‘আনলাকি থার্টিন’। হাল আমলে অনেকেই বিশ্বাস করে এই কথা এখন বলে থাকে। অনেক আগে থেকে ইউরোপ বা আমেরিকার মানুষরা এই ‘আনলাকি ১৩’ এর তত্ত্বটি বেশি মান্য করে এসেছে। ১৯১০ সালে হিস্ট্রিকাইফোডিয়া নামে একটা রোগ আবিষ্কৃত হয়। এই রোগের অর্থ হল তেরোর আতঙ্ক। এই আতঙ্কের কারণে ১৩ সংখ্যাটিকে ডেভিল বা ইভিল নম্বর বলা হয়ে থাকে। প্রথমে ধরা হত কোনো টেবিলে ১৩ জনকে বসানো, কারও বাড়ির নম্বর ১৩ সহ দৈনন্দিন জীবনে এমন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ১৩ সম্পর্কিত সব কিছুই অমঙ্গলজনক। এছাড়াও ১৩ সংখ্যা নিয়ে বহু বছর ধরে চলে আসা নানা ধরনের উক্তি, মতবাদ, বাইবেলের বর্ণনা, কুসংস্কার জড়িয়ে আরো রহস্যময় করে রেখেছে। তবে এটা কিন্তু শুধুমাত্র ভৌতিক বা প্যারানরমাল দিক দিয়েই ভাবা হয়। আবার সাধারণভাবে প্রতিটি দিনই সমান।
এখন কথা হলো ইংরেজি ক্যালেন্ডারের ‘থার্টিন’ শব্দটি লাকি হোক বা আনলাকি, তা নিয়ে মত পার্থক্য থাকতেই পারে। কিন্তু ভারতীয় সিনেমায় ডিসেম্বরের থার্টিন সত্যিই যে আনলাকি তা বলার অবকাশ রাখে না। দূরদর্শনের সংবাদপাঠিকা হিসেবে কেরিয়ার শুরু। থিয়েটারে কাজের সময় ডাক আসে বড় পর্দার। বলিউডে পা দেওয়ার পর থেকেই স্মিতা পাতিলের উল্কার বেগে উত্থান। একের পর এক সিনেমায় তাঁর অভিনয় মন জয় করে মানুষের। সমালোচকদের কাছ থেকেও তাঁর কাজ ভূয়সী প্রশংসা পায়। এর পর আর তাঁকে পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি।
দেশের সমান্তরাল সিনেমাতে তখন নতুন যুগের ছোঁয়া। স্মিতা ছিলেন শ্যাম বেনেগালের আবিষ্কার। সত্তরের মাঝামাঝি সময় থেকে আশির শেষ দিক পর্যন্ত হিন্দি, বাংলা ও মরাঠী সমান্তরাল সিনেমায় চুটিয়ে অভিনয় করেছেন তিনি। পাশাপাশি তথাকথিত বাণিজ্যিক ছবিতেও সমান সাবলীল ছিলেন স্মিতা। মরাঠি ও হিন্দি ছবিতে নিজের সময়ে স্মিতা ছিলেন বলিষ্ঠ অভিনেত্রী। তাঁর প্রথম সিনেমা ‘মেরে সাথ চল ‘। এই সিনেমার পরই শ্যাম বেনেগালের পরিচালনায় ‘নিশান্ত’। এরপর ‘চরণদাস চোর’, ‘মন্থন’, ‘ভূমিকা’—স্মিতার অভিনয় এবং শ্যাম বেনেগালের পরিচালনার যুগলবন্দিতে নতুন অধ্যায় তৈরি হয় বলিউডে।
সেই অধ্যায় আরও দীর্ঘ হয় অন্যান্য যশস্বী পরিচালকের নির্দেশনায়। স্মিতার নামের পাশে একে একে যোগ হয় ‘আক্রোশ’, ‘সদগতি’, ‘অর্থ’, ‘দেবশিশু’, ‘চিদম্বরম’, ‘গুলামি’, ‘বাজার’, ‘আকালের সন্ধানে’, ‘মান্ডি’, ‘অর্ধসত্য’ ‘মির্চ মশালা’–র মতো মাইলফলক ছবি। ‘ চক্র ‘ ছবির জন্য মুম্বইয়ের বস্তিতে গিয়ে সেখানকার জীবনযাত্রা লক্ষ করতেন স্মিতা। বাণিজ্যিক ছবিতেও স্মিতা ছিলেন সমান সাবলীল। অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে ‘ শক্তি ‘, ‘ নমক হালাল ‘ আজও সমান ভাবে জনপ্রিয়। সব রকমের সিনেমায় দাপুটে অভিনয় ছিল তাঁর।
