নতুন বছরের ডেস্টিনেশন কালনা

Spread the love

গঙ্গার এক পাড়ে কালনা আর অন্য পাড়ে শান্তিপুর। বৈষ্ণব ও শাক্তধর্মীদের তীর্থস্থান কালনা অর্থাৎ অম্বিকা কালনা। দার্জিলিং পাহাড় সূচনার আগে বন্দরনগরী কালনায় বর্ধমানরাজদের বসবাসও ছিল। কিছুটা দূরেই মনোহর বাগিচায় ঘেরা সাধক ভবা পাগলা তথা ভবেন্দ্রমোহন চৌধুরীর আরাধ্যা দেবী ভবানীর পঞ্চাশ দশকের ছোট্ট মন্দিরে বিশেষ পুজো হয় বৈশাখ মাসের শেষ শনিবার। নিজের হাতের নানা সূচীশিল্প ও অমৃতকথা মন্দিরটির আকর্ষণ বাড়িয়েছে। অদূরে দ্বাদশ গোপালের অন্যতম গৌরীদাস পন্ডিতের শ্রীপাট অর্থাৎ শ্রীগৌরাঙ্গমন্দির। প্রচলিত আছে আজও নাকি শ্রীচৈতন্যদেবের আবির্ভাব ঘটে মন্দিরের চৈতন্য বিগ্রহে। জনশ্রুতি, নবদ্বীপে যে নিম গাছের তলায় নিমাইয়ের জন্ম হয়েছিল, সেই নিম কাঠেই তৈরি মহাপ্রভুর মূর্তি। এক ঝলকে দেখে নিতে হয় মূর্তি। মহাপ্রভুর বিশ্রামস্থল অমলীতলায় আজও দৃশ্যমান প্রভুর পায়ের ছাপ। ৬৮৮ শকাব্দে সাধক অম্বরীশ দেবী অম্বিকার কৃপায় সিদ্ধিলাভ করেন। সেই সুবাদে সিদ্ধিধাত্রী দেবী কালী সিদ্ধেশ্বরী নামে খ্যাত। আর গঙ্গামুখী যেতে ভাদুড়ীপাড়ায় বর্ধমানেশ্বর মহারাজ চিত্র সেন ১৭৫১ সালে দেবী অম্বিকার চারচালা মন্দির গড়ে তোলেন। এই দেবী খুবই জাগ্রত। দেবী কালনার নাম অনুসারেই কালনার নাম অম্বিকা কালনা হয়েছে। তবে পুরাতত্ত্ববিদদের মতে জৈন দেবী অম্বিকা কালে কালে হিন্দু দেবীতে রূপান্তরিত হয়েছেন। এর বিপরীত দিকেই মা সাধনকালীর মন্দির। শায়িত শিবের নাভিপদ্মের উপর চতুর্ভুজা দেবী শ্যামাকালী আসীন। টেরাকোটা শিল্পে সমৃদ্ধ বাসুদেবের মন্দির।

কালনার আরেক অনন্য কীর্তি তার নবকৈলাস বা ১০৮ শিব মন্দির। ১৮০৯ সালে বর্ধমানরাজ তেজবাহাদুরের গড়া শিল্প সুষমামন্ডিত মন্দিররাজির স্থাপত্য ও গঠনশৈলী অনবদ্য। প্রাচীরে বেষ্টিত বৃত্তাকারে দুই সারিতে মন্দির তৈরী হয়েছে। একটি কালোপাথরের লিঙ্গে শিবঠাকুর। মন্দির চত্বরের কেন্দস্থলে দাঁড়লে প্রতিটা লিঙ্গমূর্তিই একসঙ্গে দেখা যায়। বিপরীত দিকে রাজবাড়ি চত্বরে বর্ধমানরাজদের গড়া টেরাকোটায় সমৃদ্ধ পঁচিশ চুড়োর লালজীর বাটি, প্রতাপেশ্বর মন্দির আর কিছুদূরেই রাসমঞ্চ। এখানে দেবতা রূপে পূজিত হন রাধাকৃষ্ণ। পাশেই টেরাকোটায় সমৃদ্ধ পঁচিশ চুড়োর কৃষ্ণচন্দ্রের মন্দির। মহালয়ার সময় সাজি উৎসবে শ্রীকৃষ্ণচরিত প্রদর্শিত হয়। প্রাচীরে বেষ্টিত মন্দির ত্রয়ীর স্থাপত্য ও ভাস্কর্যে অভিনবত্ব আছে। নানান পৌরানিক আখ্যান রূপ পেয়েছে টেরাকোটায়। রাজবাড়ির ভিতরে প্রতাপেশ্বর শিব মন্দিরটিও টেরাকোটায় সমৃদ্ধ। নানা পৌরাণিক আখ্যানের সঙ্গে অন্তঃপুরিকারদের রোজনামচা রূপ পেয়েছে টেরাকোটায়।

