দামোদর নদের তীরে বর্ধমান শহর। জৈন তীর্থঙ্কর বর্ধমান মহাবীর বর্ধমানে প্রথম এসে ধর্ম প্রচার করেন। সেই থেকে তীর্থঙ্করের নামে জায়গার নাম হয়ে ওঠে বর্ধমান। তবে, আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের সময় পার্থেনিসই নাকি আজকের বর্ধমান। আর আইন-ই-আকবরিতে মোঘল কালে বর্ধমান ছিল শরিফাবাদ। ১৫৬৭ সালে আধুনিকতার গোড়াপত্তন হয় সুলেমান কররানীর হাত ধরে। তৈরী করা হয় দুর্গ। আর ১৭ শতকে লাহোর (পাঞ্জাব) থেকে বর্ধমানে ব্যবসা করতে আসেন সঙ্গম রায়। রায় বংশের কৃষ্ণরাম রায় ঔরঙ্গজেবের ফরমান পেয়ে বর্ধমানের জমিদার হন। কৃষ্ণরামকে যুদ্ধে হারিয়ে বর্ধমান দখল করেন আফগান নায়ক রহিম খাঁ। দিল্লীশ্বর রহিম খাঁ কে সরিয়ে দিয়ে কৃষ্ণরামের ছেলে জগৎরামের হাতে বর্ধমানের দায়িত্ব তুলে দেন। আর এই রায় বংশই ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত রাজা খেতাব নিয়ে বর্ধমানে জমিদারি করে।
১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে লর্ড কার্জন বর্ধমানে আসেন। তাঁরই সম্মানে বর্ধমানেশ্বর বিজয়চাঁদ মহতার কার্জন গেট অর্থাৎ বিশাল তোরণ গড়ে তোলেন শহরের প্রাণকেন্দ্র জি.টি.রোডে। সুন্দর স্থাপত্যশৈলীর এই তোরণের শীর্ষে আছে দুটি সিংহ। কালে কালে নামান্তর ঘটে নির্মাতার নামেই তোরণটির নাম হয় বিজয়তোরণ। সংস্কারের পাশাপাশি বর্তমানে তোরণটিকে সুন্দর ভাবে আলো দিয়ে সাজানো হয়েছে। এর বিপরীত দিকে তৈরী হয়েছে ১৪০০ আসন বিশিষ্ট শীততাপ নিয়ন্ত্রিত হল নন্দন সংস্কৃতি লোকমঞ্চ। বিজয়তোরণ পেরিয়ে ১ কিলোমিটার যেতে ১৮৫১ সালে তৈরী হয় রাজপ্রাসাদ মহতাব মঞ্জিল। বর্তমানে তৈরী হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়। আর রানীমহলে উদয়চাঁদ গার্লস কলেজ তৈরী হয়েছে।
তাব্রিজ থেকে এসে মুসলিম ফকির পীর বাহারাম বর্ধমানের কাঞ্চননগরে পাকাপাকিভাবে বসবাস শুরু করেন। ১৫২৬ সালে তাঁর মৃত্যুর পর সমাধিস্থ হন ফকির সাহেব। তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে লোকের মুখে মুখে এলাকাটি আজ পীর বাহারাম নামে বিখ্যাত হয়ে উঠেছে। এই পীর বাহারামেই সমাধিস্থ রয়েছনে বর্ধমানের জায়গিরদার শের আফগান। মোঘল দরবারের সাধারন কর্মী আসফ খাঁর কন্যা মেহেরের প্রেমে পড়েন দিল্লীশ্বর আকবর তনয় সেলিম। পদমর্যাদার কারনে আপত্তি ওঠে সম্রাটের। ছল চাতুরী করে ছেলেকে ভোলাতে মেহেরের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে জায়গিরদার করে বর্ধমানে পাঠিয়ে দেন। এরপর দিল্লীর মসনদে অনেক পট পরিবর্তন হয়েছে। দিল্লীর মসনদে জাহাঙ্গীর নাম নিয়ে বসলেন যুবরাজ সেলিম। মেহেরকে সবসময় চিন্তা করতেন সম্রাট। নানা ছলা কলায় ব্যর্থ সম্রাট বাংলার সুবেদারকে পাঠালেন মেহের উদ্ধারে। সেলিম তথা জাহাঙ্গীরের মোঘল বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে পান গেলো শের আফগানের। আর তারপরই মেহের দিল্লীর দরবারের নুরজাহান হন। সেই শের আফগান পীর বাহারামের সমাধিক্ষেত্রে সমাধিস্থ রয়েছেন। তেমনই পর্যটকপ্রিয় বর্ধমানের আর এক অতীত মোঘলকালের দুই সেনাপতি খাজা আনোয়ার ও খাজা আবুল কাশেমের নবাব বাড়ি তথা প্রাসাদ, মসজিদ ও জলাশয়ের মাঝে হাওয়ামহল। পরিতাপের বিষয় মধ্যযুগীয় স্মারক সৌধ আজ ধ্বংসের পথে। প্রশাসন একটু যত্নবান হলে বর্ধমানের আরেক গৌরব হতে পারে মধ্যযুগের এই সৌধরাজি।
