তপন মল্লিক চৌধুরী
বাঙালি পাঠকসমাজে গোর্কির পরিচিতি সম্ভবত মা উপন্যাসের সূত্র ধরে। কাজী নজরুল ইসলামের সম্পাদনায় লেবার স্বরাজ পার্টির সাপ্তাহিক মুখপত্র হিসেবে যখন লাঙল বেরোয়, তখন তার প্রথম সংখ্যা (২৫ ডিসেম্বর ১৯২৫) থেকেই নজরুলবান্ধব নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়ের ভাষান্তরে মা ধারাবাহিকভাবে ছাপা হতে থাকে। শুধু মা কেন, গোর্কির অধিকাংশ প্রধান রচনা তত দিনে তাঁর স্বদেশে বেরিয়ে গেছে। আলোচ্য তিন উপন্যাসসহ। আমার ব্যক্তিগত ধারণা, বিগত শতকের চল্লিশের দশক—যখন বঙ্গদেশে বামপন্থা রাজনীতি ও আন্দোলনের স্বর্ণযুগ, সে সময় রুশ ও স্ক্যান্ডিনেভীয় সাহিত্য প্রচুর অনূদিত হয়েছিল এবং সেসবের ভেতরে গোর্কির রচনা সন্দেহাতীতভাবে ছিল।
সাহিত্যসৃজনে গোর্কির প্রধান উৎস সম্পর্কে একজন জিজ্ঞেস করেছিলেন। জবাবে গোর্কি বলেন, ‘আমার জীবনে সঞ্চিত মাল-মসলাকেই মুখ্যত কাজে লাগাই আমি।’ ইচ্ছাকৃত সরলীকরণটি টের পাওয়াই যায়। নিজের যাপিত জীবন ও অভিজ্ঞতা, অন্যের এবং সামাজিক অভিজ্ঞতা, পরিমণ্ডল থেকে পরোক্ষ জ্ঞানলাভ করেন না—এমন কোনো শিল্পী কি পৃথিবীতে আদৌ আছেন? এসবই তো সঞ্চয়। গোর্কি নিশ্চয়ই শুধু এটুকু বলতে চাননি। তিনি হয়তো এটুকুই বলতে চেয়েছেন যে তাঁর লেখায় বানানো কিংবা কল্পনাপ্রসূত কিছু নেই; যা আছে সব নিজের পারিপার্শ্বিক পরিমণ্ডল থেকেই নেওয়া। এই বাস্তবতার সাক্ষী হিসেবে জোরালোভাবে তাঁর যে সাহিত্যকীর্তিকে দাঁড় করানো যায়, সেটিই ওই ত্রিপিটক। সেসবের ভেতরে যত মানুষ আমরা দেখি, তাঁরা সব উপস্থিত হয়েছেন স্বনামে। ঐতিহাসিক চরিত্র, নেতা, সংগঠক বা বিপ্লবী—সবাই-ই গোর্কির প্রত্যক্ষ বাস্তব। আমরা জানি, তিনি স্বশিক্ষিত ছিলেন। পৃথিবীর পথে ও পৃথিবীর পাঠশালায় থেকে আমরা তাঁর পঠনপাঠনের গভীরতা ও কৌতূহলের ব্যাপ্তি টের পাই এবং বুঝতে পারি, এ তথ্যটুকু কতটা ঊনকথন! জারের আমলেও সাধারণ সামাজিক আবহাওয়াটুকু যে মননচর্চার জন্য কতখানি অনুকূলে ছিল, কতদূর পর্যন্ত—বিশ্বসাহিত্যের সম্ভার রুশ অনুবাদে সেসব ছবি আমরা স্পষ্টভাবে সেখানে দেখতে পাই। আমাদের পক্ষে সহজেই বিশ্বাস জন্মায় যে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাবঞ্চিত এই মানুষটি শুধু ‘শিক্ষিত’ই নন, বিশ্বকৌষিক জ্ঞানের ভান্ডারি ছিলেন। আমাদের সম্মুখে ভাস্মর হয়ে ওঠে একরোখা, আত্মপ্রত্যয়ী, অদম্য একজন মানুষের বেড়ে ওঠার প্রতিমা।
