দীপক আঢ্য:
পুরীর স্বর্গদ্বার থেকে আরও মিনিট দশেক সামনে হাঁটলে ‘কোজি গেস্ট হাউস’। প্রায় চার শতক জমির উপর চার তলা বাড়ি। সাইন বোর্ডটি এখনও যথেষ্ট ঝাপসা। কোজি গেস্ট হাউসের পাশে ফার্স্ট ব্রাকেটে ছোট ছোট করে লেখা ‘থ্রি স্টার’।
কি এক অজ্ঞাত কারনে প্রায় দু বছর গেস্ট হাউসটি বন্ধ থাকার পর মামলা-মোকদ্দমা সেরে মালিকের হাত পালটে গেস্ট হাউসটি লিস নিয়েছেন সচিন সেন। কলকাতা আর দীঘাতেও তার হোটেলের ব্যাবসা। অনীক দত্ত সচিন সেনের ভাগ্নে। এতদিন দীঘার ব্যাবসাটা সে একাই সামলাতো। সদ্য লিস নেয়া কোজি গেস্ট হাউসটিকে কেন্দ্র করে মামা-ভাগ্নের আগ্রহ যেন চরমে। লিস রেজিস্ট্রি হওয়ার পর দিনই অনীক চলে আসে পুরীতে। এর আগেও মামা-ভাগ্নে দু বার এসে সরজমিনে দেখে গিয়েছে গেস্ট হাউসের হালচাল। দীর্ঘ দু বছর বন্ধ থাকার ফলে ঘর বাড়ির অবস্থা অনেকটাই মলিন। একে পুরাতন অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে গেলে বিভিন্ন জায়গায় রঙকরা, প্লাস্টার করা, নতুন করে কিছু প্লাম্বিং এর কাজ করা অর্থাৎ ডেকোরেশনের পুরো ব্যাপারটা ঢেলে করতে হবে। এছাড়া গেস্ট হাউসের খুঁটিনাটি যা যা আছে তা শেষ করতে প্রায় একমাস সময় তো লাগবেই। দূরদর্শী সচিন সেন তাই দীঘার হোটেলে নতুন ম্যানেজার ঢুকিয়ে অনীক কে পাঠিয়ে দিয়েছে পুরীতে। অভিজ্ঞ অনীকও জানে তার আশু কর্তব্য। মামারও ভাগ্নের প্রতি অগাধ আস্থা।
অনীক দত্ত। বয়স বত্রিশ। ডন দেয়া পেটানো চেহারা। অত্যন্ত মার্জিত। এক কথায় সুপুরুষ। আজ বারো দিন হল সে এই গেস্ট হাউসে উঠেছে। সারাদিন বিভিন্ন রকম মিস্ত্রিদের কাজ দেখভাল করা, দীর্ঘ দিনের অব্যবহারের ফলে পড়ে থাকা ফ্যান টিভি এসি এসব ফের সচল করার কাজ দেখে নেয়া ছাড়াও রাত্রে দু-চার জনের সাথে সাখ্যাত করা- আলোচনা করা আরও কত কী এখন অনীকের নিত্য দিনের কাজ।
হোটেল গেস্ট হাউসের ব্যাবসা মানেই সে তল্লাটের কিছু মানুষের মন জুগিয়ে চলা। এরা যে সব সময় স্থানীয় নেতা কিম্বা মস্তান তা না—অনেকটা দালাল শ্রেণীর। আনীক জানে এদেরকে উপেক্ষা করে ব্যাবসা করা যায় না। তাই যতটা সঙ্গত রেখে চলা যায় ততই তার পক্ষে ভালো।
কোলকাতা থেকে আসার সময় রমেন বৈদ্য নামের মাঝ বয়সি এক জনকে নিয়ে আসে অনীক। দীঘার হোটেলে সে রান্নার কাজে সহযোগিতা করতো। নিজেও রান্না করে। তবে সে রান্না অন্যদের মুখে দেওয়ার প্রয়োজন হচ্ছেনা বলেই ওদের দুজনের চলে যাচ্ছে বেশ।
ঘড়িতে ঘণ্টার কাঁটা আর মিনিটের কাঁটা পাঁচটার ঘর পার করে এক হয়ে আছে। পশ্চিম আকাশ লাল টকটকে হয়ে উঠেছে। এক্ষুনি যদি কোন নার্সারি স্কুলের ছাত্রকে জিজ্ঞাসা করা হয়, ‘বলতো সমুদ্রের রঙ কি?’ সে নির্ভুল ভাবে উত্তর দেবে, ‘লাল’। সমুদ্র পাড়ের বালি যেন এখনও নিভন্ত ছাইয়ের থেকে ওঠা বালির মতো ধিক ধিক করে উষ্ণতা ছড়াচ্ছে। সমুদ্র দেখতে আসা মানুষগুলো একে একে আসতে শুরু করেছে বীচে। মশলা মুড়ি বিক্রেতারা এক-দু জন হাঁকছে খরিদ্দারের উদ্দেশ্যে। দুটো বার-তের বছরের মেয়ে হাতে শঙ্খের চেন নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে দূরের কোন এক টুরিস্ট পার্টির দিকে।
অনীক রঙ মিস্ত্রির দৈনিক পারিশ্রমিক মিটিয়ে ফ্রন্ট অফিসের চেয়ার ছেড়ে উঠতেই রমেন বৈদ্য হাজির। সে একটু ইতস্তত করতেই অনীক জিজ্ঞাসা করে, “কিছু বলবেন রমেন দা?”
