তপন মল্লিক চৌধুরী:
যখন প্রথম সিনেমায় অভিনয় করতে শুরু করি, তখন আমার বয়স চোদ্দো-পনেরো। নীরেন লাহিড়ির তখন পরিচালক হিসেবে বেশ নামডাক। নাটোরের জমিদার বংশের ছেলে। তিনি সেই সময় একটা নতুন ছবি বানানোর কাজে হাত দিয়েছিলেন। আমরা তখন থাকতাম হাজরা লেন-এর বাড়িতে। বাবার বানানো আটটা বাড়ির একটায়। আমাদের বাড়ির দুটো বাড়ি পরেই ছিল নায়িকা চন্দ্রাবতী দেবীর বাড়ি। অসম্ভব সুন্দরী ছিলেন। তিনি যখন আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে যাতায়াত করতেন, জানলা দিয়ে হাঁ করে দেখতাম। এক দিন মনে হল, দূর থেকে রোজ দেখি, এক বার কাছ থেকে দেখি তো কেমন দেখতে। চলেই গেলাম ওঁর বাড়ি। আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোথায় থাকো?’ বললাম, ‘পাশের বাড়ি’। বলে একটু হাসলাম। যেই হাসলাম, অমনি উনি বলে উঠলেন, ‘আমার দিকে তাকিয়ে আর এক বার হাসো তো!’ হাসলাম। বললেন, ‘এ দিকে এসে বোসো।’ কাকে যেন ফোন করলেন। বললেন, ‘আপনি দাঁতের কথা বলছিলেন না? একটি মেয়ে এসেছে। ওর দাঁতের সেটিং ঠিক ও-রকম। আপনি কি এক বার আসতে পারবেন?’ আমি তো অবাক। দাঁত? দাঁত এল কোথা থেকে? যাই হোক, নীরেন লাহিড়ি এলেন। আমাকে দেখলেন। তার পর আমার বাড়িতে এলেন। বাবার সঙ্গে কথাবার্তা বলে ওখানেই আমাকে দিয়ে তাঁর ছবির জন্য সই করালেন। ছবির নাম ‘নাগপাশ’।
এ পর্যন্ত সব কিছু মসৃণ ভাবেই চলছিল। কিন্তু ঝামেলা হল এর পর। আমার বড় জামাইবাবু ছিলেন বনফুল। তখন অনেক বড় বড় ছবির গল্প তিনিই লিখছেন। আমার ছবিতে নামার কথা শুনে তিনি গেলেন ভীষণ রেগে। বাড়িতে এসে বাবাকে প্রচণ্ড বকাবকি করলেন। দেখেশুনে আমারও খুব রাগ হল। সটান এসে বড় জামাইবাবুকে বলে বসলাম, ‘আপনি তা হলে কেন সিনেমায় গল্প বিক্রি করেন? আপনি যদি গল্প বিক্রি করেন, তা হলে আমিও অভিনয় করতে পারি।’
জীবনের প্রথম শুটিং। চোখের সামনে দেখছি ভারতী দেবী, অসিতবরণকে। আমার প্রথম হিরো অসিতবরণ স্বয়ং। স্ক্রিন টেস্ট হয়ে যাওয়ার পর, আমাকে একটা ডায়ালগ বলতে বলা হল। ছবিতে আমার বড়দা দিলীপ রায়চৌধুরীকে বলছি কথাটা। তার ঠিক আগের শটেই একটা গুন্ডার হাত থেকে আমাকে বাঁচিয়েছেন অসিতবরণ। আর তার পরই আমি তাঁর সঙ্গে বড়দার পরিচয় করাচ্ছি এই বলে, ‘দাদা, ইনিই সে দিন আমাকে গুন্ডার হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন।’ এটাই আমার জীবনের প্রথম বলা ডায়ালগ। সত্যি, কত বছর কেটে গিয়েছে। কত অসংখ্য ডায়ালগ আমাকে দিয়ে বলানো হয়েছে। কিন্তু ওটার চেয়ে প্রিয় ডায়ালগ আমার খুব কমই আছে।