কিন্তু তলস্তয় কিংবা গোর্কির ত্রিপিটক দুটির ধাঁচ ভিন্ন। অবশ্য কট্টর বিচারে বলতে গেলে, এ দুটির মধ্যে গোর্কির চেয়ে তলস্তয় বেশি পড়বেন আত্মজীবনীর চৌহদ্দিতে। আত্মজীবনী ও আত্মজৈবনিক উপন্যাসের মধ্যে যতটুকু না পার্থক্য আছে, সেটুকু ঘোলাটে হয়ে ওঠে, যদি সে রচনা গোর্কির এই তিনটি বইয়ের মতো হয়। আত্মজীবনীতে উত্তম পুরুষে না বলে গত্যন্তর থাকে না, কিন্তু এমন উপন্যাসও তো অগণিত রয়েছে, যেখানে কাহিনির বয়ান উত্তম পুরুষে, নায়ক-নায়িকার জবান ও দৃষ্টিকোণ থেকে। এই সাধারণ লক্ষণে এদের চরিত্র শনাক্ত করা যাবে না। আমার বিচারশক্তি যেটা বলে, প্রধান পার্থক্য ঘটনা উপস্থাপনে ও বর্ণনার ভঙ্গিতে দেখা যায়। আত্মজীবনীর এক সাধারণ লক্ষণ সম্ভবত সমতলতা (flatness), মন্থর প্রবহমানতা ও কাহিনির একরৈখিকতা।
গোর্কি যখন দিয়েৎস্তভ (শৈশব), ফ্ লিইদিয়াখ (জনারণ্যে), মই-ই উনিভের্সিতিয়েতি (আমার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো) নাম দিয়ে তাঁর আত্মজৈবনিক ত্রিপিটকগুলো প্রকাশ করেন, তখন তিনি খ্যাতির মধ্যগগনে। তত দিনে তিনি তলস্তয়, চেখভ, লেনিন, এইচ জি ওয়েলস, প্লেখানভ প্রমুখের ভীষণ অন্তরঙ্গ। এই তিনটি বই ওই অর্থে উপন্যাস নয়, যে বিচারে মা কিংবা ক্লিম সামগিন বা আর্তামোনভদের ক্রিয়াকলাপ উপন্যাস। তবু ১০-১২ বছর ধরে লেখা এই ত্রিপিটকের প্রতিটি খণ্ড বিশ্বব্যাপী গোর্কির অভাবনীয় ও বিস্ময়কর জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছে।মানুষ ও শিল্পী ম্যাক্সিম গোর্কি আমৃত্যু সেই সৌন্দর্য ও মানবিকতার সাধনা করে গেছেন। তাঁকে সার্ধশত জন্মবার্ষিকীর অফুরান শুভেচ্ছা।
ম্যাক্সিম গোর্কি নামটি প্রকৃতপক্ষে তাঁর লেখক-নাম। নিজেরই উদ্ভাবিত, স্বনির্মিত। তাঁর পরিবার-প্রদত্ত নাম ছিল আলেক্সিয়েই। পুরো নাম আলেক্সিয়েই ম্যাক্সিমভিচ পেশকভ। বাবার নাম ম্যাক্সিম ছিল বলে জুড়েছিল ‘ম্যাক্সিমভিচ’ বা ‘ম্যাক্সিমের পুত্র’ শব্দটি আর পিতৃবংশের পদবি হিসেবে পেশকভ। রুশ ভাষায় ‘গোর্কি’ শব্দের অর্থ তিক্ত, তেতো বা কটু স্বাদ। গোর্কির পিতা ছিলেন ঠোঁটকাটা ধরনের। তাই তাঁকে অনেকে ডাকতেন ‘গোর্কি’ বলে। ছেলে কি বাবার এই নামটিই নিলেন লেখক-নাম হিসেবে? নাকি নিজের জীবনের ও জগতের তিক্ততাকে লেখায় তীব্রভাবে ফুটিয়ে তুলবেন—এমন আকাঙ্ক্ষা থেকেই এই নাম ধারণ করেছিলেন তিনি? ১৮৯২-এর ১২ সেপ্টেম্বর রাশিয়ার ৎবিলিসি শহর থেকে প্রকাশিত কাফ্কাজ্ পত্রিকায় তাঁর ‘মাকার চুদ্রা’ গল্পটি বেরোয় এই ম্যাক্সিম গোর্কি নামেই। সেই থেকে দুনিয়াজুড়ে ম্যাক্সিম গোর্কি নামের চিরস্থায়ী হওয়ার শুরু।
