তপন মল্লিক চৌধুরী : গত ২৫ আগস্ট থেকে রোহিঙ্গাদের ওপর ফের শুরু হয়েছে তাণ্ডব। রাখাইন প্রদেশ অর্থাৎ মায়ানমারের যেখানে রোহিঙ্গাদের বসবাস, সেখানে তাদের ওপর নামানো হয়েছে অমানবিক অত্যাচার। বাচ্চা থেকে বুড়ো, মরদ, আওরত কেউই রেহাই পায়নি এই বর্বরোচিত অত্যাচারের হাত থেকে। রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় ঘর-বাড়ি থেকে শুরু করে মানুষ যে আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে, তা দেখা গেছে রাষ্ট্রপুঞ্জের উদ্যোগে প্রচারিত উপগ্রহ চিত্রে। রাষ্ট্রপুঞ্জ থেকে শুরু করে অন্য সব সংস্থার ওষুধপত্র ও অনুদান সেখানে ঢোকা বন্ধ হয়ে গছে। গত ২৫ আগস্ট থেকে ১০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে আনুমানিক আড়াই-তিন লক্ষ রোহিঙ্গা মায়ানমার ছেড়ে ভারত, বাংলাদেশের নানা জায়গায় চোরের মতো আস্তানা খুঁজেছে ও নিরুপায় আশ্রয় নিয়েছে। এটাই তো প্রথম নয়, বহু বছর ধরেই রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার ও আঘাত জারি রয়েছে। রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনার যে আক্রমণ ও নিপীড়নকে ‘জেনোসাইড’ বা গণহত্যা এবং ‘এথনিক ড্রেনজিং’ বা জাতি বিলুপ্তিকরণ বলে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় সমালোচনা করেছেন। রোহিঙ্গাদের ওপর দমনপীড়ন নেমেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন জাপানিরা ব্রহ্মদেশ দখল করে নিলে। ১৯৪২ সালের ২৮ মার্চ রাখাইন জাতীয়তাবাদীরা অতর্কিত আক্রমণ শানায় মিনব্যাও স্রোহৌং শহরে। রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এই দুই অঞ্চলে মারা পড়েছিল প্রায় হাজার পাঁচেক মানুষ, অসংখ্য মহিলা হয়েছিল গণধর্ষণের শিকার। জাপানি সৈন্যদের সাহায্য নিয়ে রাখাইনরা রোহিঙ্গা গ্রামগুলিতে নাগাড়ে খুন, ধর্ষণ, লুঠতরাজ চালাতে থাকলে প্রায় বাইশ হাজার রোহিঙ্গা ব্রিটিশ ভারতে শরণার্থী হয়। এরপরও বার্মিজ ও জাপানি সৈন্যদের বর্বরতার শিকার হয়ে প্রায় চল্লিশ হাজার রোহিঙ্গা চট্টগ্রামে আশ্রয় নিয়েছিল।
রোহিঙ্গাদের ওপর ভয়ংকর দমনপীড়ন চলে আসছে বার্মিজ মিলিটারি জুন্টা সরকারের আমল থেকে। বারবার সরকার, সামরিক বাহিনী ও সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর অমানবিক আক্রমণে জেরবার হতে হয়েছে রোহিঙ্গাদের। ১৯৭৮ সালে ‘নাগামিন’ বা ‘ড্রাগন কিং’ অপারেশনের সময় প্রায় দু-লক্ষ রোহিঙ্গা পালিয়ে গিয়ে বাংলাদেশে শরণার্থী হয়েছিল। দেখা গেছে বার্মিজ সেনাবাহিনীর পরিকাঠামোগত উন্নয়নে, বিভিন্ন প্রকল্পগুলিতে প্রত্যেকবারই অত্যন্ত নিকৃষ্টমানের খাদ্যের বিনিময়ে এবং বিনা পারিশ্রমিকে গতরে খেটেছে রোহিঙ্গারা। আর তারপরই প্রাপ্য