আমার শহর কলকাতা; ট্রামলাইনের উপকথা

Spread the love
মাসানুর রহমানঃ
ইতিহাসটা বহু পুরানো, তিলোত্তমা কলকাতার বুকে সে যেন এক চলন্ত নেকলেস। তাই মহানগরীর বুকে চলতে থাকা ট্রাম একরাশ শোভা বাড়িয়েছে আমার শহরের। ১৮৭৩ সালে কলকাতায় চালু হয় ঘোড়ায় টানা ট্রাম তারপর ১৮৯৮ সালে হয় বাষ্পে, তারও পরে ১৯০২ সালে বিদ্যুৎচালিত ট্রাম চলতে শুরু করে।
একটু খুঁজলেই জানতে পারবেন পৃথিবীতে খুব বেশী শহরে এত পুরোনো ট্র্যাম আর নেই। এশিয়ায় কলকাতার পরেই এখনো চলছে এমন ট্র্যাম আছে টোকিয়োতে। ঐতিহাসিক দিক থেকে কলকাতার ট্র্যাম যে খুবই প্রাচীন ও গুরুত্বপূর্ণ সেবিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায় কলকাতা শহরে ট্রাম চালাবার বিষয় নিয়ে ভাবনা-চিন্তার সূত্রপাত হয় ১৮৬৭ সাল থেকে। ১৮৭০ সাল নাগাদ ভারত সরকার বেঙ্গল গভর্নমেন্টকে শিয়ালদহ রেলস্টেশন থেকে পণ্য পরিবহনের উদ্দেশে ট্রাম চালাবার প্রস্তাব দিল। ভারত সরকারের প্রস্তাব অনুসারে বাংলার গভর্নমেন্ট শিয়ালদহ থেকে পশ্চিমে গঙ্গার তীরে আর্মেনিয়ান ঘাট পর্যন্ত ট্রামের লাইন পাতবার জন্য এক লক্ষ টাকা মঞ্জুরও করল। যদিও এই আর্মেনিয়ান ঘাটের কাছ থেকেই তখনকার দিনে হাওড়া স্টেশনে যাওয়ার কাঠের খোলা ব্রিজে উঠতে হত। আর এখানেই ছিল ইস্ট ইণ্ডিয়া রেলের কলকাতা স্টেশন বা টিকিটঘর। অর্থাৎ এখান থেকে টিকিট কেটে নিয়ে ব্রিজে উঠে হুগলি নদী পেরিয়ে হাওড়ায় গিয়ে ট্রেন ধরতে হত। তাই এই  শিয়ালদহ থেকে হাওড়া পর্যন্ত ট্রাম চালনোর পিছনে একটি প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল তা হল এই গঙ্গার পূর্বপাড়ের গ্রামগুলি থেকে যে সব পণ্য শিয়ালদহে আসত ট্রামে করে সেগুলিকে হাওড়া স্টেশনে নিয়ে গিয়ে সেখান থেকে দেশের অন্যান্য স্থানে ছড়িয়ে দেওয়া এবং এর ফলে এক সুন্দর যোগাযোগ গড়ে উঠতে লাগল।
১৮৭৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথমে দেড় লক্ষ টাকা ব্যয়ে শিয়ালদহ থেকে আর্মেনিয়ান ঘাট পর্যন্ত ট্রাম লাইন পাতার কাজ শেষ হল। প্রত্যেক কামরার আগে দুটি করে মোট ৬টি ঘোড়া-সহ তিন কামরার ট্রাম। দ্বিতীয় গাড়িটিতে একটি প্রথম শ্রেণী ও একটি দ্বিতীয় শ্রেণীর কামরা। এতেও প্রত্যেক কামরার সঙ্গে দুটি করে মোট চারটি ঘোড়া। শুরু হল ভারতবর্ষে প্রথম ট্রাম যাত্রা। প্রায় ৯ মাস চলবার পর লোকসানের কারণে এটা বন্ধ করে দিতে হয়। এই ঘটনার বছর পাঁচেক পরে কলকাতার কয়েকজন অগ্রণী ব্যবসায়ী বাণিজ্যিক ভাবে ট্রাম চালানোর উদ্দেশে গঠন করলেন ‘ক্যালকাটা ট্রামওয়েজ কোম্পানি’। ১৯৭০ নাগাদ হাওড়া শহরের ট্রামপথ বন্ধ করে দেওয়া হয়। স্বাধীনোত্তর যুগেও বেশ কিছুকাল ক্যালকাটা ট্রামওয়েজ কোম্পানি ছিল ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রণে। ১৯৫১ থেকে প্রস্তুতি নিতে নিতে শেষে এক অর্ডিন্যান্স জারি করে, ১৯৬১-র ৮ নভেম্বর থেকে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ট্রাম কোম্পানির ভার গ্রহণ করে।
একটা সময়ে সারা কলকাতা জুড়ে প্রায় ৪৯ মাইল বা তারও বেশি ট্রামপথ ছিল। এখন তা অনেকটাই কমে গিয়েছে। আস্তে আস্তে দেশের অন্যান্য জায়গা যেমন কানপুর, চেন্নাই, দিল্লি, মুম্বই-তে ট্র্যাম উঠে গেছে যথাক্রমে ১৯৩৩, ১৯৫৫, ১৯৬২ ও ১৯৬৪ সালে। কলকাতাতেও তুলে দেবার কথা হয়েছিল ১৯৭০ সালে, কিন্তু নানা কারণে আজোও কলকাতার বুকে রয়ে গেছে “তিলোত্তমার পুরানো গহনা”। তবে ইদানিং ট্রাম নিয়ে নতুন করে ভেবেছে বর্তমান সরকার। একটি ট্রাম মিউজিয়াম গড়ে উঠবে, এসি ট্রাম চালু হবে মহানগরীতে, এছাড়াও বিয়ের আসরও সাজবে ট্রামে। যতদিন ধরে রাখা যায় এভাবেই টিকে থাকুক আমার তিলোত্তমার পুরানো ঐতিহ্যবাহী ; ট্রাম।।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*