সুপ্রিম কোর্টের আবেদনের পরেও, চিকিৎসকেরা কর্মবিরতিতে অনড়, ভুগচ্ছে সাধারণ মানুষেরা

Spread the love

চিরন্তন ব্যানার্জি, কলকাতা: প্রথমে মুখ্যমন্ত্রী, তারপর মেডিক্যাল কাউন্সিল, মাঝে কলকাতা হাইকোর্টের পরে মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্টও সমাজের স্বার্থে জুনিয়র ডাক্তারদের কর্মবিরতি প্রত্যাহার করার আবেদন জানিয়েছে। কিন্তু ১১ দিন পরেও আন্দোলনকারীরা এখনও তাঁদের ধর্মঘটে অনড়। জুনিয়র ডাক্তারদের দাবি, আরজি করে তরুণী চিকিৎসকের খুন-ধর্ষণের নেপথ্যে থাকা অপরাধীদের চিহ্নিত করার পাশাপাশি সিবিআই তদন্তের সন্তোষজনক অগ্রগতি না জানতে পারা পর্যন্ত তাঁরা কর্মবিরতি চালিয়ে যাবেন।মঙ্গলবার শুনানিতে সুপ্রিম কোর্টের বক্তব্য, সমাজের যে স্তরের মানুষ সরকারি চিকিৎসার উপরে নির্ভরশীল, এই ধর্মঘটের ফলে তাঁরা অসুবিধার মুখে পড়ছেন। এটা এই সময়ে দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। হাসপাতালের ইন্টার্ন, রেসিডেন্ট ডক্টর এবং সিনিয়র রেসিডেন্টরা যাতে ঠিক মতো চিকিৎসা দিতে পারেন এবং ডাক্তারি পড়ুয়ারা যাতে পড়াশোনা করতে পারেন, তার জন্য তাঁদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা জরুরি। হাসপাতালে কেন্দ্রীয় বাহিনীর নিরাপত্তা দেওয়া হবে। আশা করি এবং বিশ্বাস করি ডাক্তাররা এ বার অবিলম্বে কাজে ফিরবেন। এরপরেও নিরাপত্তা নিয়ে তাঁদের চিন্তা থাকলে আদালততে ই-মেল করে তাঁরা জানাতে পারবেন।

