পিয়ালি আচার্য : এই লেখা যখন লিখতে বসেছি, তখন রাত ১১টা। দিনটি হলো ২ অক্টোবর, জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীর জন্মদিন। আর দু-বছর হলে দেড়শো বছরে পা রাখবে গান্ধী জয়ন্তী। ঘটা করে উদ্যাপন করবেন সবাই এই দিনটি।
এ বছর অর্থাৎ ২০১৭ সালের গান্ধী জন্মদিনের দিনটিতে সকাল থেকেই দিল্লির রাজঘাটে ছিল ভিভিআইপি-দের ভিড় প্রতিবারের মতই। রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ, উপ-রাষ্ট্রপতি বেঙ্কাইয়া নাইডু, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং-সহ বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি গান্ধীজির সমাধিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন করলেন। এই পর্যন্ত চেনা ছবি—গতানুগতিক ঘটনা।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী স্বচ্ছ ভারত অভিযানের মাধ্যমে গান্ধীর স্মরণ করেন। বাপুর জীবনাদর্শ অনুসরণ করার কথা বলেন। কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি নিশ্চয়ই মহাত্মার এই দুই লাইন সম্পর্কে অবহিত আছেন, ‘To believe in something, and not to live it, is dishonest.’ বাপু তো শুধুই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ভারতের কথা বলেননি, তাঁর জীবন দিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ফেলা অবধি প্রচার করেছেন শান্তির কথা, সম্প্রীতির কথা, ধর্মীয় মৌলবাদ, সন্ত্রাস, হিংসার বিরুদ্ধে ছিল তাঁর জীবনভর লড়াই। গান্ধীজির ভাষাতেই বলা যায়, ‘My life is my message.’ কিন্তু এহেন গান্ধীজির জন্মদিনেই গুজরাটে হলো দলিত হত্যা। যুবকটির অপরাধ হলো উচ্চবর্ণের মানুষের সঙ্গে গরবা-র আসরে যাওয়া। তাই শুধু তাকে আসর থেকেই সরানো নয়, জীবন থেকেই সরিয়ে দেওয়া হলো।
বাপু তাঁর সারা জীবনের ব্রিটিশ বিরোধী লড়াইয়ে কখনও সত্যের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি। সেই সত্য হলো তাঁর জীবনদর্শন। তিনি বরাবর অহিংসার চশমায় সত্যকে দেখতেন। তাই তো তিনি বলেন, ‘An eye for an eye only ends up making the whole world blind.’ এক চোখের বদলায় আর এক চোখ নিলে সারা পৃথিবীটাই অন্ধ হয়ে যাবে। অত্যাচারী প্রবল পরাক্রান্ত ব্রিটিশরাজের চাবুকের আঘাতে যখন তাঁর সন্তানেরা ক্ষতবিক্ষত, যখন তাঁর নিজের হৃদয় দিয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে প্রতিনিয়ত, তখনও চৌরিচেরায় ব্রিটিশ পুলিশ পোড়ানোয় সায় দেননি তিনি। এসব কথা পাঠকদের জানা—তবু এর অবতারণা করতেই হবে। কারণ, জন্মের সার্ধশতবর্ষেও গান্ধীজি আমাদের কাছে শুধু প্রাসঙ্গিকই নন, ভীষণ ভীষণ জরুরি। তাঁর শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে তিনি লড়াই করেছেন পরাধীনতা, সন্ত্রাস, হিংসা, ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে। তাই শুধু ২ অক্টোবর নয়, গান্ধীজিকে স্মরণ করা প্রয়োজন প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে। তবে যদি আমরা কিছু শিখতে পারি।