হিসেবে জুটেছে অত্যাচার, ধর্ষণ, লুঠপাট। এইভাবে ১৯৯১ সালেও প্রাণ বাঁচাতে প্রায় আড়াই হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী হয়। ১৯৯৭-এর জুলাই, ১৯৯৮-তেও রোহিঙ্গাদের ওপর বর্বর আক্রমণ নেমেছিল। বাংলাদেশ ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে কয়েক হাজার রোহিঙ্গা থাইল্যান্ডে শরণার্থী হয়েছে। তাদের অনেককেই ধরে বেঁধে জাহাজে তুলে মাঝ সমুদ্রে নিয়ে গিয়ে ফেলে দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে থাই সরকারের বিরুদ্ধে। অভিযোগ রয়েছে থাই সেনার বিরুদ্ধেও, বেশ কয়েকবার নৌকায় শরণার্থী বোঝাই করে জাহাজ দিয়ে মাঝ সমুদ্রে নিয়ে ছেড়ে দিয়ে আসার। অভিযোগ অস্বীকার করতে পারেননি প্রধানমন্ত্রীও। এরপরও রোহিঙ্গা শরণার্থীদের গায়ে চোর, ডাকাত, সন্ত্রাসবাদী ইত্যাদি অপবাদ তো লেগেই আছে।
মিলিটারি জুন্টার শাসনে রোহিঙ্গাদের ওপর যেমন দমনপীড়ন চালিয়েছে, সে দেশের সংবাদমাধ্যমও ইন্ধন জুগিয়েছে ধারাবাহিক খুন, রাহাজানি, গণধর্ষণ, লুঠ ও সংখ্যালঘুদের প্রতি তীব্র ঘৃণা-বিদ্বেষ জাগাতে। তাদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণে এবং রোহিঙ্গাদের চোর-ডাকাত-সন্ত্রাসবাদী বলে দেগে দিতে। ২০১২ সালের জুলাই মাসে মায়ানমারের একটি দৈনিক সংবাদপত্র এক বৌদ্ধ মহিলার শ্লীলতাহানি ও হত্যার অভিযোগে তিন রোহিঙ্গা যুবকের গ্রাফিক্স ছবি ছেপে দেয়। এরপরই রোহিঙ্গাদের ওপর নেমে আসে চরম নির্যাতন, পরিণতি দাঙ্গা। বার্মিজ অন্যান্য সংবাদমাধ্যমগুলিও রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ‘আল কায়দার চর’ এবং ‘অবৈধ বাঙালি সন্ত্রাসবাদী’ আখ্যা দেয়। ওইসব সংবাদ প্রচারের বিরোধিতা করে বিবিসি এবং ‘ডেমোক্রেটিক ভয়েস অব বার্মা’ তীব্র সমালোচনা করে। প্রতিক্রিয়ায় রাষ্ট্রপতি থেইন মেইন-এর আদেশ অনুসারে দেশের সেন্সরশিপ আইন প্রয়োগ করে ওই সংবাদপত্র প্রকাশ বন্ধ করে দেয়। রোহিঙ্গাদের ওপর ঘৃণার বিষ মায়ানমারের সর্বস্তরেই বিরাজ করছে। কখনও সামরিক বাহিনী সমর্থিত ইউএসডিপি-র নেতারা সরকারকে ‘কিং ড্রাগন অপারেশন’-এর কায়দায় সেনা অপারেশনের পরামর্শ দিয়েছে কখনও সরকারি মন্ত্রী-আমলারা রাখাইনে জরুরি অবস্থা জারি করার জন্য চাপ সৃষ্টি করেছে।
মায়ানমার সরকার ১৯৮২ সালে আইন করে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব মূল-সহ উৎপাটন করে দিয়েছে। কেবলমাত্র তাই নয়, মায়ানমার সরকার রোহিঙ্গা নামটাও মানে না, তাদের বলে ‘বাঙালি’, বাংলাদেশ থেকে আসা বেআইনি অনুপ্রবেশকারী। ওদিকে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের তাদের দেশের নাগরিক মানতে চায় না। তাদের বক্তব্য, রোহিঙ্গারা মায়ানমার থেকে পালিয়ে এসে সেদেশে আশ্রয় নিয়েছে। ভারত সরকারের বক্তব্যও পুরোপুরি একরকম। দেশের নানা জায়গায় এই মুহূর্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা রোহিঙ্গাদের সংখ্যা প্রায় চল্লিশ হাজার। