নিয়ে পুলিশে খবর দিয়েছিলেন।
-“কি খবর তোর?” ফোনের অপর প্রান্তে শেখর।
-“চাপে আছি একটা কেস নিয়ে।”
-“কখন আসছিস?”
-“বুঝতে পারছি না। আসার ইচ্ছে তো আছে। জিত আর সায়ন্তন আসছে তো?”
-“আসছে। সাড়ে সাতটা থেকেই আসর শুরু হয়ে যাবে মনে হচ্ছে।”
-“শালা, বিপুলটা আর মড়ার সময় পেল না!” মনে মনে গজগজ করছিল ঋজু।
অমিত, শেখর, জিত, সায়ন্তন আর ঋজু স্কুলের সময়কার বন্ধু। হায়ার সেকেণ্ডারির পরে আলাদা আলাদা কলেজে ভর্তি হয়েছিল ওরা। অমিত আর সায়ন্তন ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজে আর বাকিরা জেনারেল লাইনে। নিজেদের মধ্যে রেগুলার যোগাযোগ ছিল তখনো। লেকের ধারে আড্ডা, একসাথে সিনেমা দেখা, ফাঁকা বাড়ী থাকলেই দারুর ঠেক বসানো এসব দেদার চলত। চাকরীতে ঢোকার পরে ধীরে ধীরে কমে গেল। আড্ডা দৈনিক থেকে প্রথমে সাপ্তাহিক তারপর মাসিক এবং বিয়ের পরে অকেশনভিত্তিক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এমনিতে দেখা হত না, কারো বাড়ীতে অনুষ্ঠানে ওরা পরস্পরের সামনাসামনি হত। সবাই যে যার কাজ আর সংসার নিয়ে ব্যস্ত! এইভাবেই চলছিল।
অমিত আমেরিকা পাকাপাকি ভাবে চলে এসে গত এক বছরে পরিস্থিতিটা চেঞ্জ করে দিল একদম। বরাবরের হুল্লোড়বাজ অমিত। আসার পরপরই এক উইকেণ্ডে মন্দারমনিতে ফ্যামিলি আউটিংএর প্রোগ্রাম রেখেছিল অমিত। নিজে বিয়ে না করলে কি হবে, বন্ধুদের ফ্যামিলির সাথে চট করে ফ্যামিলিয়ার হয়ে গিয়েছিল। মন্দারমনি ট্যুরের ছমাসের মধ্যে শান্তিনিকেতন। উইকেণ্ডে ছোট ছোট ট্যুর, অফিসে টানা ছুটি নেওয়ার ঝামেলা নেই। বন্ধুদের বৌয়েরা ত মহাখুশি। কাজের চাপের জন্য ঋজু বৌকে নিয়ে কোথাও ঘুরতে যায়না বলে তন্দ্রার অনেক অভিযোগ ছিল। অমিতের উৎসাহে তন্দ্রার মুখেও হাসি ফোটাতে সমর্থ হয়েছে ঋজু।
-“সিসিটিভি ফুটেজ পাওয়া গেছে স্যার!” ইন্সপেক্টর জয়ন্ত রায় ঋজুর সামনে দাঁড়িয়ে। হাতে একটা সিডি। বাথরুমে ফেলে রাখা বিপুল শিকদারের জামার পকেটে সাউথসিটি মলের ফুডকোর্টের বিল পাওয়া গেছিল। বডিটা যেদিন সকালে পাওয়া গিয়েছিল, তার আগের দিনের বিল। বিপুল ওইদিনই সাউথসিটি মলে গিয়েছিলেন। বিলের টাইম আর আমাউন্ট দেখে বোঝা যায়, শপিং না করলেও তিনি ডিনারটা ফুডকোর্টেই সেরে নিজের ফ্ল্যাটে ফেরেন। কাজের লোক কাচবে বলে জামাটা বাথরুমে ফেলে রেখেছিলেন।
-“গুড জব। ফুটেজ হাতড়ে কিছু পাওয়া যায় কিনা দেখি!” সেদিন বিকেল থেকে রাত অব্ধি মলের কয়েকটা জায়গার ফুটেজ নিয়ে এসেছে জয়ন্ত। দেখা শুরু করার কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রচণ্ড চমকে উঠল ঋজু। লিফটের ফুটেজে অমিত! তবে অবাক করার মত ব্যাপার, অমিতের সাথে একজন নারী। যাকে ঋজু খুব ভালো করেই চেনে। দুজনে গা ঘেঁষে বেশ ঘনিষ্ট হয়ে লিফটে দাঁড়িয়ে। থার্ড ফ্লোরে লিফট থেকে হাত ধরে বেরোলো দুজনে। ওই ফ্লোরেই আইনক্স।
