তপন মল্লিক চৌধুরী
সুচিত্রা সেন আমদের প্রিয় নায়িকা। রূপালি পর্দার নায়িকারা সাধারণত ছবির দৃশ্য ছাড়াও থাকেন আমাদের একদিন প্রতিদিনের গল্পে, আড্ডায়, আমরা তাঁদের স্বপ্নেও দেখি; কী অপরুপা,কী মহীয়সী,কী ব্যক্তিত্বময়ী। কী অদ্ভুত তাঁদের চলাচল, কী অপূর্ব তাঁদের ভঙ্গিমা। কখনো স্নেহময়ী, বিনয়ী, নম্র, কখনো তীক্ষ্ণ, ভীষণা, ভয়ংকরী… যুগ যুগান্ত ধরে তাঁদের মোহময়ী হাসি, শরীরী আবেদন আমাদের ঘুমে জাগরণে বড় বেদনার মতো যেন বেজে চলে। প্রাত্যহিকতায় আমরা ক্লান্ত হই; প্রিয় নায়িকার মুখ যেন প্রিয়ার ছায়ার মতো বাতাস দেয়। রাগ-ক্ষোভ-বিরক্তি-ঘেন্নায় বিপন্ন হই; প্রিয় নায়িকার মুখই মনে পড়ে। কিন্তু নায়িকা সুচিত্রা সেন ওইসব নায়িকাদের ছাপিয়ে যান, কারন তিনি কেবল রূপালি পর্দার নায়িকা নন, ‘সপ্তপদী’, ‘দ্বীপ জেলে যাই’, ‘হসপিটাল’, ‘সন্ধ্যা দ্বীপের শিখা’, ‘উত্তর ফাল্গুনি’, ‘কমললতা’, ‘স্মৃতিটুকু থাক’…ছবিগুলির অভিনীত চরিত্রও নন। আসলে সুচিত্রা সেন—এই নামের সঙ্গে বাঙ্গালি সমাজ-জীবন-সংস্কৃতিতে জড়িয়ে আছে বহু রকমের কল্পনা, অনেক ধরণের আবেগ, শুধু উপলব্ধি করার মতো কিছু এবং আরো কিছু।
না, সুচিত্রা সেন নিয়ে এটুকু বললে অনেককিছু না বলা থেকে যায়। তাই তাঁর কথা ফের এভাবে শুরু করা যায়, তিনি বঙ্কিমের দেবী চৌধুরানী, প্রফুল্ল। তিনি শরতবাবুর রাজলক্ষ্মী, পিয়ারীবাঈ, অচলা, বিজয়া, পার্বতী। তিনি তারাশংকরের রিনা ব্রাউন। তার মানে বাংলা সাহিত্য থেকে চলচ্চিত্র পরিক্রমায় তিনি সঙ্গী হয়েছেন। এদিক দিয়ে আমাদের সমাজ-সংস্কৃতির তিনি যে শরিক এই ঘটনা মানতেই হয়। পর্দায় ‘দেবী চৌধুরানী’, ‘রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত’, ‘গৃহদাহ’, ‘দত্তা’, ‘দেবদাস’, ইত্যদি আখ্যান দেখতে দেখতে আমারা যে কাহিনিস্রোতে উজান বাই তা কি শুধু নাটকীয় ঘটনাবলীর কারণে, না কি শুধু দেবী চৌধুরানী, রাজলক্ষ্মী বা পিয়ারীবাঈ, অচলা, বিজয়া, পার্বতী অথবা রিনা ব্রাউন-এর জন্য? উপন্যাস পাঠের যা কিছু আনন্দ তা কেবল সাহিত্য সম্রাট, কথাশিল্পী অথবা লেখকের কাহিনি নির্মানের মুনশিয়ানা এ তো রসিকমাত্রেই মানবেন কিন্তু, পর্দায় যে পার্বতী, বিজয়া, অচলা, রাজলক্ষ্মীকে হবে, কাহিনির ঘটনা পরম্পরায় যে দেখি,মুগ্ধ হই,আপ্লুত হই,আবেগে ভাসি তা তো সুচিত্রা সেনের কারণেই।