তেমনই গঙ্গাতীরের শ্রীশ্রীজগন্নাথ মন্দির, রাম-সীতার মন্দির দুটিও দ্রষ্টব্য। আর চকবাজারে আছে সাধক ভগবানদাস বাবাজীর আশ্রম, কালীনগর পাড়ায় বুদ্ধ মন্দির, স্বামী নিগমানন্দ সরস্বতী প্রতিষ্ঠিত জ্ঞানানন্দ মঠ, নিত্যানন্দ প্রভুর শ্বশুরবাড়ি কুলতলায়, সিদ্ধেশ্বরী মোড়ের কাছে গোপালবাড়ি, জগন্নাথ ঘাটের কাছে জোড়া শিব মন্দির। নেপালের রাজকুমারীর প্রতিষ্ঠিত আনন্দ আশ্রম, দাঁতনকাঠিতলায় প্রাচীন গির্জা ও মজলিস শাহর মসজিদের ধ্বংসাবশেষ, ডাঙাপাড়ায় প্রাচীন মসজিদ, বদর শাহর মাজার আজও অতীত রোমন্থন করায়। সাধক কমলাকান্তের জন্মও এই কালনায় বিদ্যাবাগীশ পাড়ায়। তবে দুপুর ১টা থেকে বিকেল ৪টে পর্যন্ত প্রতিটি মন্দিরের দ্বার বন্ধ থাকে।

কালনার আরও এক বৈশিষ্ট্য শ্রাবনী শুক্লা সপ্তমী তিথিতে দুর্গাপুজো। কালনার নবতম আকর্ষণ শীতে পরিযায়ী পাখিরা উড়ে এসে বসে গঙ্গার বুকের বিশাল চড়ে। পক্ষী আবাসও গড়ে তুলতে চলেছে জেলা পরিষদ। কালনার আগের স্টেশন হুগলি জেলার গুপ্তিপাড়া। গুপ্তিপাড়াতেও আকবরের কালে দশনামী সন্ন্যাসীদের বৃন্দাবন চন্দ্র ছাড়াও নানান মন্দির গড়ে ওঠে। টেরাকোটায় সমৃদ্ধ এই মন্দিররাজি গুপ্তিপাড়ার মঠ নামে খ্যাত। ৪০০ বছরের নয়চালার রথেরও প্রশস্তি আছে। এছাড়াও দেশ কালীমাতা, চৈতন্য ছাড়াও নানা মন্দির আছে গুপ্তিপাড়ায়।

স্মারক হিসেবে সংগ্রহ করুনঃ কালনা লাগোয়া গ্রাম তাঁতিপাড়ার সিল্ক বস্ত্র তথা মসলিন সঙ্গে করে নিয়ে আসতেই পারেন।

কীভাবে যাবেন?

কাটোয়া থেকে নবদ্বীপ পেরিয়ে কলকাতামুখী ৫৭ কিলোমিটার দুরের কালনাও বেরিয়ে আসা যায় একই যাত্রায়। বাসে যাওয়ার থেকে ট্রেনে যাওয়াই বেশী সুবিধার। সড়ক, রেল ও জলপথে ৮২ কিলোমিটার দূরের কলকাতার সঙ্গেও সংযোগ গড়েছে কালনা। কলকাতা থেকে কাটোয়ার প্রতিটি ট্রেন ঘন্টা দুয়েকে কালনা পৌঁছচ্ছে। ৮০ থেকে ১০০ টাকা খরচ করে রিকশায় ঘন্টা চারেকে কালনা ঘুরে নেওয়া যায়। দিনের শেষে অম্বিকা কালনা থেকে লোকাল ট্রেনে চেপে ঘন্টা আড়াইয়ে কলকাতা ফিরুন। এছাড়াও ২৫ কিলোমিটার দূরে নবদ্বীপে রাত কাটিয়ে ফিরে যেতে পারেন কলকাতায়।

কোথায় থাকবেন?

থাকার ব্যবস্থা মেল পৌরসভার ট্যুরিস্ট লজ পান্থনীড়ে। এছাড়াও হোটেল প্রিয়দর্শণী , হোটেল রিল্যাক্স, হোটেল মৌলক্ষী ও হোটেল দুর্গার মতো একাধিক হোটেল রয়েছে কালনায়।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*