রাজিত বন্দোপাধ্যায় –
ঠোটে অ্যাসিড বোতলটা ছুঁয়াতে ছুঁয়াতে রণবীর ভাবছিল একি মোহজাল তার চারিদিকে বিস্তার করে আসছে ! যাকে ভালোবাসি সে কোন প্রতিবাদ করে না , পাড়া পড়শির ঘুম নেই কেন ? যখন চোখের উপরে রাজনৈতিক লোকেরা ব্যভিচার চালায় তখন এনারাই কেমন চুপ করে সহে যায় । ভোটের সময় সুরসুরিয়ে গিয়ে ভোট দিয়ে আসে ! রাজনীতির লোকেদের বেলায় মেয়ে , বৌ , বোন নির্বিশেষে এগিয়ে যেতে দেখেও না দেখার ভান করে যদি না বিরোধী দল থাকে । রেপিস্টদের সংরক্ষক হয় ! আর সেতো কেবল শমিতাকে ভালোবেসে ছিল । বুঝি বা দু এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল মেঝেতে । প্রেমিকা , নিজের , পরিবার না দেশের জন্য তা বুঝতে পারল না । বোতলের মুখটা টপ করে জিবে ঠেকাল রণবীর ।
সমনপুরে হইহই রইরই পড়ে গিয়েছে । ক্লাবের ছেলেরা তক্কে তক্কে থেকে ধরে ফেলেছে ছেলেটাকে । যে যার ইচ্ছে মত চড় থাপ্পর , কিল ঘুষি ইত্যাদি ইত্যাদি দেবার পর ক্লাবের বারান্দার টিনের চালের খুঁটিতে আপাতত বাঁধা হয়েছে আশিকটাকে । মুখের অবস্থা বীভৎস । কষ বেয়ে রক্তের ধারা গালের উপর দিয়ে এসে জমেছে মেঝেয় ।
— দ্যাখ পরের ঘরের বৌয়ের সাথে প্রেম করার মজা টা ।
কথা টা বলে বয়স্ক সেক্রেটারী অরিজিৎ বাগচী ছেলেটার দিকে চেয়ে ভেংচী কাটছিল । সামনে পড়ে যাওয়া রথীন জোয়াদ্দার কএ বললে ,
— কী বল মাষ্টার ?
রথীন বললে ,
— আমি বললে শুনতে খারাপ লাগবে ।
— তা কী খারাপ শুনি ?
রথীন খানিক জুলজুল চোখে অরিজিৎ কে দেখে নিয়ে বলল ,
— ঐ বিশ্বজিত কেও তো এমনি সাজা দিতে হয় , আহা কাউন্সিলারের ভাইপো , মিকা পিসীর ছেলের বৌটার সাথে , কী কেচ্ছা — কী কেচ্ছা ! সে সময় ক্লাব কেন নীরব হে ? কাউন্সিলারের ভাইপো বলে না পার্টির ভয়ে ? নাকি ক্লাবের সরকারী দলের অনুমোদনে আসা টাকা ইত্যাদি বন্ধ হবে বলে — হ্যাঁ ?
দাঁত কিড়মিড়িয়ে কিছু একটা বলতে যেয়েও না বলে অন্যদিকে প্রস্থান করলে অরিজিৎ । রথীন মাষ্টার কে সবাই তার ঠোঁট কাটা জবাবের জন্য ডরায় । আশে পাশে জড়ো হওয়া তামাশা দেখনেওয়ালারা হ্যা – হ্যা – হ্যা – হ্যা করে হেসে উঠল ।
পুলিশের কাছে যখন ক্লাব থেকে রণবীর কে দিয়ে গেল , সব শুনে পুলিশ অফিসার হাঁ ! কেবল অরিজিৎ কে বললেন ,
— আর একটু বেশি হলে তো হয়েই গিয়েছিল । কী যে করেন । জানবেন এরা অপরাধী নয় । ভদ্র ঘরের ছেলে । বৌটি বা তার স্বামীর পক্ষ থেকে কোন অভিযোগ নেই থানায় । এ অবস্থায় আপনাদেরকেই আমাকে অ্যারেষ্ট করতে হয় । ক্লাবের সবাই নড়ে চড়ে বসল ।
— স্যার এর আগেও ওকে আমরা বুঝিয়েছি । কিন্তু …
অরিজিতের কথা কেটে অফিসার বলে উঠলেন ,
— আপনারা কি এলাকার শাসক হয়ে উঠলেন নাকি ! আমরা তবে কী করতে আছি ?
