সারা দেশজুড়ে শীত পড়েছে যথেষ্ট। উত্তরের হাওয়া কাঁপুনি ধরাচ্ছে। তার মাঝে পাঁচ রাজ্যের নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক উত্তাপ চরমে। এর মধ্যে ৪০৩ আসন বিশিষ্ট উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে সারা দেশের রাজনৈতিক মহল। বলা হয়, উত্তরপ্রদেশের নির্বাচন লোকসভা নির্বাচনের সেমিফাইনাল। ২০২৪-এ লোকসভা নির্বাচনে কি ফলাফল হবে, তার অ্যাসিড টেস্ট হয়ে যায় এই উত্তরপ্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনে। নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণা হয়ে গেছে। চালু হয়ে গেছে আচরণবিধিও। কোভিড পরিস্থিতিতে জনসভা করা যাচ্ছে না। অতএব ডিজিটাল প্রচারে একে অন্যকে টেক্কা দিচ্ছেন যথেষ্ট। বিভিন্ন টিভি চ্যানেল শুরু করেছে ওপিনিয়ন পোল।
এই ওপিনিয়ন পোলগুলি যা ফলাফল বলছে, তাতে বিজেপির আসন কমলেও আবারও লখনউ তখতে বসতে চলেছেন যোগী আদিত্যনাথ। অখিলেশ যাদব যদিও দাবি করছেন, যে তাঁর দিকেই এবারে পাল্লা ভারী। যোগী মন্ত্রিসভার কিছু সদস্যকে ভাঙিয়ে অখিলেশ বিজেপির ঘরে সিঁধ কাটতে সক্ষম হয়েছেন বলে যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী। তবে ১৯ জানুয়ারি দিল্লিতে বিজেপির অফিসে তাঁরই ভ্রাতৃবধূ অপর্ণা যাদব উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ও বিজেপি সভাপতির উপস্থিতিতে ভারতীয় জনতা পার্টিতে যোগদান করলেন। তাঁকে উত্তরীয় পরিয়ে দেন বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জে পি নাড্ডা। ৩১ বছর বয়সি অপর্ণা বিজেপিতে যোগদান করে কি বিশেষ কিছু একটা করে ফেলতে পারবেন। এ প্রশ্ন এখন অনেকের মনে।
অপর্ণা সমাজবাদী পার্টির প্রতিষ্ঠাতা মুলায়ম সিং যাদবের দ্বিতীয় স্ত্রী সাধনা গুপ্তর ছেলে প্রতীকের সহধর্মিনী। ২০১৭ সালে লখনউ ক্যান্টনমেন্ট আসন থেকে নির্বাচনি লড়াইয়ে নেমেছিলেন তিনি। বিজেপির রীতা বহুগুণা যোশীর কাছে পরাজিত হন। তাঁর সমর্থনে সেবার তাঁর ভাসুর অখিলেশ যাদব এবং শ্বশুরমশাই মুলায়ম সিং যাদব প্রচার করেছিলেন। ইংরেজিমাধ্যম স্কুলে পড়া অপর্ণা ইউকের ম্যানচেষ্টার ইউনিভার্সিটি থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছেন। এর পাশাপাশি তিনি সোশ্যাল ওয়ার্কার হিসেবেও যথেষ্ট পরিচিত। তাঁর স্বামী প্রতীক রাজনীতি বিষয়ে ততটা মাথা ঘামান না। ব্যবসায়িক কাজ দেখেন তিনি। এহেন উচ্চিশিক্ষিত স্মার্ট অপর্ণা (যাঁরা বাবা অরবিন্দ বিস্ত ছিলেন একজন নামকরা সাংবাদিক) ২০১৭-তে যোগী আদিত্যনাথ মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরই একটি অনুষ্ঠানে তাঁকে আমন্ত্রণ জানান। তখন থেকেই গুঞ্জন ছিল যে অপর্ণা কি বিজেপিতে আসতে পারেন? অবশেষে পাঁচ বছর পরে সেই গুঞ্জন সত্যি হল।
কেন বিজেপিতে এলেন? এই প্রশ্নের জবাবে অপর্ণা বলেন, বিজেপির রাষ্ট্রবাদ তাঁকে আকর্ষণ করে। এর পাশাপাশি মহিলাদের স্বশক্তিকরণে এবং প্রধানমন্ত্রী মোদি ও মুখ্যমন্ত্রী যোগীর সুশাসনে আপ্লুত তিনি। অপর্ণার রাজনৈতিক ভবিষ্যত কতটা সুদৃঢ় তার থেকেও একথা বলা যায় যে, সপার ঘরে ঢুকে পদ্মফুল ফুটিয়ে ভ্রাতৃবধূ অপর্ণাকে এনে একটা মাস্টারস্ট্রোক দিল বিজেপি।