৩
-“বিয়ে করে থিতু হ এবার! আর কতদিন ভবঘুরে হয়ে কাটাবি! আমি চলে গেলে তোর যে কি হবে?” মায়ের কথাটা মাঝেমধ্যেই মনে হয় অমিতের। ঠিকই বলত মা। মা চলে গেছে বছর দেড়েক হতে চলল। অমিত আমেরিকায় চলে গিয়েছিল যেসময়, বাবা, মা দুজনেই বেশ সুস্থ। আমেরিকা ছেড়ে দেশে ফিরতে ইচ্ছা হত না অমিতের। দু বছরে একবার এসে একমাস থেকে যেত! মায়ের মুখটা খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে থাকত সেইসময়টুকু। বাবার বরাবরই আবেগের বহিঃপ্রকাশ কম। তা সত্ত্বেও যদুবাবুর বাজার তোলপাড় করে অমিতের ফেভারিট ইলিশ মাছ খুঁজেপেতে নিয়ে আসতেন। ভবানীপুরের বাড়ীতে মাস খানেক থাকাকালীন সুখের মূহুর্তগুলোয় অমিত ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি, মা ভেতরে ভেতরে শেষ হয়ে যাচ্ছেন।
গতবছরের শুরুতে বাবার ফোন পেয়ে তড়িঘড়ি করে এদেশে এসেও মাকে জীবিত দেখতে পেল না অমিত। হার্ট অ্যাটাক। কোনোরকম মানসিক প্রস্তুতি ছাড়াই মাকে এভাবে হারিয়ে অমিত ভেতরে ভেতরে বেশ নড়ে গেল। শ্রাদ্ধ চুকিয়ে আমেরিকায় গেলেও মাস তিনেকের মধ্যে ইণ্ডিয়ায় ফিরে এল তল্পিতল্পা গুটিয়ে। ভবানীপুরের বাড়ীর পাট চুকিয়ে টালিগজ ফাঁড়ির কাছে ফ্ল্যাট নিল অমিত। রাস্তার ওপরে, আরএসভি নার্সিং হোমের উল্টোদিকে।
-“অল দ্য বেস্ট ফর ইয়োর ব্রাইট ফিউচার” চলে আসার আগে অমিত সারার সাথে লীভ টুগেদার করছিল। ওকে সি-অফ করতে এয়ারপোর্টে এসেছিল সারা। “আই উইল অলওয়েজ চেরিশ দ্য মোমেন্টস উই স্পেন্ট টুগেদার!” সারার বিষণ্ণ মুখের দিকে তাকিয়ে অমিতও ইমোশনাল হয়েছিল। সারার সরু কোমর ধরে কাছে টেনে ওর ঠোঁটে নিবিড়ভাবে একে দিয়েছিল বিদায়চুম্বন।
প্রথামাফিক বিয়েতে আগ্রহ নেই অমিতের। আগে মা বহুবার বলেও ছাঁদনাতলায় নিয়ে যেতে পারেনি ওকে। স্টেটসে থাকাকালীন দু তিনজনের সাথে লীভ টুগেদার করেছিল, তারমধ্যে সারার সান্নিধ্যেই বেশী সময়টা কাটিয়েছে। মেয়েটা ইন্টেলিজেন্ট এবং তুখোড় সেক্সি। ইণ্ডিয়াতে সেট্ল করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর প্রথমেই অমিতের মনে হয়েছিল ও সারাকে খুব মিস করবে ইণ্ডিয়াতে। প্রথম প্রথম করতও।
আজকে বন্ধুদের পার্টি দেওয়ার পেছনে আসল কারণটা কাউকে জানায়নি অমিত। জানাতে পারবেও না কখনো। এক নতুন বান্ধবী এসে ওর মনে সারার জায়গাটা নিয়ে নিয়েছে। সারার সাথে লাস্ট কবে স্কাইপে কথা হয়েছে, মনে পড়ে না এখন আর! অমিতের নিজের কাছে স্বীকার করতে লজ্জা নেই, বান্ধবীটির প্রেমে বেশ হাবুডুবুই খাচ্ছে সে। জীবনে সম্ভবত প্রথমবার। তারই সেলিব্রেশন আজ! দুপুরে বান্ধবীর সাথে, রাতে ছোটবেলার বন্ধুদের সাথে।