রুশ বিপ্লবের প্রতি আন্তরিক সমর্থন থাকলেও বিপ্লব-পরবর্তী সরকারের সব কর্মকাণ্ড নির্দ্বিধায় মেনে নেননি গোর্কি। পত্রিকার কলামে বলশেভিকদের নানান বিষয়ে দ্বিমত জানিয়ে লিখেছেন কলাম। তাঁর সেই সব আক্রমণাত্মক নিবন্ধ পড়ে জোসেফ স্তালিনের মন্তব্য ছিল, যদি গোর্কি বিপ্লবের পথ পরিহার করেন, তবে তিনি নিক্ষিপ্ত হবেন বিস্মৃতির গর্ভে। কিন্তু ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ বরাবরই অটুট ছিল তাঁর। লেনিনের কাছে একাধিক ঘটনার প্রতিকার চেয়ে গোর্কি একের পর এক চিঠিও লিখেছিলেন তখন। কখনো কোনো তরুণী কবি, রসায়ন বিজ্ঞানী বা লেখক বন্ধুর গ্রেপ্তারের খবর জানতে পেরে তাঁদের দ্রুত মুক্তির অনুরোধ জানিয়ে পত্র পাঠিয়েছেন। কখনো বা বই প্রকাশনায় আমলাতান্ত্রিক বাধানিষেধের প্রাবল্য দেখে ক্ষোভে ফেটে পড়ে তা দূর করতে আহ্বান জানিয়েছেন লেনিনকে। লেনিন যে তাঁর পত্রাঘাতকে উপেক্ষা করতেন, তা নয়। যতখানি সম্ভব ব্যবস্থা নিতেন। তবে লেনিনের মৃত্যুর পর, স্তালিনযখন সোভিয়েত রাশিয়ার সর্বেসর্বা, সে সময় গোর্কি আর এমন ভূমিকায় সরব ও সক্রিয় থাকতে পারেননি।
গোর্কি যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়েছিলেন ১৯২১ সালেই। লেনিন তাঁকে চিকিৎসার জন্য বাইরে পাঠিয়েছিলেন। সাত বছর নানা জায়গায় কাটিয়ে স্বদেশে ফেরেন ১৯২৮ সালে। কিন্তু নিরাময় পূর্ণরূপে হয়নি। যক্ষ্মার চিকিৎসা চলার সময়ই ১৯৩৬ সালের ১৮ জুন সকাল ১১টা ১০ মিনিটে তিনি মারা যান। তৎকালীন সরকার গোর্কির চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে তাঁকে বিষ প্রয়োগে হত্যার অভিযোগ আনে। কয়েকজনকে শাস্তিও দেওয়া হয়। সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির কয়েকজন নেতাকেও সন্দেহের তালিকায় এনে তাঁদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। সংশয়ীদের ধারণা, এটি আদতে স্তালিনেরই কীর্তি; পার্টির কুকর্মের একজন দৃঢ়চেতা সমালোচককে সরিয়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর অপছন্দের ব্যক্তিদেরও দল থেকে উৎখাত করার জন্য তিনি অত্যন্ত সতর্কভাবে এই কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন।
Be the first to comment