পুণের ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামার ছাত্রী স্মিতা ‘ চক্র ‘ সিনেমায় অভিনয়ের জন্য দ্বিতীয় বার জাতীয় পুরস্কার লাভ করেন ১৯৮০ সালে। প্রথম জাতীয় পুরস্কার ১৯৭৭-এ। ‘ভূমিকা’ ছবির জন্য। প্রথম জাতীয় পুরস্কারের অর্থ স্মিতা দান করেছিলেন সমাজসেবামূলক কাজে। ‘ চক্র ‘ ছবির জন্য তিনি ফিল্মফেয়ার পুরস্কারও লাভ করেন। এছাড়া আরও সাতবার তিনি মনোনীত হয়েছিলেন ফিল্মফেয়ার পুরস্কারের জন্য। ১৯৮৫ সালে ভূষিত হন ‘পদ্মশ্রী’ সম্মানে।
স্মিতার অভিনয় নিয়ে তাঁর জীবনীকার মৈথিলী রাও লিখেছেন, “ স্মিতা মেথড অভিনেতা ছিলেন না। নিজের অনুভূতি আর সহজাত প্রবণতাকে অনুসরণ করতেন তিনি।” স্মিতা নন, পর্দায় তাঁর চরিত্রই ছাপ রেখে যেত দর্শকদের মনে। এমন অভিনয় কী ভাবে করতেন তিনি? মৈথিলী তাঁর বইতে জানিয়েছেন, পরিচালকের হাতে নিজেকে সম্পূর্ণ ভাবে ছেড়ে দিতেন স্মিতা। মৈথিলীর কথায়, “হার গ্রেটেস্ট অ্যাসেট ওয়াজ হার ইনটেনসিটি, ইনটেনসিটি বিকামস হার, ইনটেনসিটি ডিফাইনড হার।”
স্মিতা ও শাবানা আজমি দু’জনে কাজ করেছেন বেশ কিছু ছবিতে। কিন্তু একই ঘরানার এই দুই কুশীলবের সম্পর্ক ছিল শীতল।কোনওদিন বন্ধু হতে পারেননি। সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেছেন শাবানা নিজেই। তবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকলেও দু’জনেই একে অপরের কাজের প্রতি ছিলেন শ্রদ্ধাশীল। অভিনয় ও ব্যক্তিত্বে ছিল আলাদা ঘরানা। অভিনয়ের মতো ব্যক্তিজীবনেও স্মিতা ছিলেন স্পষ্টচেতা। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি বরাবর সরব হয়েছেন নারীদের সমস্যা ও অধিকার নিয়ে। তাঁর ব্যক্তিত্বের প্রভাব পূর্ণমাত্রায় পড়ত অভিনয়েও।
তাঁর অভিনীত সিনেমা ছিল প্রথাগত নায়কপ্রধান ছবির বিপরীত মেরুর। একের পর এক সিনেমায় তখন নিজেকে মেলে ধরতে থাকেন । তাঁর অভিনয় শৈলী ছিল একেবারে স্বকীয়। বিদ্যুৎ গতিতে অভিনয় জীবনে অতি অল্প বয়সে শীর্ষে উঠেছিলেন তিনি। সেই স্থানে দীর্ঘদিন অবস্থান করার সময় পেলেন না স্মিতা। আচমকাই ছন্দপতন। খ্যাতির মধ্যগগনে থাকাকালীন মাত্র ৩১ বছর বয়সে স্তব্ধ হয়ে যায় তাঁর অভিনয় জীবন।
১৯৮৬ সালে ১৩ ডিসেম্বর, আজকের দিনেই প্রয়াত হন স্মিতা পাতিল।
Be the first to comment