ব্রিটিশদের জমানায় পূর্ববঙ্গ অধুনা বাংলাদেশের পাবনায় তাঁর জন্ম। দেশ স্বাধীন হওয়ার বছর পাঁচ পরে তাঁর সিনেমা জীবন শুরু। একই সঙ্গে আড়ালে চলে যায় তাঁর আসল নাম রমা। রমা মানে লক্ষ্মী। সেটি কিন্তু একটি দিনের জন্য আড়াল হয়নি বাংলা সিনেমার ব্যবসায়িক ক্ষেত্র থেকে। বাংলা ছবির রাজলক্ষ্মী বানিজ্যে বসত লক্ষ্মী থেকেই গিয়েছেন। তাঁর অভিনীত অধিকাংশ ছবি বক্স অফিস হিট। প্রযোজক থেকে শুরু করে প্রেক্ষাগৃহের মালিক সবার ঘরেই লক্ষী দিয়েছে। সেদিক থেকে রমা সুচিত্রা হলেও বাংলাছবির বানিজ্যক্ষেত্রে ধনলক্ষ্মী।
প্রথম ছবি ‘শেষ কোথায়’ মুক্তি পায়নি। পরের বছর অভিনয় করলেন একটি নয় চারটি ছবিতে, ‘কয়েদি নম্বর সাত’, ‘ভগবান শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য’, ‘কাজরী’ এবং ‘সাড়ে চুয়াত্তর’। উত্তমকুমার এবং সুচিত্রা সেন এই জুটির প্রথম ছবি ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ দর্শকদের ভাল লাগায় পেল অভাবনীয় সাফল্য। এরপর সুচিত্রা সেন বাংলা ছবির দুনিয়ায় হয়ে উঠলেন সুপার হিট নায়িকা, আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ বা সাফল্যের চাবিকাঠি।
পরের বছর সুচিত্রা উত্তম জুটি মিলিয়ে ন’টি ছবি মুক্তি পেয়েছিল, এরমধ্যে সুপার হিট করেছিল একাধিক। প্রায় প্রত্যেক বছরই তাঁর হিট ছবির সংখ্যা বাড়তে থাকে যেমন, জনপ্রিয়তা, তাঁকে ঘিরে উন্মাদনা, কৌতূহলও বাড়তে থাকে আরো বেশি। সুচিত্রা সেন মন প্রান দিয়ে সেগুলি উপভোগ করতেন, এ নিয়ে তাঁর অহংকারও ছিল যথেষ্ঠ। বহু সময়েই পরিচালকদের নির্দেশ দিয়েছেন তিনি, তাঁর কথা অনুযায়ী চলতে প্রযোজকদের, সহ অভিনেতা-অভিনেত্রীদের তুচ্ছ জ্ঞান করতেন, বহু যোগ্য, গুণী অভিনেতাকেও না জেনে বুঝে অবহেলা উপেক্ষা করেছেন।
কিন্তু এসব ঘটনা নায়িকা সুচিত্রার খ্যাতি ও জনপ্রিয়তায় আঁচড় বসাতে পারেনি। ‘দত্তা’ ও ‘প্রনয়পাশা’ ছবির পর তিনি রূপালি পর্দায় আর কখনো ফিরে আসেন নি, নিজেকেও অন্তরিন করেছিলেন। ফিরিয়ে দিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়ের ছবির প্রস্তাব। উত্তমকুমারের সঙ্গে প্রায় তিরিশটি ছবি ছাড়াও সুচিত্রার নায়কদের তালিকায় ছিলেন সৌমিত্র,বসন্ত, আশোকুমার, ধর্মেন্দ, দেবানন্দ, দিলীপকুমার প্রমুখ। হিন্দি বাংলা মিলিয়ে ছবির সখ্যাও দীর্ঘ। সব মিলিয়ে বাংলা ও বাঙালি হৃদয়ে সুচিত্রা যে দ্বীপ জ্বেলেছিলেন তার শিখা আরো কিছুকাল প্রজ্জ্বলিত থাকবে।
Be the first to comment