মহিষাদল রাজবাড়ি
মাসানুর রহমানঃ
শহরের ভিতরও একটা শহর থাকে, গ্রামের ভিতরও একটা গ্রাম থাকে আর তেমনই বাড়ির ভিতরও থাকে একটা আস্ত বাড়ি, সে এক বিশাল প্রাসাদ। পিলার, দালান, নহবতখানা আজও যেন প্রাণবন্ত। ভোর আর সন্ধ্যে হলেই বেজে ওঠে সানাই। আলোকবাতির মিঠে আলো সাজিয়ে তোলে আলোর সৈন্যদল। রোজদিনের সাথে মহিষাদল রাজবাড়ির দায়িত্বপ্রাপ্ত ম্যানেজার স্বপন চক্রবর্তীর স্মৃতির বর্ণনায় চিত্রগুলি যেন আপনা থেকেই তৈরী করে ফেলল একটা গোটা চিত্রনাট্যের খসড়া।
বর্তমানে মহিষাদল রাজবাড়িটি প্রায় ৯০ একর জায়গা জুড়ে অবস্থিত। বিশাল বাগান ও প্রাসাদ দর্শনীয় বস্তু। রাজবাড়ির ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায় এই রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা জনার্দন উপাধ্যায় । মোগল সম্রাট আকবরের অধীন সেনাবাহিনীর উচ্চপদে কাজ করতেন তিনি। ষষ্ঠদশ শতকে উত্তরপ্রদেশ থেকে জনার্দন উপাধ্যায় ব্যবসার জন্য নদীপথে মহিষাদলের উপকণ্ঠে গেঁওখালিতে আসেন। সে সময় এই এলাকার রাজা ছিলেন কল্যাণ রায়চৌধুরী। কল্যাণ রায়চৌধুরির থেকে মহিষাদলের স্বত্ব কিনে তিনি নতুন রাজা হন। আসলে নবাব সরকারের রাজত্ব দিতে না পারায় ঐ রাজার রাজত্ব নিলাম হয়ে যায়। আর সেই সুযোগ হাতছাড়া করেননি জনার্দন উপাধ্যায়। তাঁর পঞ্চম পুরুষ রাজা আনন্দলাল উপাধ্যায়ের পুত্র সন্তান ছিল না। তাঁর মৃত্যুর পর রানী জানকী রাজত্বের দায়িত্ব নেন। এরপর তার জামাতা ছক্কনপ্রসাদ গর্গের ছেলে গুরুপ্রসাদ গর্গ রাজা হন। এরপর থেকেই মহিষাদলে গর্গদের রাজত্ব।
তারপর মন্থরার ছোটছেলে জগন্নাথ গর্গ মহিষাদলের রাজা হন। তিনিও ছিলেন প্রজাবৎসল রাজা। এরপর তাঁর পুত্র রামনাথ গর্গ নাবালক থাকায় তাঁর স্ত্রী ইন্দ্রানী দেবী রাজত্ব পরিচালনা করতে শুরু করেন। ১৮৩৬ খ্রীঃ রামনাথ গর্গ সিংহাসনে বসেন। তবে তিনি নিঃসন্তান হওয়ায় পোষ্যপুত্র নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। উত্তরপ্রদেশের বান্দা জেলায় বসবাসকারী জ্ঞাতি রট্টুপ্রসাদ গর্গের ছেলে লছমনপ্রসাদ গর্গকে দত্তক নেন তিনি পরবর্তীকালে সিংহাসনে বসেন। তাঁর তিন ছেলে নাম ঈশ্বরপ্রসাদ, জৌতিপ্রসাদ ও রামপ্রসাদ। ১৮৮৪ সালে ঈশ্বরপ্রসাদ সিংহাসনে আরোহন করেন। ঈশ্বরপ্রসাদের মৃত্যুর পর সিংহাসনে বসেন তার ছোটভাই জৌতিপ্রসাদ। তবে জৌতিপ্রসাদ নিঃসন্তান হওয়ায় তার পর রাজা হন ঈশ্বরপ্রসাদের বড় ছেলে সতীপ্রসাদ। তাঁর দুই ছেলে দেবপ্রসাদ ও শক্তিপ্রসাদ। ১৯৫২ ও ১৯৫৭ সালের নির্বাচনে দেবপ্রসাদ গর্গ নির্দল প্রার্থী হিসাবে জয়ী হন। শক্তিপ্রসাদের এক ছেলে এক মেয়ে। ছেলে শংকর প্রসাদ, মেয়ে মৃদুলাদেবী। শংকরপ্রসাদেরও এক ছেলে এক মেয়ে। ছেলে শৌর্য্যপ্রসাদ ও মেয়ে উর্মিলাদেবী।
জানা যায় ভারতীয় মার্গসঙ্গীত জগতের মানুষজন এখানে এসে নিয়মিত সঙ্গীতচর্চা করতেন বিশ শতক জুড়ে। ফৈয়জ খাঁ থেকে শুরু করে বড়ে গোলাম আলি, কুমার মুখার্জি, কণ্ঠে মহারাজের মতো বিখ্যাত মানুষজনের ব্যবহৃত তানপুরা, তবলা, হারমোনিয়াম সংরক্ষিত রয়েছে এখানে। গ্রন্থাগারটাও ছিল দারুণ। সব কিছুতেই একটা বেশ রাজকীয় ব্যাপার ছিলো।
এই রাজ পরিবারের রাজারা তিন তিনটে রাজবাড়ি নির্মাণ করেন। তবে এখন পুরানো নিদর্শন বলতে মহিষাদলে রাজাদের দু’টি রাজবাড়ি রয়েছে। একটি হচ্ছে রঙ্গিবসান রাজবাড়ি। যা আনুমানিক ১৮৪০ খ্রিষ্টাব্দে তৈরি হয়েছিল। অন্যটি ফুলবাগ রাজবাড়ি যা আনুমানিক ১৯৩৪ সালে তৈরি হয়। পুষ্করিণী, আম বাগান, রাজ টেনিস কোর্ট, খেলার মাঠ, মন্দির, ও প্রাসাদের মধ্যেই রয়েছে এক বিশাল সংগ্রহশালা। এছাড়াও কামান, পালকি, এবং সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ১৩ চূড়ার রথ যা বহন করে চলেছে এক রাজবাড়ির রাজকাহিনীকে।
রাজবাড়ি আর সংলগ্ন দর্শনীয় স্থানগুলো দেখলেই বোঝা যায় রাজারা শিক্ষা-সংস্কৃতিতে প্রজাদের উৎসাহ দিতেন সর্বদাই। মহিষাদল রাজ কলেজ থেকে শুরু করে রাজ হাইস্কুল-সহ নানা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়েছেন তাঁরা। বিশাল দেওয়াল, দালান, পিলার যেন সেই স্মৃতিরই সাক্ষী।
Be the first to comment