-“কখন আসছো?” সকালবেলাতেই ফোনে জানতে চেয়েছিল অমিত।
-“আজ সন্ধ্যেতে!” কথাটার সাথে হাসি ভেসে এল ওপ্রান্ত থেকে।
-“ভ্যাট! খালি ফালতু কথা! ওইসময় তো বন্ধুরা এক এক করে আসতে থাকবে।”
-“তাহলে আজ থাক।” আবার হাসি।
-“না, না! প্লিজ তুমি দুপুর নাগাদ এসো।” অমিতের বাবা মাঝেমধ্যেই ওর ফ্ল্যাট ছেড়ে ভবানীপুরের বাড়ীতে নিজেদের ভাইয়েদের কাছে গিয়ে থাকেন। এই আজও যেমন রয়েছেন। ফাঁকা ফ্ল্যাটে অমিতের ভালবাসা আজ পৃথিবীর কোনো বাঁধাই মানবে না।
-“এই দুদিন আগেই তো দেখা হল!” তিনদিন আগে সাউথসিটি মলে দেখা করেছিল ওরা। সিনেমা দেখে ফুড কোর্টে বসে আড্ডাও দিয়েছিল কিছুক্ষণ।
-“তাতে কি! আমার তো রোজ কাছে পেতে ইচ্ছে করে তোমায়।”
-“আমারো কি করে না! তবে আজ আমাদের প্রোগ্রামটা না রাখলেই পারতে।”
-“না, আমাদের এই রিলেশনশিপ সেলিব্রেট করতেই আজ বন্ধুদের পার্টি দিচ্ছি। তাই আজ আমাদের দেখা হতেই হবে।”
-“আচ্ছা বাবা! আসবো। পাগল একটা!”
৪
সায়ন্তনের আই-টেন যখন এলগীন রোডে এসে দাঁড়ালো, কলকাতার বুকে সন্ধ্যে নেমেছে। শেখর রাস্তায় দাঁড়িয়েছিল। চুপচাপ গাড়ীতে উঠে বসল। সেক্টর ফাইভের অফিস থেকে সায়ন্তন শেখরকে পিক-আপ করে অমিতের ফ্ল্যাটে পৌঁছবে। জিত একটু দেরীতে হলেও সাড়ে সাতটা নাগাদ পৌঁছবে। ঋজুর হয়ত আরো দেরী হবে। এরকম প্রোগ্রাম ঠিক ছিল আজ সকাল অব্ধি। কিন্তু দুপুরের পরের কয়েক ঘন্টায় প্রোগ্রামের ব্যাপক রদবদল হয়েছে। সাড়ে সাতটা বেজে গেলেও সায়ন্তনের গাড়ি তাই রবীন্দ্রসরোবর মেট্রো স্টেশন ক্রশ করে সোজা টালিগঞ্জ ফাঁড়ির দিকে না এগিয়ে যাদবপুর থানায় যাওয়ার রাস্তাটা ধরল। সেখানে ঋজুর কেবিনে কিছুক্ষণ আগে থেকে বসে রয়েছে জিত।
সাউথসিটি মলের আরও কয়েকটা সিসিটিভি ফুটেজ দেখার পরে দুপুরেই ঋজু একটা ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হয়ে গেছিল। তারপরেই বন্ধুদের সাথে ফোনে কথা বলতে শুরু করে সে। কিছু ইনফরমেশন পেয়ে ঋজু বুঝে গেল, আজো অমিত ওর প্রেয়সীর সাথে দেখা করবে। নেটওয়ার্ক চালু করতে দেরী করেনি। অমিতদেরে বিল্ডিং এ যে ছেলেটাকে নজরদারীর জন্য ফিট করেছিল, সে জানালো সকাল থেকে অমিত কোথাও বেরোয়নি। ফ্ল্যাটেই আছে। যে খবরটা এরপর আশা করছিল ঋজু সেটাও পেল অল্প সময় পরেই। লম্বা, ফর্সা, ছিপছিপে চেহারার রীতিমত সুন্দরী এক বিবাহিতা মহিলা অমিতের ফ্ল্যাটে ঢুকেছে। ছেলেটার দেওয়া মহিলার চেহারার বর্ণনা হুবহু মিলে গেল সিসিটিভি ফুটেজে দেখা ঋজুর পরিচিতা নারীটির চেহারার সাথে। শেখরের বেটার হাফ, মেঘা! শেখরেরই ছোটবেলার বেস্ট ফ্রেণ্ড অমিতের সাথে পরকীয়ায় লিপ্ত। মন্দারমনি আর শান্তিনিকেতনে অমিতকে মেঘার সাথে বেশ কোজি হতে দেখেও ঋজু খুব একটা আমল দেয়নি। কিন্তু আজ আর ব্যাপারটা হাল্কা ভাবে নিলে হবে না তো! শিওর হওয়ার জন্য মেঘার নাম্বারটা মোবাইল ট্র্যাকারে দিয়ে দেখল। অব্যর্থ।