‘নাগপাশ’ কিন্তু মুক্তি পেল না। কোনও একটা অশান্তির জেরে ছবির কাজ বন্ধ হয়ে যায়। তার পর বেশ কিছু দিন কেটে গেল। আমরা তখন ফার্ন রোডের বাড়িতে। এক দিন হঠাৎ বাইরে থেকে চিৎকার, ‘এটা কি বেণু ব্যানার্জির বাড়ি?’ এম পি প্রোডাকশন্স থেকে লোক এসেছে আমাকে খুঁজতে। এম পি প্রোডাকশন্স-এর হর্তাকর্তা তখন মুরলীধর চট্টোপাধ্যায়, প্রমথেশ বড়ুয়ার মতো মানুষরা। ওই প্রোডাকশন হাউসের ছবি ‘বসু পরিবার’, আমার দ্বিতীয় ছবি। শুটিং শুরু হল। এম পি-র ভ্যান আসত আমাকে নিতে। সিঁথির মোড়ের দিকে ছিল এম পি-র স্টুডিয়ো। বিশাল বড় বড় দুটো ফ্লোর। সেখানেই রান্নাবান্না, খাওয়াদাওয়া চলত। ‘বসু পরিবার’-এর সঙ্গে সঙ্গে আর একটা ছবিরও শুটিং চলছিল তখন। সেটা অবশ্য আমাদের দেখানো হত না।
এম পি-র ভ্যানে আমার সঙ্গীদের মধ্যে ছিলেন অসিতবরণ, মঞ্জু দে। এঁরা তখন আসাধারণ কাজ করছেন। ‘কার পাপে’ সেই সময়কার এক অপূর্ব ছবি। সে ছবিতেও এঁরা অভিনয় করছেন। আর অন্য সঙ্গীদের মধ্যে ছিলেন সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় আর উত্তমকুমার। এই ‘বসু পরিবার’-এর শুটিংয়ের সময়ই আলাপ উত্তমকুমারের সঙ্গে। আমি অবশ্য তাঁকে আরও আগেই চিনতাম। চিনতাম বললে ভুল হবে। দেখেছিলাম। গিরীশ মুখার্জি রোডে ‘জয়হিন্দ’ নামে একটা বাড়িতে তখন ভাড়া থাকতাম আমরা। সেখানে একটা ব্যাডমিন্টন কোর্ট ছিল। উত্তমকুমার সেখানে খেলতে আসতেন। ‘বসু পরিবার’-এ তিনি আমার বড়দার ভূমিকায়।
‘বসু পরিবার’-এর সঙ্গে অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। কত দিন আগের কথা! সেই ১৯৫২ সালের ছবি। নির্মল দে-র পরিচালনা। ওই সিনেমা করতে গিয়েই আমার নাম বদলে গেল! আমাকে তখন সবাই ‘বেণু’ বলেই ডাকে। এক দিন ভ্যানটা স্টুডিয়োতে ঢুকছে। শুনলাম কেউ ডাকছে, ‘সুপ্রিয়া, সুপ্রিয়া।’ আমি তো অবাক। এ নামটা আবার কার? দেখলাম পাহা়ড়ী স্যান্যাল বসে আছেন। ছবিতে আমার বাবা হয়েছেন। আমাকে দেখে বললেন, ‘তোমাকে ডাকছি, শুনতে পাচ্ছ না?’ অবাক হয়ে বললাম, ‘আমাকে?’ বললেন, ‘এখানে আর কে আছে? তোমার নামই তো সুপ্রিয়া।’ এর পর থেকে ‘সুপ্রিয়া’ হলাম।
সহ-অভিনেতাদের মধ্যে ছিলেন জহর রায়, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। ভানুর তখন কী কম বয়স! ছবিতে তিনি তেজারতির কারবারি। ছবিটায় উত্তমকুমারের প্রথম আবির্ভাবই ভানুর কাছে টাকা ধার নিতে আসার ব্যাপারে। আর সাবিত্রী হয়েছিলেন আমার ছোড়দার বাগদত্তা। দোহারা, ছিপছিপে চেহারা, বড় বড় চোখ। একটা মামলা নিয়ে ছবির শুরু, যে মামলায় আমাদের পরিবারের হার হয় এবং আমরা প্রায় নিঃস্ব হয়ে পড়ি। মামলায় রায় বেরিয়েছে, ছোড়দার সঙ্গে মায়ের সেই নিয়েই কথাবার্তা চলছে, এমন সময় আমার প্রবেশ। ছবিতে আমার নাম সুজাতা।
ছোড়দা প্রখর বাস্তববাদী। আর বড়দা ঠিক উলটো। আদর্শবাদী, স্পষ্টভাষী। অন্যের জন্য নিজের সব উজাড় করে দিতে পারেন। সামান্য আড়াইশো টাকা মাইনের চাকরি করেন। অথচ এই ভয়ানক বিপদের দিনে ওই বিশাল পরিবারের খরচ চালানোর ব্যাপারে চিন্তায় আচ্ছন্ন বাপ-মা’কে সাহস দেন। এখন ভাবলে অবাক লাগে। এক সময় আমার বহু ছবির নায়ক, আমার জীবনসঙ্গী, প্রথম ছবিতে আমার দাদার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন।
Be the first to comment