আর মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী তো শুধু আমাদের দেশের সম্পদ নন, তিনি সারা বিশ্বের কাছে সত্য ও অহিংসা প্রচারের মুখ। তিনি ভারতে জন্মগ্রহণ করেছেন, এ আমাদের পরম প্রাপ্তি, চরম গৌরবের। গান্ধীজি যে অখণ্ড ভারতে বসে নিরস্ত্রীকরণ, শান্তি, অহিংস পথে লড়াইয়ের কথা বলেছিলেন, তা দেশ ভাগের ক্ষত বুকে নিয়েই স্বাধীন হয়। জন্ম নেয় পাকিস্তান। প্রতিবেশী রাষ্ট্র অথচ কী প্রবল হিংসা। ২ অক্টোবর ২০১৭ কাশ্মীর সীমান্তে অতর্কিত পাক গোলাগুলি বর্ষণে নিহত দুই শিশু-সহ তিন জন ভারতীয়। সন্ত্রাস ছাড়ছে না নিষ্পাপ শিশুকেও। যে দেশের নিজেদের অন্দরমহলেও অবিশ্বাসের বীজ, সন্ত্রাস-হিংসার ছোবল, সে ঘর না সামলে অন্যের ডেরায় আঘাত হানছে। একবার নয়, বারবার। এখানেই গান্ধীজির প্রয়োজনীয়তা। যিনি উদাত্ত কণ্ঠে বলেন, ‘Non violence requires a double faith–faith in God and also faith in man.’ এই হত্যাকারী বা হামলাকারীরা কিন্তু ভগবান বা মানুষ কাউকেই বিশ্বাস করে না বা ভালোবাসে না। তবে তারা কার কাছে দায়বদ্ধ? কিসের এত হিংসা! এই দেশ ভেঙে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ভাষার ভিত্তিতে তৈরি হয়েছিল আরও একটি দেশ—বাংলাদেশ। সহায়তা করেছিলেন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। দুই দেশের জাতীয় সংগীতের রচয়িতা একজন, তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তবুও প্রতিবেশী এই দেশের বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি কি অবিশ্বাসের ঘোলাটে চোখে তাকায় না আমাদের দিকে? ভুলে যায় তাদের নিজেদের দেশেও রয়েছে অস্থিরতা, সন্ত্রাস—ধর্মীয় হানাহানি। ভুলে যায় আমরা ‘এক ভাষাতেই মা-কে ডাকি, এক সুরে গাই গান’। তবে কেন এত অসহিষ্ণুতা? অবশ্য অন্য দেশের কথা কি বলব! আমাদের দেশের স্বাধীনতার বয়সও ৭০ হলো। যথেষ্ট পরিণত সে। তা সত্ত্বেও বারেবারে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্পে দমবন্ধ হয়ে মৃত্যু হচ্ছে মানুষের। সারা দেশ জুড়ে এক গুমোট পরিবেশ। লেখক-সমাজকর্মী-সাংবাদিক সকলেই শিকার। কখনও সাম্প্রদায়িকতা, কখনও সন্ত্রাস, হিংসা (অবশ্য এগুলোকে আলাদা করার দরকার আছে বলে মনে হয় না।) খতম করছে নির্ভীক লেখককে, রক্তাক্ত হয়ে লুটিয়ে পড়ছেন শিল্পী, সাহিত্যিক। বাদ পড়ছেন না সাংবাদিকরাও। যাঁদের পেশা সংবাদ পরিবেশন করা। যাঁরা নাকি গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ।
যাঁরা ২ অক্টোবর বাপুর সমাধিতে গোলাপের পাপড়ি বা গুচ্ছ গুচ্ছ ফুল দিয়ে এলেন, তাঁদের মধ্যে সবাই কি হৃদয় দিয়ে গান্ধীজিকে প্রণাম করলেন! একবার তাঁরা ভাববেন, তাঁরা বাবুকে অশ্রদ্ধা বা বলা ভালো পরিহাস করছেন কিনা? ধর্মের জিগির তুলে দেশে হানাহানির চেষ্টা হচ্ছে। হ্যাঁ, খুব জোরের সঙ্গে বলছি, কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন সরকার তার দায় এড়াতে পারেন না। আজ যেসব নেতা তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা বাপুকে স্মরণ করে তাঁর জীবনাদর্শ অনুসরণ করার কথা বলছেন, তাঁরা দয়া করে এই নগণ্য সাংবাদিকের এই প্রশ্নের জবাব দেবেন কি? কেন সারা ভারতের প্রেস ক্লাবগুলিকে ২ অক্টোবর গান্ধীজির জন্মদিনে পথে নামতে হয়? কারণ কেন্দ্রে বিজেপি সরকারের আমলে নির্বিচারে একের পর এক সাংবাদিক নিধন হয়। এদিন কলকাতা প্রেস ক্লাবও শান্তিপূর্ণভাবে পথে নামে। পাঠকেরা প্রশ্ন তুলতে পারেন, সাংবাদিকরা তো সাধারণ মানুষের মধ্যে, তবে তাঁদের কথা আলাদাভাবে উল্লেখ কেন? ঠিক, শুধু সাংবাদিকরাই নন, আজ গোটা দেশে এক অশান্ত পরিস্থিতি, সাধারণ মানুষজন সন্ত্রস্ত। কেন্দ্রে একটা তথাকথিত শক্তিশালী বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া সরকার আছে। সরকার কি দেশের নাগরিকদের নিরাপত্তার অধিকারটুকুও সুনিশ্চিত করতে পারে না? তবে কিসের গণতন্ত্রের পীঠস্থান। যে দেশে শিশুদের হাতে তুলে দেওয়া হয় অস্ত্র, গোরক্ষা বা গোগণনার নামে চলে ধর্মীয় উস্কানি, সে দেশের মন্ত্রীদের মুখে গান্ধীর বন্দনা মানায় না। জাতির পিতার বাণী আজ সত্যি ‘নীরবে নিভৃতে কাঁদে’। তিনি বলেছিলেন, ‘The essence of all religions is one only their approaches are different.’ একই কথা বলেছেন শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ, ‘যত মত তত পথ’।