উল্লেখ্য, আরজি করে মর্মান্তিক ঘটনার প্রেক্ষিতে জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনকে দলমত নির্বিশেষে সমর্থন করেছেন আমজনতা। কিন্তু সেই সাধারণ মানুষই এখন টানা কর্মবিরতির জেরে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এখন আর যাচ্ছেন না সরকারি মেডিক্যাল কলেজের চত্বরে। হয় রোগ চেপে বসে থাকছেন বাড়িতেই, নইলে পকেট শূন্য করে চিকিৎসা করাতে বাধ্য হচ্ছেন বেসরকারি হাসপাতালে। ফলে সরকারি হাসপাতালের আউটডোরে রোগীর সংখ্যা কমে গিয়েছে কোথাও ৫০%, তো কোথাও আবার ৯০%। আর যাঁরা আসছেন হাসপাতালে, তাঁরাও যে যথাযথ পরিষেবা পাচ্ছেন, এমনটা নয়। যেমন এই প্রতিবেদকের পরিচিত একজন, হাওড়ার বাসিন্দা বছর ষাটোর্ধ মঞ্জুলা দে গত ৯ আগষ্ট সন্ধ্যায় বাড়িতেই হৃদরোগে আক্রান্ত হন। তাঁর অবস্থা সংকট জনক হওয়ায় ওই রাতেই তাঁকে আনা হয় কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালে, সেখানে চিকিৎসকেরা পরিবারের সদস্যদের বলে দেন ডাক্তার নেই, চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়া যাবে না তাই অন্যত্র নিয়ে চলে যান। তাঁরা ওই মুমূর্ষ্য রোগীকে নিয়ে যান চিত্তরঞ্জন ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে, সেখানে ওই রোগীকে ভর্তি করা হলেও আজও সেইভাবে তাঁর চিকিৎসা শুরু হয় নি ডাক্তারের অভাবে। ওই রোগীর পরিবারের সদস্যরা জানান, “এখনো তাঁর এনজিওগ্রাফি করা হয়নি, প্রতিদিনই চিকিৎসকরা আজ হবে বলে ডাকছেন, তারপর আবার তা পিছিয়ে যাচ্ছে, আমরা মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্য আমাদের পক্ষে বাইরে থেকে কুড়ি হাজার টাকা খরচা করে এই টেষ্ট করার ক্ষমতা নেই।
উল্লেখ্য, আমজনতার একটা বড় অংশও বুঝে গিয়েছেন, সরকারি হাসপাতালে গেলেও চিকিৎসা মেলার সম্ভাবনা কম। তাই রোগীও আসছে না হাসপাতালে। পরিসংখ্যান বলছে, আরজি করে সোমবার ২০০০ শয্যায় ভর্তি রয়েছেন মাত্র ১২৬ জন রোগী। ওই দিন সেখানে আউটডোরে এসেছিলেন মাত্র ৩৬৪ জন। স্বাভাবিক সময়ে সংখ্যাটা থাকে সাধারণত হাজার ছয়েক। এসএসকেএমে প্রতি সোমবার যেখানে অন্তত ৯০০০ রোগী আউটডোরে আসেন, সেখানে গত সোমবার এসেছিলেন ৩৬০০ জন। এনআরএসের আউটডোরে হাজার সাতেকের বদলে ওই দিন হাজির ছিলেন ২২০০ রোগী। প্রতি সোমবার কলকাতা মেডিক্যালে যেখানে অন্তত ৫০০০ রোগী আসেন আউটডোরে, সেখানে গত সোমবার এসেছিলেন মাত্র ১৯০০ জন।
স্বাস্থ্য দপ্তর সূত্রে খবর, কমবেশি সব সরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ছবিটা প্রায় একই রকম। তবে সঙ্কটের বহর স্বাভাবিক কারণেই কিছুটা বেশি আন্দোলনের ভরকেন্দ্র আরজি কর হাসপাতালে। খুনের ঘটনায় জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনের পাশে দাঁড়িয়েছেন রাজ্যবাসী, সেই আন্দোলনের অঙ্গ যে কর্মবিরতি, তার কোপেই পড়েছে গরিব নিম্নবিত্ত মধ্যবিত্তের স্বাস্থ্য। বস্তুত, গত ১১ দিনে বহু রোগী হাসপাতালে গিয়ে হয়রান হওয়ার পরেও বলেছেন, জুনিয়র ডাক্তাররা ঠিক করছেন।
এমন ছবি অবশ্য শুধু কলকাতা কিংবা বাংলার নয়, কমবেশি সারা দেশেই। আরজি করের ঘটনায় গড়ে ওঠা আন্দোলনকে সহমর্মিতা জানাতে কর্মবিরতিতে সামিল হয়েছেন সারা দেশের জুনিয়র ডাক্তাররাই। ফলে রোগী পরিষেবায় প্রভাব পড়ছে সর্বত্র। তাই এদিন সুপ্রিম কোর্টে শুনানি চলাকালীন প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড় বলেন, ‘ধর্মঘটী চিকিত্সকদের অবিলম্বে কাজে ফেরার জন্য অনুরোধ করছি। সমাজের স্বার্থেই তাঁরা কাজে ফিরুন। তাঁদের উদ্বেগের বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করছে দেশের সুপ্রিম কোর্ট। আদালতের উপর আস্থা রাখুন।’ কিন্তু শীর্ষ আদালতের অন্তর্বর্তী নির্দেশে খুব একটা খুশি হতে পারেননি আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তাররা। আরজি করে সব মেডিক্যাল কলেজের জুনিয়র ডাক্তারদের প্রতিনিধিদের জিবি মিটিংয়ের পর তাঁরা জানান, এখনই কর্মবিরতি প্রত্যাহার করা হচ্ছে না। আন্দোলনকারীরা জানাচ্ছেন, আগামী কাল, বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্টে সিবিআই তদন্তের স্টেটাস রিপোর্ট জমা পড়ার পরে যদি দেখা যায় তা সন্তোষজনক, তখন কর্মবিরতি প্রত্যাহার করা হতে পারে। সারা দেশেও বিভিন্ন সংগঠন সুপ্রিম কোর্টের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কর্মবিরতি প্রত্যাহার করা নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করছে। কোথাও কোথাও এদিনই প্রত্যাহারের বার্তা দেওয়া হয়েছে। আরজি করের অ্যানাস্থেশিয়ার জুনিয়র রেসিডেন্ট ডাক্তার অনিকেত মাহাতো এপ্রসঙ্গে বলেন, ‘আমাদের আন্দোলনের মূল দাবি হলো চিকিৎসকের ধর্ষণ- খুনের মূল অপরাধীদের চিহ্নিতকরণ ও গ্রেপ্তারি। কিন্তু সিবিআই তদন্তের গতি-প্রকৃতি কী, তার কিছুই জানতে পারিনি। তাই আপাতত কর্মবিরতি চালিয়েই যাবেন ডাক্তারেরা।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*