এবারের নির্বাচনে মহিলা ইস্যু অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য। কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়াঙ্কা গান্ধি স্লোগান দিয়েছেন ‘লড়কি হুঁ লড় শকতি হুঁ’। তিনি যে সেই লড়াই করতে পারেন, সেটাও ফেসবুক লাইভে প্রশ্নের উত্তরে জানান প্রিয়াঙ্কা। লখিমপুর খেরিতে যাওয়ার পথে উত্তরপ্রদেশ পুলিশ তাঁর রাস্তা আটকে ছিল। কোনওভাবেই তারা ঘটনাস্থলে প্রিয়াঙ্কাকে যেতে দিতে চায়নি। সেই সময় পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে গাড়ির সব লাইট নিভিয়ে প্রবল ঝড়বৃষ্টির মধ্যে গ্রামের রাস্তা দিয়ে দেড় ঘণ্টা ধরে যাত্রা করেন প্রিয়াঙ্কা। গ্রামের মধ্যে আলো নিভিয়ে ইঞ্জিন বন্ধ করে তাঁরা বসেছিলেন। পুরো প্রক্রিয়াটি প্রিয়াঙ্কা গান্ধির নেতৃত্বে হয়েছিল। পুলিশ তাদের দেখতে না পেরে ফিরে যায়। তারপর প্রিয়াঙ্কা লখিমপুর খেরির উদ্দেশ্যে রওনা হন। সেইদিন তাঁর মনে হয়েছিল লড়কি হুঁ লড় শকতি হুঁ।
উত্তরপ্রদেশে বিনা যুদ্ধে যে মাটি ছাড়তে রাজি নন, এদিন একথাও প্রিয়াঙ্কা তাঁর ফেসবুক লাইভে জানান। তাঁকে প্রশ্ন করা হয়, আপনাদের ভাই-বোনেদের ভিতর লড়াই হতো কিনা এবং তাতে কে জিতত। প্রিয়াঙ্কা বলেন, আপনারা আন্দাজ করুন। রাহুলই জিতত। তারপরে এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, তাঁদের ভাই-বোনের মধ্যে লড়াই হতো খুব। বাবাকে সামলাতে হতো। কিন্তু বাইরের কেউ লড়তে এলে তখন তারা দুজন মিলে টিম করে তাদের হারিয়ে দিতেন। দুই ভাই-বোনের সুসম্পর্ক আজও বর্তমান। প্রিয়াঙ্কার ইঙ্গিত যে কংগ্রেস এবারের নির্বাচনে অন্য দলগুলিকে পরাস্ত করে এগিয়ে যাবে। এবং সেক্ষেত্রে টিম রাহুল-প্রিয়াঙ্কা আগের মতই বিরুদ্ধ দলকে কুপোকাত করতে পারবে।
বুধবার ১৯ জানুয়ারি বিজেপির সঙ্গে উত্তরপ্রদেশের দুই সহযোগী দল আপনা দল ও নিষাদ পার্টির বৈঠক হয়। বৈঠক শেষে আপনা দলের অনুপ্রিয়া প্যাটেল প্রধানমন্ত্রী ও ইউপি-র মুখ্যমন্ত্রীর ভূয়সী প্রশংসা করেন। তাঁদের জোট এর আগেও সাফল্য পেয়েছে, এবারও পাবে, দৃঢ় বিশ্বাস তাঁর। একইরকম আত্মবিশ্বাসী নিষাদ পার্টির ড. সঞ্জয় নিষাদও। ইউপি-তে এর আগে মায়াবতী, অখিলেশ অথবা যোগী এঁরা মুখ্যমন্ত্রী হলেও বিধানসভায় লড়াই করে মুখ্যমন্ত্রী হননি। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর বিধান পরিষদ থেকে নির্বাচিত হন তাঁরা। এঁরা এমএলএ নন, এমএলসি হিসেবে মুখ্যমন্ত্রী পদ সামলান। এবারে গোরক্ষপুর বিধানসভা কেন্দ্র থেকে যোগী আদিত্যনাথ লড়বেন। অখিলেশের কাছেও প্রেস্টিজ ফাইট এবারের নির্বাচন। তিনি না লড়লে এইরকমও শোনা যাচ্ছে যে, তিনি হেরে যাওয়ার ভয়ে লড়বেন না। তাই তাঁর লোকসভা কেন্দ্র আজমগড়ের কোনও একটি সিট থেকে অখিলেশ লড়তে চলেছেন বলে সূত্রের খবর।
অখিলেশ হোক বা বিজেপি সকলেই ছোট ছোট দলগুলির সঙ্গে সমঝোতা করতে রাজি। যেমন আরএলডি-র সঙ্গে অখিলেশের ইতিমধ্যেই জোট হয়েছে। তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী না দিলেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অখিলেশের হয়ে লখনউ, বেনারসে প্রচার করবেন। বিজেপি অবশ্য ‘বাবুয়া’-কে ততটা পাত্তা দিতে নারাজ। তাদের মতে, নিজের ঘরই সামলাতে পারলেন না, কিভাবে উত্তরপ্রদেশের মানুষের আস্থা অর্জন করবেন। প্রসঙ্গত, চাচা শিবপাল যাদব ২০১৭-য় অখিলেশের বিরুদ্ধে ছিলেন। এবার চাচা ভাতিজার সঙ্গে। কিন্তু অপর্ণা চলে যাওয়াকে অখিলেশ যতই বলুন যে সমাজবাদী পার্টির বিচারধারা বিজেপির অঙ্গনে প্রবেশ করল, বাস্তবিক তার ঘর ভাঙায় যথেষ্ট বিব্রত একথা বলাই বাহুল্য।
Be the first to comment