-হ্যাঁ, বলছিলাম আজ রাতের ট্রেনে বাড়ি যেতে হবে। একটু আগেই ফোন এসেছিল। তোমার বৌদি সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে পা ভেঙেছে। এখন হাসপাতালে ভর্তি। আরও কি সব হয়েছে আমাকে ফোনে মনে হয় ঠিকঠাক বলল না।
‘ও… তাই!’ বিস্ময়ের সাথে অনীক উত্তর দেয়। ‘তাহলে তো আপনাকে এই চালু ট্রেনেই উঠতে হবে। এতটা পথ…। পারবেন তো শরীরে এত ধকল নিতে?’
-ও সব পারবো… ওসব নিয়ে ভাবছিনা। যদি যাওয়ার সময় কিছু টাকা পয়সা…।
-হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চয় পাবেন। দেব আমি। আপনি ভিতরে আসুন।
অনীক পেমেন্টের খাতায় রমেন বৈদ্যর সই নিয়ে হাতে তিন হাজার টাকা তুলে দিল।
-কী বলে যে তোমায় ধন্যবাদ জানাবো…
-না, না, ঠিক আছে। বাড়ি গিয়ে একটা ফোন করবেন। সবাই কেমন আছে জানাবেন। রমেন বৈদ্য ঘাড় কাত করে বেরিয়ে গেল।
রমেন বৈদ্য চোখের আড়াল হতেই কেমন যেন নিঃসঙ্গ অনুভব করল অনীক। হাজার হলেও এমন বিদেশ-বিভুইএ এক ছাদের তলায় গভীর রাত পর্যন্ত বকবক করতে করতে কাটিয়ে দেওয়া মানুষটাকে ছেড়ে আজ যে একা থাকতে হবে। এই ভাবনাই আরও নিঃসঙ্গ করে তুলল অনীককে।
সন্ধে পার করে কাকাতুয়ার ডান দিকে যে চায়ের দোকান আছে, অনীক জানে সেখানে গেলেই দেখা হয়ে যাবে স্থানীয় সব দালাল গুলোর সাথে। সেই মোতাবেক প্রায় সাত টার সময় সেখানে হাজীর অনীক। পরিমল, জাটুয়া, সন্তোষ সকলেই আছে। অনীক জানে এরা সকলেই এক একটা জিনিস। কেবলমাত্র পুলিশি ঝামেলার ভয়ে এক সাথে থাকে। একটু সুযোগ পেলেই একে অপরের কপালে বন্দুকের গুলি ঠুকে দেবে তো কোন সময়ই নেবেনা। অনীক ওদের সবাইকে সমীহ করে চলে। সে জানে ও যদি ওদেরকে সমীহ না করে তাহলে ওর ব্যাবসা গনেশ পুজো হওয়ার আগেই বন্ধ হয়ে যাবে। তাই ওদের তোয়াজ করাই শ্রেয়।
রাত সাড়ে নটা নাগাদ অনীক ফিরে আসে গেস্ট হাউসে। পথ প্রায় শুনশান। স্বর্গদ্বারে একটা প্রায় শেষ হয়ে যাওয়া চিতার পাশে জনা তিনেক জোয়ান। হাতে লাঠি। খালি গা। হলুদ আগুনের আভায় দূর থেকে তাদের অতি প্রাকৃতিক কোন জীব ছাড়া আর অন্য কিছুই মনে হয় না। সকল হোটেলগুলোর জানলা থেকে আলো ঠিকরে বেরোচ্ছে। বাঁ দিকে সমুদ্রের গর্জন আর নির্জন বীচের উপর আছড়ে পড়া ঢেউ দেখতে দেখতে কোজি গেস্ট হাউসের সামনে এসে দাঁড়ায় অনীক। পকেট থেকে চাবি বের করে সদর গেট খোলে। সুইচ অন করতেই গেস্ট হাউস আলোকিত হয়ে ওঠে- যেন গভীর রাত্রে হঠাৎ জেগে ওঠা এক বাড়ি। অনীক নিজের ঘরে ঢোকে। অ্যটাচড্ বাথরুমে গিয়ে শাওয়ার ছেড়ে স্নান করে বেডে আসে।