আর রয়েছে শহরের শেষে কাঞ্চননগরের কঙ্কালেশ্বরী কালী। প্রাচীনকালের পাথরের এই ভয়ঙ্করী দেবী মূর্তি নাকি জরাসন্ধের কালের। বোরহাটে কমলাকান্তের সাধনপীঠ তথা দেবী কালীর মন্দিরটিও আর এক দ্রষ্টব্য। পঞ্চমূর্তির আসনও রয়েছে মন্দিরে। বর্ধমানের সদরঘাটের পথে আলমগঞ্জে পুকুর খননকালে আবিষ্কৃত হয়েছেন কুষানযুগের দেবতা বিপুলাকার বর্ধমানের শিব। যেটি ৩৫০ মোন ওজনের, ৫ ফুট ৯ ইঞ্চি উঁচু, গৌরীপট্টের বেড় ১৮ ফুট। আর আছে অষ্টাদশভূজা সিংহবাহিনী দেবী সর্বমঙ্গলা, তেজগঞ্জে বিদ্যাসুন্দর কালীবাড়ি। এছাড়াও রেল স্টেশন থেকে ৪ কিলোমিটার উত্তর পশ্চিমে বর্ধমান গুসকরা রোডের নবাবহাটায় ১০৮টি শিব মন্দির দেখে নেওয়া যেতে পারে। ১৭৮৮-৮৯ তে রানী বিষ্ণুকুমারী গ্রাম বাংলার আদলে এই মন্দিরগুলি তৈরী করান। প্রতিটি মন্দিরের দেবতারা আজও সমানভাবে পূজিত হন। যাত্রী নিবাসও তৈরী হয়েছে মন্দিরের খুব কাছেই। অদূরেই ৩ কিলোমিটার বিস্তৃত পরিখা বেষ্টিত তালিতগড় দুর্গে বর্গি হামলার সময় আশ্রয় নিতেন রাজ পরিবার।
এছাড়াও পশ্চিম দিকের জি.টি.রোড থেকে বাঁ হাতে পথ বেরিয়েছে গোলাপবাগের। প্রাচীন কালে গোলাপ ফুটলেও আজ আম, জাম, পলাশ, শিমূল, ঝাউ, ইউক্যালিপটাসে ঘেরা গোলাপবাগে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস বসছে। অতীতে রাজাদের হাওয়ামহল, কৃষ্ণসায়র হ্রদ, রাজপরিবারের অবসর বিনোদনের মঞ্জিলবাহার আজও পর্যটকদের তৃপ্ত করে। ৩৩ একর ব্যাপ্ত কৃষ্ণসায়রের দুপাশ ঘিরে মাটির প্রাচীর আজও দৃশ্যমান। এই প্রাচীরে কামান বসিয়ে বর্গির হানা প্রতিহত করা হতো। নতুন করে মৃগ উদ্যানও বসেছে গোলাপবাগে। পাশেই ১৯৯৪ সালের ৯ জানুয়ারি জাপানি টেকনোলজিতে গড়া বর্ধমানের নবতম সংযোজন রাজ্যের দ্বিতীয় তারামন্ডল মেঘনাথ সাহা তারামন্ডলের উদ্বোধন হয়ে নিয়মিত প্রদর্শন চলছে। প্রতিদিন ৮টি করে প্রদর্শনী চলে এই তারামন্ডলে। রমনার বাগানে নবনির্মিত চিড়িয়াখানা, শিশু উদ্যান সর্পোদ্যান, শতাধিক পাখির পক্ষীনিবাসটিও বর্ধমানে বিশেষ আকর্ষনীয় হয়ে উঠেছে। ১৯৮১ সালে ০.১৪ বর্গ কিলোমিটার বন জুড়ে তৈরী হয়েছে অভয়ারণ্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশেই রয়েছে বিজ্ঞানকেন্দ্র। সোমবার ছাড়া সকাল ১১.৩০ থেকে সন্ধ্যে ৭ টা পর্যন্ত বিজ্ঞানের বিভিন্ন জিনিস দেখে নেওয়া যায়। প্রানী জগৎ, যাদুর খেলা, পরিবেশ বিজ্ঞানের নানা প্রদর্শনীতে অভিনবত্ব আছে। এছাড়াও ১৯৯৫ সালে তৈরী হয়েছে নতুন অ্যাকোরিয়াম।
স্বাদ নিতে পারেনঃ বর্ধমানের আরেক সৃষ্টি তার সীতাভোগ ও মিহিদানা। অতীতের সেই গরিমা না থাকলেও আজও বর্ধমানে গিয়ে সীতাভোগ, মিহিদানার স্বাদ না পেয়ে ফিরে আসলে বর্ধমান যাত্রাটা কিছুটা হলেও অপূর্ণ থেকে যাবে।
কীভাবে যাবেন?
হাওড়া থেকে ৯৫ কিলোমিটার দূরে মেন লাইনে বর্ধমান জংশন। আড়াই ঘন্টার যাত্রা, হাওড়া থেকে আধ ঘন্টা অন্তর ট্রেন মেলে। উচিত হবে ব্ল্যাক ডায়মন্ড এক্সপ্রেসে হাওড়ায় ফেরা। মেন লাইনে ব্যান্ডেল ও কর্ড লাইনে ডানকুনি, কামারকুন্ডু, শক্তিগড় হয়ে লোকাল ট্রেন যাচ্ছে হাওড়া ও শিয়ালদহ দুই স্টেশন থেকেই। বাসও যাচ্ছে কলকাতার শহীদ মনিার থেকে ১১৯ কিলোমিটার দূরের বর্ধমানে। বাস যাচ্ছে বর্ধমান সদর থেকে বর্ধমান, বীরভূম ও নদীয়া জেলার চারিদিকে।
কোথায় থাকবেন?
থাকার জন্য বর্ধমানে প্রচুর হোটেল পাওয়া যায়। রেল স্টেশনের উল্টো দিকে বর্ধমান ভবন, হোটেল নটরাজ, হোটেল প্রীত, হোটেল মনোহর ইন, হোটেল মৃগয়া ছাড়াও বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের গেস্ট হাউস ও থাকার পক্ষে মনোরম।
Be the first to comment