ঋজুর কেবিনে শ্মশানের নিস্তব্ধতা। ফোন করে সবাইকে ডেকে যাবতীয় প্রমাণাদি দেখিয়েছে ঋজু। শেখরের দিকে তাকানো যাচ্ছে না।
-“যাই” চেয়ার ছেড়ে উঠল শেখর।
-“তুই অমিতকে কিছু বলবি না?” সায়ন্তন কড়া গলায় জানতে চাইছে।
-“কি বলব ওকে। আমার বাড়ীর লোকই তো ঠিক নেই!” গলাটা হঠাৎ যেন ভেঙ্গে গেছে শেখরের। আওয়াজই আসছে না।
-“না, ব্যাপারটা এভাবে দেখলে হবে না। আজ তোর ঘরে নজর দিয়েছে হারামিটা। কাল আমাদেরও ঘরেও ওঁর কুনজর পড়বে।” জিত বেশ উত্তেজিত। অমিতকে সামনে পেলে মেরেই দেবে হয়ত।
-“হ্যাঁ, ঠিক বলেছিস। অমিত এখন আমাদের সবার কাছেই মুর্তিমান থ্রেট।” সায়ন্তন সমর্থন করল জিতকে।
-“ওকে একাজের জন্য শাস্তি পেতেই হবে।” এতক্ষণ চুপ করে থাকার পরে ঋজুর ঠাণ্ডা গলা শোনা গেল। সবাইকে অবাক করে ঋজু বলছে, “সে ব্যবস্থাও হয়ে গেছে। আমার পরিচিত খুচরো এক পাপীকে কাজে লাগিয়ে দিয়েছি। এতক্ষণে সে হয়ত অমিতের ফ্ল্যাটে পৌঁছে গেছে।”
শেষ অব্ধি
ভায়ের সাথে ঝগড়া করে ভবানীপুরের বাড়ী থেকে বেরোনোর সময় মৃগাঙ্কবাবুর মুখের বিরক্তিটা টালিগঞ্জ ফাঁড়িতে অটো থেকে নেমে মিলিয়ে গেল। ছেলে যেমনই হোক, কাছে গেলে মন ভাল হয়ে যায় ওনার। সুমনার মৃত্যুর পরে ঘরের প্রতি বেশ টানও হয়েছে অমিতের। এবার একটা বিয়ে দিয়ে দিলেই তিন কামরার এই ফ্ল্যাট বেশ ভরা ভরা লাগবে। ওঁর সাথে গল্পগুজব করার এক সাথীও জুটবে।
লিফট থেকে নেমে ফ্ল্যাটের দিকে এগোতে এগোতে মনটা খুশি হল মৃগাঙ্কর। ছেলেকে জানাননি, যে চলে আসছেন। ভবানিপুর থেকে ওঁর আগামীকাল ফেরার কথা। আজ দেখে অমিত খুব অবাক হয়ে যাবে নিশ্চই।
ফ্ল্যাটের দরজায় এসে যা দেখলেন, মাথা ঘুরে পরেই যাচ্ছিলেন মৃগাঙ্ক। দরজা খোলা, মেঝেতে পড়ে রয়েছে অমিত। জ্ঞান নেই। মাথার পাশে থেকে রক্তের একটা সরু ধারা লবিতে এসে শেষ হয়েছে। জোয়ান ছেলের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লেন বৃদ্ধ মানুষটি। নাকের তলাতে হাত দিয়ে প্রাণ আছে কিনা যাচাই করতে!
-“ঋজু, বিরাট বিপদ হয়ে গেছে বাবা। অমিত সীরিয়াসলি ইনজিওর্ড। ফ্ল্যাটে কেউ এসে মেরেছে ওকে। তুমি কি আসতে পারবে?” মৃগাঙ্ক যখন ব্যাকুল স্বরে ঋজুকে পাশে চাইছেন সেইসময় ওর বাঁশদ্রোনীর ফ্ল্যাটের দরজায় দাঁড়িয়ে শেখর ভাবছিল, অমিত না হয় পানিশমেন্ট পেল। কিন্তু মেঘার পানিশমেন্টের কি হবে! টুবলুর মুখ চেয়ে মেঘার সাথে বাকি জীবন কাটানোর কথা ভাবতেই শিউড়ে উঠল সে।
-সমাপ্ত-
Be the first to comment