নিজেকে খুব ফ্রেশ লাগে অনীকের। এসি অন্ করে। সামনে রমেন দা রাতের খাবার ঢাকা দিয়ে রেখে গেছে। খাবারের টেবিলটা টেনে কাছে আনতেই দু তলার উপরে মানুষের দৌড়নোর আওয়াজে হঠাৎ গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে অনীকের। মুহূর্তে আওয়াজ বিলীন হয়ে যায়। বন্ধ ঘরে নিজের নিঃশ্বাস আর এসির নরম বাতাসের শব্দ ছাড়া সব কিছুই অশ্রুত মনে হয় তার কাছে। কোন ক্রমে রাতের খাবার শেষ করে বেসিনে হাত ধুতে গিয়ে টের পায় বেসিনের কল জল শূন্য। বিস্মিত হয় অনীক। একটু আগেই স্নান করে এসেছে। সকালে ফুল ট্যাঙ্ক জল ভরা। তেমন কোন খরচ হয়নি। নিশ্চয় কোন এক কমোটের সিস্টার্ন দিয়ে জল বেরিয়ে গিয়েছে- ভাবতে থাকে অনীক। নীচে রাখা খাওয়ার জল দিয়ে হাত মুখ ধোয়। ট্যাঙ্কের সব জল চলে যাওয়াটা কেমন যেন অস্বস্তিতে ফেলে অনীককে। ঠিক সেই মুহূর্তে আবারও একটু আগের দৌড়ানোর আওয়াজ শোনা যায়। অনীক কান খাঁড়া করে শোনে। সারা শরীরের লোমকূপ ভয়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। স্পষ্ট পায়ের আওয়াজ। কারা দৌড়ায়? মনে হয় একাধিক জন। আজ সারাদিনে উপর তলায় কোন কাজ হয়নি। গেট তো নিশ্চিত ভাবেই বন্ধ। তাহলে ওরা উঠলো কোথা দিয়ে? কারাই বা উঠলো? ভাবতে ভাবতে ড্রয়ার থেকে বড় টর্চ লাইট বের করে নিজের ঘরের দরজা খোলে অনীক। পা দুটো যেন ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে যাচ্ছে। অসম্ভব ভারী মনে হচ্ছে নিম্নাঙ্গ। তবুও বুকে সাহসের সঞ্চার করে এগিয়ে যায় অনীক। দো তলার সিঁড়ির লাইট জ্বালে। হ্যাঁ, গেট পূর্ববৎ বন্ধ। তাহলে কীসের আওয়াজ? দো তলার গেট খুলে উপরে ওঠে অনীক। টর্চ লাইটের আলোয় এদিক ওদিক দেখতে থাকে। সম্পূর্ণ ফাঁকা। খা খা করছে চতুর্দিক। না। নিশ্চয় ওর কোন ভ্রম। ভাবতে থাকে অনীক। রমেন দা আজ না থাকায় এত বড় বাড়িতে সে নিজের অজান্তেই ভয় পুষে ফেলেছে মনে। নিজেকেই নিজে বোঝাতে থাকে। সাহস নিয়ে আসার চেষ্টা করে নিজের মনে।
হঠাৎ যেন ভাবনার বিচ্ছেদ ঘটে। সেই একই দৌড়নোর শব্দ স্পষ্ট ভাবে কানে আসে তিন তলার ছাদ থেকে। এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করেনা অনীক। তারও মনে রহস্য আবিষ্কারের নেশা চেপে বসেছে। দ্রুত সে ও দুতলার সিঁড়ি বেয়ে ওঠে। টর্চের তীব্র আলোয় সব সাদা আর ফাঁকা। মানুষ তো দূর কোন কীট পতঙ্গের চিহ্ন পর্যন্ত