গান্ধীজি চিরকাল বলতেন, ক্রোধ ও অসহিষ্ণুতা অহিংসার শত্রু। দেড়শো বছরের পা রাখার প্রাক্কালে তিনি শুধু আমাদের দেশ নন, প্রাসঙ্গিক সারা বিশ্বে। অথচ, ২০১৭-র ২ অক্টোবরে যখন শ্রদ্ধার সঙ্গে তাঁকে স্মরণ করা হচ্ছে, তখন বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ আমেরিকায় হিংসার বলি ৬০ ছুঁইছুঁই, আহতের সংখ্যা অগণিত। লাস ভেগাসের এই হিংসার মূলে আইএসআই-এর হাত থাকুক না থাকুক, বন্দুকবাজের এলোপাথাড়ি গুলিতে কনসার্টের সুর থেমে গেছে। প্রেক্ষাগারের বাইরে শুধুই রক্ত। এর সমাধান কোথায়? গান্ধীজির প্রিয় গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘বরিষ ধরা মাঝে শান্তির বারি’। আর বাপু বলতেন, ‘Peace is its own rewards.’
লেখার শেষের দিকে এসে পৌঁছেছি। বাংলা এখন মাতোয়ারা উৎসবে, শারদীয়ার রেশ সর্বত্র। এবারের দুর্গাপুজোয় কলকাতা ও জেলার বহু মণ্ডপেই বেজেছে ‘বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের সুর’। বহু প্যাণ্ডেলে মা-র হাতে কোনও অস্ত্র নেই। এখানেই গান্ধীজির দর্শনের সার্থকতা। এটাই তো আমাদের ঐতিহ্য। এখানে রামচন্দ্র অকালবোধন করে দুর্গাকে আবাহন করেন। যে দুর্গা অশুভ শক্তিকে পরাজিত করে পায়ের তলায় স্থান দেন, তাই তো সংশোধিত চরিত্র মহিষাসুরও পুজো পান আপামর ভক্তের। এ বাংলায় ইদ, মহরম, দোল, দুর্গোৎসব সবই পালিত হয় শান্তিতে।
সম্প্রীতির শিকড় এখানে বহু গভীরে প্রথিত আছে। আর বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিভাবকত্বে সাম্প্রদায়িক বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি মাথাচাড়া দিতে পারে না। শুধু মুখে বলাই নয়, হিংসার বিরুদ্ধে বারবার পথে নেমেছেন তিনি। এক্ষেত্রে প্রশাসক হিসেবে তাঁর ভূমিকাও উল্লেখযোগ্য। তাঁর নেতৃত্বে পুলিশ-প্রশাসন দুর্গোৎসব- মহরমের দিনগুলিতে বজায় রেখেছে শান্তি, সম্প্রীতি।
২ অক্টোবর ছুটির দিন। হাতে কিছুটা সময় ছিল বলে, গিয়েছিলাম ইয়েতি অভিযান সিনেমা দেখতে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা বহু পুরোনো গল্প অবলম্বনে ছবি। কিন্তু এখানেও তথ্যপাচার, হিংসা, সন্ত্রাস। সিনেমার মূল চরিত্র রাজা রায়চৌধুরী ওরফে কাকাবাবু লড়াই করলেন অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে। কখনও দল বেঁধে, কখনও সম্পূর্ণ একা। শেষ করব কাকাবাবুর তথা সমাজের সমস্ত সচেতন নাগরিক তথা শুভশক্তির উদ্দেশে গান্ধীজির লেখা দুটি উক্তি দিয়ে। ১) ‘Even if you are a minority or one, the truth is the truth’ ২) ‘Truth stands, even if there be no public support, it is self sustained.’ সত্য শাশ্বত, এর জোর এত বেশি যে, এ নিজেই টিকে থাকবে। আর আমাদের দেশের তথা গণতন্ত্রের কাছে সবচেয়ে সত্য তার সংবিধান। যে মজবুত ভিতের উপর তা দাঁড়িয়ে আছে, তাকে টলানো মুশকিল। লেখা শেষ করার সময় রাত বারোটা বেজে গেছে। অর্থাৎ ৩ অক্টোবর। তাতে কি আগামী ৩০০ কেন, ৩০০০ বছরেও গান্ধীজির চর্চা চলা উচিত তাঁর অহিংস মার্গ দর্শনের জন্য।
Be the first to comment