স্তব্ধ হল ক্লাব সদস্যরা ।
দুপুরের দিকে দেখা করতে এল রণবীরের বন্ধু । ঘরে না বলবার আবেদন বার বার রণবীরের গলায় শোনা গেল । বন্ধু বিদায় নিলে লকাপে ঝিম মেরে বসে রইল রণবীর । মনে পড়ল জেনারেল হাসপাতালের মোড়ে যে প্যাথোলজিক্যাল টা আছে সেখান থেকে প্রথম বার নিজের টোটোতে তুলেছিল শমিতা আর তার বর কে । শমিতা তাদের এলাকার মেয়ে । হাইস্কুলে তার দু ক্লাস নীচে পড়ত । সেই শুরু । তার টোটো থেকে নেমে হঠাৎই ঝাপ দিতে গিয়েছিল রেল লাইনের দিকে । শমিতার চিৎকারে সে টোটো লক করে ছুটে গিয়েছিল ওর স্বামী কে বাঁচাতে । ছুটে আসতে থাকা বনগাঁ লোকাল থেকে এক চুলের জন্য ছাড়িয়ে আনতে পেরেছিল তাকে । সেদিন শোনে শমিতার স্বামীর নাকি পুরুষতায় গন্ডোগোল আছে ! তারপর দরকারে অদরকারে তার সাথে রণবীরের ঘন ঘন দেখা হতে থাকে । ধীরে ধীরে পরনারী হলেও একটা মোহ জালে পড়ে গিয়েছিল সে । তার পরিণতি এই । বাড়ী তে কী করে মুখ দেখাবে সে । হঠাৎ সে অনুভব করল তার লঘুক্রিয়া ।
পুলিশ টা তাকে টয়লেটে ঢুকিয়ে দিয়ে বাইরে দাঁড়াল । পেচ্ছাব করে ফিরে আসছে হঠাৎ টয়লেটের এক কোণে পড়ে থাকা অ্যাসিডের বোতল টা চোখে পড়তেই থমকে দাঁড়াল সে । তার মনে হল এ জাল থেকে বাঁচতে হলে এই একটা মাত্র পথ তার সামনে খোলা আছে । অ্যাসিড টা গলা বেয়ে নীচের দিকে নেমে যাচ্ছে । যন্ত্রনায় কাঁপতে শুরু করল রণবীর । চোখের সামনে অন্ধকার নেমে আসতে লাগল তার ।
বিশ মিনিট পার হয়ে গিয়েছে অনতি দূরে দাঁড়িয়ে থাকা কনেষ্টবলের সাথে কথা বলতে বলতে । ছেলেটার এখনো হয়নি ! সন্দেহ হওয়ায় সেপাই দরজা খুলে ভিতরে ঢুকতেই দেখল রণবীর মেঝেতে লুটিয়ে ! হাঁক ডাকে থানা শুদ্ধ সবাই জড়ো হয়ে গেল টয়লেটে । তাড়াহুড়ো করে জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে গেল ছেলেটাকে পুলিশ । দেখে টেখে গম্ভীর ভাবে মাথা নাড়লেন ডাক্তার । আর রণবীর ততোক্ষণে পাড়ি জমিয়েছে এক অজানার দিকে । কেউ হা হুতাশ করেনি , হয়তো চোখের জলও ফেলেনি ঝরে যাওয়া একটা তরুণ ফুলের জন্য ! কেবল সাথী ছিল একরাশ লজ্জা ও অনুশোচনা ।
Be the first to comment