নেই। দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে ওঠার ফলে হাঁপাতে থাকে অনীক। তার নিজের নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের আওয়াজ তার নিজের কানেই কেমন অচেনা শোনায়। দূরে সমুদ্রের গর্জন রাতের নিস্তব্ধতাকে যেন খান খান করছে। হঠাৎ লোড শেডিং । কয়েক সেকেন্ডের জন্য আলোকময় চতুর্দিক গাড় অন্ধকারে ঢেকে গেল। মুহূর্তে শীতল হয়ে এল অনীকের শরীর। দর দর করে ঘাম ঝরছে তার সর্বাঙ্গে। রাস্তার আলো নিভে গেছে। প্রায় সব হোটেল গুলো জেনারেটরের আলোয় আগের মতই আলোকিত। ‘কোজি গেস্ট হাউস’ এখনও চালু হয়নি বলে এখানে এখনও জেনারেটরের সার্ভিস শুরু করেনি অনীক। এই গেস্ট হাউসের প্রত্যেক বারন্দা থেকে আকাশ- সমুদ্র সব স্পষ্ট দেখা যায়। অনীক আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখে একটা তারারও দেখা নেই। মাঝে মাঝে বিদ্যুত চমকাচ্ছে। তার আলোর চ্ছটা এতই ক্ষীণ যে বোঝায় যাচ্ছেনা। হঠাৎ মনে পড়ল আজ সকালে উড়ে ব্রাহ্মণ , যে দু টাকার প্রাত্যহিক পুজো করতে আসে , গনেশের ছবিতে ফুল চড়ায় , আর কপালে তিলক কেটে দেয় সে বলেছিল, ‘আজ মঙ্গল বার। মুখ্যচান্দ্র বৈশাখ শুক্লপক্ষ। রেবতী নক্ষত্রের রাত। এসব দিন ভালো না বাবু। আপনারা শহুরে মানুষ। এসবে তো বিশ্বাস নেই। একা একা থাকবেন না বাবু।’
অনীক হেসেছিল এ সব কথা শুনে। কথা বাড়ায় নি উড়ে ব্রাহ্মণের সাথে।
মুহূর্তে আবার একই আওয়াজ চার তলার ছাদে। আওয়াজ যেন আরও তীব্রতর হয়ে উঠেছে। অনীক নিঃসংশয় হয়। কিছু একটা আছেই ছাদে। তার মনে হতে থাকে এতক্ষণ ছাদের এই আওয়াজ তার ভ্রমবশত কখনো দু’তলা বা কখনো তিনতলার মনে হয়েছিল।
আর কালক্ষেপ না করে চার তলার ছাদে পা বাড়ায় অনীক। ছাদের সিঁড়ির কাছে আসতেই থমকে দাঁড়ায়। ছাদের গেট খোলা। সিঁড়ির দরজা দিয়ে হু হু করে বাঁ দিকের সমুদ্র থেকে বাতাস আসছে। ঘামে ভেজা দেহে সে বাতাস লাগতেই শরীর ঠাণ্ডা হয়ে এল অনীকের। সিঁড়ি দিয়ে ছাদের কাছে যেতেই অনীকের যেন দম বন্ধ হয়ে এল। ভয়ে আতঙ্কে নিজের পায়ের উপর ভর দিয়ে দাঁড়াতে সাহস হল না তার। অবিশ্বাস্য ভাবে তাকিয়ে দেখল ছাদের এক প্রান্তে পিছন ফিরে বলিষ্ঠ চেহারার জটাধারী কোন সন্যাসী হোম করছে। তার আগুনের শিখা সমুদ্রের বাতাসের তাণ্ডবে লকলক করছে। আর সেই হোম শিখাকে কেন্দ্র করে দাঁড়িয়ে আছে স্বর্গদ্বারের চিতার পাশে লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে থাকা সেই তিন জোয়ান। অনীক আরও একটু এগিয়ে যায়। ভাবতে থাকে,ওরা কারা? কি ভাবে এলো এই ছাদের উপরে? কীসের যজ্ঞ করছে ওরা? হাজারও প্রশ্ন ভিড়ে আসে অনীকের মাথায়।