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক তাদের উৎখাত করবে বলে ঠিক করেছে। যদিও দেশের সর্বোচ্চ আদালত প্রশ্ন তুলেছে কেন রোহিঙ্গাদের ভারত ছেড়ে যেতে হবে? প্রশ্ন তুলেছে মানবাধিকার কমিশন। কিন্তু সরকারের বক্তব্য, তারা বেআইনিভাবে এদেশে ঢুকেছে। মায়ানমার রোহিঙ্গাদের টেররিস্ট আখ্যায়িত করেছে। তাদের কথা অনুযায়ী, ২৫ আগস্ট আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি নামের একটি জঙ্গি দলের আক্রমণে প্রাণ হারিয়েছে বেশ কিছু পুলিশকর্মী। ওই আর্মির হাত ধরেছে লস্কর-ই-তৈবা। ভারত সরকারও এখন ওই সুরে তাল মেলাতে চাইছে। অবাক হতে হয় নোবেল শান্তি পুরস্কারপ্রাপ্ত সান চু কি-র ভূমিকায়। মানবাধিকারের জন্য লড়াকু সু চি রোহিঙ্গাদের এই মরণাপন্ন সংকটে যখন এড়িয়ে চলার নীতি অবলম্বন করে বলেন, রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন আছে। প্রশ্ন জাগে কেন তিনি সেই প্রশ্নকে মানবিক ও নৈতিকভাবে সমাধান করছেন না। কেন তিনি কোফি আন্নান ফাউন্ডেশনের সমীক্ষা অগ্রাহ্য করে রোহিঙ্গাদের অনবরত সন্ত্রাসের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। তিনিই তো রাষ্ট্রপুঞ্জের ভূতপূর্ব মহাসচিবকে রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতি নিয়ে সমীক্ষার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। অন্যদিকে রাষ্ট্রপুঞ্জ থেকে ভারতে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের একটা অংশকে পরিচয়পত্র দিয়েছিল। কিন্তু মোদী সরকার সেই পরিচয়পত্রের দায় স্বীকার করে নিতে নারাজ। কারণ, উদ্বাস্তু সংক্রান্ত রাষ্ট্রপুঞ্জের সনদে ভারত সাক্ষর করেনি। ভাবতে অবাক লাগে, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পঞ্চাশ-ষাটের দশকে তিব্বত থেকে, সত্তরের দশকে তৎকালীন পূর্ববাংলা থেকে মানুষ এসে আশ্রয় নিয়েছিল। শরণাগতকে প্রত্যাখ্যান না করে আশ্রয় দেওয়াই যে দেশের পরম্পরা, সেই দেশ এখন রোহিঙ্গাদের বিতাড়ন করতে উদ্যত। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, রোহিঙ্গারা যদি মুসলমান না হয়ে অন্য কোনও সম্প্রদায়ের মানুষ হত, তাহলেও কি উৎখাত করতে ভারত সরকারের এই তৎপরতা দেখা যেত? যুগের পর যুগ ধরে ধর্ষণ, লুঠ, খুন, রাহাজানির শিকার হতে হতে বাস্তুহারা, দেশহারা, পরিচয়হারা, সহায়সম্বলহীন মানুষ খ্যাপা কুত্তা না হয়ে উগ্রবাদী ‘জঙ্গি’, ‘টেররিস্ট’ তকমা পাওয়াটাও কি সেই মুসলমান সম্প্রদায় বলেই?
Be the first to comment