অনীক আরও একটু এগিয়ে যেতেই ওই তিন জোয়ানের চোখ পড়ে অনীকের উপর। চোখের নিমেষে তারা এগিয়ে আসে অনীকের কাছে। অনীক ভয়ে আতঙ্কে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে। তারা যত অনীকের কাছে এগিয়ে আসে অনীক পিছিয়ে যেতে থাকে ক্রমশ। হঠাৎ অনীকের মনে হতে থাকে, এরা মানুষ নয়- অন্য কিছু- মানুষের অবয়বের মধ্যে বীভৎস চাউনি- যেন এক্ষুনি কেড়ে নেবে বুকের ভিতর থেকে প্রাণ ভোমরা। অনীক চেষ্টা করে ওদের স্পর্শ থেকে নিজেকে বাঁচাতে। আরও পিছনে সরতে সরতে ক্রমশ ছাদের কার্নিশের কাছে চলে আসে। তিন জোয়ান এক সাথে হাত বাড়ায়। হঠাৎ অনীক উপলব্ধি করে কার্নিশের কিয়দংশ ভাঙা। নিজেকে আপ্রাণ চেষ্টা করে ওই লোকগুলোর হাত থেকে নিজেকে সরাতে। এক পলক পিছন ফিরে তাকায়। নীচে গাড় অন্ধকারে দেখা যায় না কিছুই। মুহূর্তে যেন পায়ের তলা থাকে কার্নিশের ভাঙা অংশ ধ্বসে পড়ে। কোন কিছু বোঝার আগেই অনীক পড়তে থাকে অন্ধকারে নীচে আরও নীচে।
******* *******
আস্তে আস্তে চোখ মেলে তাকায় অনীক।কতক্ষন নীচে পড়ে ছিল ঠিকঠাক বোধগম্য হয় না অনীকের।রাতের অন্ধকার আর নেই। সকাল সাতটা আটটা হবে বলে মনে হয়। চোখ মুখ মাথা সব ভিজে ভিজে লাগছে। মনে হচ্ছে কেউ বেশ করে জল দিয়ে ভিজিয়ে দিয়েছে। তার চারিধারে ঘিরে আছে অসংখ্য মানুষ। অস্পষ্ট ভাবে চিনতে পারে অনীক। তার সামনের দিকে পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে আছে পরিমল, জাটুয়া, সন্তোষ। আরও নিকটে রঙ মিস্ত্রি, রাজ মিস্ত্রি আর সব চেনা অচেনা মানুষের দল।
তাহলে সে কি এখনও বেঁচে আছে? নিজেকেই বিশ্বাস হচ্ছেনা অনীকের। চার তলার উপর থেকে আবার কেউ বাঁচে নাকি? না।কিন্তু ও তো সবাইকেই দেখতে পাচ্ছে। হ্যাঁ ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে মুখগুলো। ওই তো উড়ে ব্রাহ্মণ ঠিক তার হাঁটুর কাছে দাঁড়িয়ে ।কাল সকালে নিষেধ করেছিল একা একা থাকতে। কি সব স্বাতী নক্ষত্র না কি আগডুম বাগডুম বলছিল। অনীক বিশ্বাস করেনি এক বিন্দু। অসম্ভব ব্যাথা করছে তার ঘাড়, পিঠ, হাত, পা- সর্বাঙ্গ। কিন্তু চার তলা থেকে পড়ে ও বাঁচল কী ভাবে? হাত পা মাথা কোথাও তো ভাঙেনি মনে হচ্ছে- অনুভব করে অনীক। হ্যাঁ, মনে পড়েছে। কাল রাত্রে ছাদে… সেই তিন জোয়ান…তাকে ছুঁতে যাওয়ার সময়… তারপর সে পিছনে সরতে সরতে ছাদের কার্নিশ ভেঙে …ঠিক সেই সময় যখন সে শূন্যে তখন মরিয়া হয়ে কি যেন একটা ধরার চেষ্টা করেছিল সে ।হ্যাঁ, ঠিক ঠিক মনে পড়ছে। হোটেলের পশ্চিম দিক বরাবর সারি দেয়া বিশাল বিশাল দেবদারু গাছ। সেই বাঁচিয়েছে তার প্রান। নিজের ডান হাতটা টেনে মুখের কাছে আনতেই দেখতে পেল, এই তো হাতের কাছে চটকে যাওয়া সবুজ পাতার চিহ্ন এখনও লেগে আছে। তারপরে ও নিজে পড়েছেও সদ্য রেনোভেশনের কাজে এনে রাখা লাল বালির ঢিপির উপর। ইতি মধ্যে দু-এক জন তাকে ধরে তোলার চেষ্টা করল। অতি কষ্টে তাদের সাহায্যে উঠতে উঠতে অনীক দেখতে পেল বেশ মোটা একটা দেবদারু গাছের ডাল। বুঝতে পারল এটাকেই ভেঙে সাথে নিয়ে পড়েছে সে। বালির উপর আজস্র সবুজ দেবদারু পাতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। মনে মনে ধন্যবাদ জানায় ঈশ্বরকে- জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রাকে।
ঠিক তখনি অনীকের আবারও মনে পড়ল সত্যিই তো , কাল রাতে ছাদের উপর ওই লোক গুলো কারা? কীসের হোম যজ্ঞ হচ্ছিল ওখানে? কে করছিল ওই সব? ওরা উঠলও বা কোথা দিয়ে ছাদে? ওদের কথা মনে পড়তেই সারা শরীর যেন অবশ হয়ে আসে অনীকের। তবুও নিজের মনে জোর এনে নিজেকে বলল, ‘না, আমি এর শেষ দেখেই ছাড়ব। আমাকে জানতেই হবে আসল ঘটনা কী?’
আশেপাশের লোকেরা তাকে ধরাধরি করে নিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে তার আবারও নজর পড়ল উড়ে ব্রাহ্মণের দিকে। বেচারা কেমন যেন ঘাবড়ে আছে। মুখটা পাংশু বর্ণের। প্রত্যেক দিনের সহজ সরল উজ্জ্বলতা এই মুহূর্তে কোথায় যেন উবে গেছে। হোটেলের ঘরে যেতে যেতে ক্লান্ত চোখের ঈশারায় অনীক তাকে ভিতরে আসতে বলল। অনেকটা তেতো ওষুধ খাওয়ার মতো মুখ করে উড়ে ব্রাহ্মণ আসতে লাগল তার পিছুপিছু অত্যন্ত ধীর পায়ে।
অনীক কে ওরা ধীরে ধীরে খাটে শুইয়ে দেওয়ার পর অনীক ওদের সবাইকে চলে যেতে বলল। ওদের মধ্যে কে একজন বলল, ‘একটু ডাক্তার দেখিয়ে নেন বাবু। এত বড় ধাক্কা!’
-সে হবে। আমি ডাক্তারকে ফোনে ডেকে নিচ্ছি। তোমরা এখন যাও। পরে এসো।
লোকগুলো চলে যেতেই অনীক মুখোমুখি হল উড়ে ব্রাহ্মণের। সে উঠে বসার চেষ্টা করল। কিন্তু হাত-পা সব এত ব্যথা হয়ে আছে যে নিজের শরীরটাকে টেনে তুলতে পারল না।
‘ঠিক আছে। ঠিক আছে। আপনি শুয়ে শুয়ে কথা বলুন।’ উড়ে ব্রাহ্মণ বলল।
‘তুমি ওই টুল টা টেনে বস।’ ধীরে ধীরে বলল অনীক।
কথা না বাড়িয়ে সে টুলটা টেনে বসতেই অনীক জিজ্ঞাসা করল, ‘বল, তুমি সব জান। ওরা কারা?’
উড়ে ব্রাহ্মণ ভ্যাবাচাকা খেয়ে বলল, ‘কারা? আমি তো ঠিক বুঝলাম না।’
অনীক সংক্ষেপে আগের রাতের ঘটনা বলতেই উড়ে ব্রাহ্মণ চোখ বন্ধ করে বিড় বিড় করে কি সব মন্ত্র আওড়াতে লাগল। তারপর চোখ খুলে বলল, ‘ সে অনেক দিন আগেকার কথা। তা প্রায় বছর বিশ- পঁচিশ হবে। এই তল্লাটে তখন এত হোটেল ছিল না, এমন কি এই হোটেলও তৈরী হয়নি। এখানে ছিল ছোট্ট একটা এক চালা মন্দির। সে মন্দিরে নিত্য পুজো হত ভৈরবী মায়ের। পূজারী ঈশ্বর নিত্যানন্দ মহারাজ।’ পূজারী ঈশ্বর নিত্যানন্দ মহারাজের নাম বলতে বলতে দু বার নিজের কপালে হাত ঠেকিয়ে নিল উড়ে ব্রাহ্মণ। নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে বলতে লাগল , ‘বড় সাধক মহারাজ ছিলেন তিনি। কিন্তু তার তিন ছেলে ছিল সকল দোষের অধিকারী। লোভী, পাপিষ্ঠ। কোন এক মাড়োয়ারির কাছে এই হোটেল বাড়ি তৈরী হবে বলে এমন কি নিজেদের পূজারী পিতৃদেবকেও খুন করতে হাত কাঁপেনি তাদের। সবই আমারও শোনা কথা। সেদিনও না কি ছিল মঙ্গল বার। মুখ্যচান্দ্র বৈশাখ শুক্লপক্ষ। রেবতী নক্ষত্রের রাত। তিন ভাইয়ে মিলে স্বর্গদ্বারে দাহ করছিল তাদের বাবাকে। ঠিক তখনি আকাশের সব নক্ষত্র ডুবে যায়। রাতের অন্ধকার আরও গাঢ় হয়ে ওঠে। পশ্চিমাকাশে সঞ্চার হয় ঘন মেঘের। মেঘ ডাকে। বিদ্যুৎ চমকায়। হঠাৎ আকাশ চিরে কড় কড় আওয়াজে বরুন দেবতার খড়্গ যেন নেমে আসে তিন ছেলের উপর। স্বর্গদ্বারে বাবার চিতার পাশে লুটিয়ে পড়ে পূজারী ঈশ্বর নিত্যানন্দ মহারাজের তিন জোয়ান ছেলের প্রাণহীন দেহ। তার পর থেকে ফি-বছর ঠিক এই একই দিনে ঘটে অলৌকিক কিছু একটা। প্রাণ যায় কোন না কোন নিরীহ মানুষের।’
এতক্ষন এক নাগাড়ে এই সব কথা বলতে বলতে নিজের বিমর্ষ ভাব কিছুটা কাটিয়ে ওঠে উড়ে ব্রাহ্মণ। তারপর একটু থেমে আবার বলতে শুরু করে, ‘ এই হোটেলে এত ঘটনা ঘটেছে যে শেষের দিকে ভরা সিজিনের সময়েও এখানে টুরিস্টরা আসতে সাহস পেত না। শেষ বার তো কি এক খুনের মামলা রুজু হওয়ায় পুলিশ এসে সিল করে দিয়েছিল এই হোটেল। তারপর প্রায় দু বছর বন্ধ থাকার পর এ বছর আপনারা লিস নিলেন বাবু।’ কথা গুলো বলতে বলতে দুম করে টুল থেকে উঠে উড়ে ব্রাহ্মণ আলতো করে হাত দুটো চেপে ধরে অনীকের। বলে, ‘ আমি বামুন মানুষ। আর আপনি ছেলে মানুষ। এখনও বিয়ে থাওয়া করেন নি শুনেছি। আমি আপনারে অনুরোধ করছি বাবু, এ হোটেল আপনারা ছেড়ে দিন। এ হোটেল ব্যাবসার জায়গা না। এখানে ভৈরবী মার কোপ দৃষ্টি আছে। কূ দৃষ্টি আছে কাপালিকের আর ওর তিন ছেলের। এ ভৈরবী মার ভিটে। মা এখানে কাউকে ব্যাবসা করতে দেবেনা। দেবেনা ওই কাপালিকের আত্মাও। আজ এত বছর পরেও। শুধু আপনার কর্মফল আর জগন্নাথ দেবের আশীর্বাদ। তা না হলে আপনি কাল কী করে ফিরে এলেন নিশ্চিত মরনের মুখ থেকে আমি তাই ভাবছি সকাল থেকে। আপনি ফিরে যান, ফিরে যান বাবু কোলকাতায়।’
উড়ে ব্রাহ্মণের কথা শুনতে শুনতে অনীকের শরীর ঠাণ্ডা হয়ে আসে। এত বড় বিল্ডিং এ আর একা থাকার এক মুহূর্ত সাহস হয় না। আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করে, ‘আমি যদি আজকের রাতটা অন্য কোন হোটেলে কাটিয়ে দিই, ভয় নেই তো ঠাকুর মশায়?’
সমাপ্ত
Be the first to comment