লেখক – পবিত্র চক্রবর্তী –
১
রাক্ষসরাজ কুম্ভকের সাথে বিবাদ বহুদিনের । কুম্ভকের আদেশে রাক্ষসদল বিশাল রাজ্যে প্রায়ই হানা দেয় । কখনও হাতি মারে তো কখনও আবার ঘোড়া মারে ।
গত রাতে মুলোর মত দাঁত বার করে প্রকান্ড রাক্ষসের দল ধরে নিয়ে গেল কয়েকটা মানুষকে । সাধারণ প্রজারা বাধা দিতেই আসলে রাক্ষসরা পায়ের তলায় পিষে মারে । তারপর কুম্ভকরাজাকে খুশী করার জন্য আঁধারের আকাশ আরো অন্ধকার করে শোঁ শোঁ করে ঝাঁকে ঝাঁকে রাক্ষসরা উড়তে উড়তে চলে যায় ।
হাতি ঘোড়া পাখী তাও কষ্ট করে মেনে নেওয়া যায় ! কিন্তু মানুষ ! বিশালরাজের কানেও পৌঁছায় কথাটা । রাজা ক্ষেপে আগুন ।
রাজসভার মধ্যে তিনি চীৎকার করে ওঠেন –
“ হাতি ঘোড়া গেল এতকাল –
কুম্ভক করবে দেখছি মানুষেরও আকাল !”
রাজার মূর্তি দেখে মন্ত্রীরাও ভীত । তারাও চিঁ চিঁ করে একসাথে হতাশার সুরে বলে –
“ সেই তো আকাল, বড়ই সমস্যা –
প্রাসাদ বানাবে কারা, গেল সব আশা !”
কটমট করে রাজা একে একে সব মন্ত্রীদের দেখেন । শেষে হুঙ্কার ছড়ে বলে –
“খাঁচায় বন্ধী আমার রসহরি –
কথা কম ; নিয়ে এস তারে তড়িঘড়ি ।”
রসহরি হল বিশালরাজার সাধের পাখী । কোন এক কালে রাজা মৃগয়া করতে গিয়ে দেখেন এই কথা বলা পাখীকে । যেমন তার রূপের বাহার, তেমনি মানুষের মত কথা কয় ।
রাজা বেচারীর ডানা দুটি কেটে হীরের খাঁচায় দানা পানী খাইয়ে সেই থেকে তার মহলে রেখে দিয়েছে । মাথা খুঁড়েও রসহরি না পারে ভাঙতে খাঁচা , না পারে খাঁচায় বসে আগের মত প্রাণখুলে গাইতে ।
রাজার দাসী নিয়ে আসে হীরার খাঁচায় রসহরিকে । রাজা আহ্লাদিত হয়ে জানতে চায় –
“ বাবা রসহরি,বাক্য সুধাময় –
রাক্ষসের দল করে উৎপাত
বল নিরাময় !”
পাখী চুপ করে মাথা নীচু করে থাকতেই রাজা ভয় পেয়ে যায় । মন্ত্রীরাও হাঁ করে চেয়ে থাকে । তাদের মধ্যে একজন বলে ওঠে –
“ ঘাড় হেঁট করছে গণনা –
খানিক পরেই দেবে বর্ননা ।”
রসহরির ঠোঁট খোলে , রাজার পানে চেয়ে কয় –
“ গজমতি চাই, করতে হবে খনন –
দুধসাগরের আছে তলে ,
রাজা আর রাক্ষস এক হলে-
সব সমস্যার হবে নিরসন ।”
রসহরির হেঁয়ালি কথায় রাজার মুখে যেন আগুনের রেশ । ডেকে পাঠান প্রধান মন্ত্রীকে গোপন শলার জন্য ।
২
বহু বছর ধরেই বিশালরাজ রাজ্যের লোকদের নিয়ে প্রকান্ড সব প্রাসাদ বানিয়ে চলেছে । গাছপালা-নদী-খাল প্রায় নিঃশেষ ! সেখানে আজ সকাল সন্ধ্যে ফড়ফড় করে ওড়ে বিশালরাজের নিশান ।
গরীব প্রজা-শ্রমিকদের আস্তানা সেই কুঁড়ে ঘরে , রাজ্যের শেষ প্রান্তে । ভোর হতেই তারা শুরু করে প্রতিদিনের মত আরেক ভবন নির্মান ।
কুম্ভকরাজ এতদিন এসব দেখেও সহ্য করেছিল । কিন্তু যখন দেখল বিশালরাজা তৈরী করতে চলেছে বিশ্বের সেরা মায়াপ্রাসাদ তখন আর নিজেকে স্থির রাখতে পারল না ।
মায়াপ্রাসাদ তৈরী হলেই রাক্ষসদের সঙ্কট ! প্রাসাদের মায়া আর মন্ত্রের শক্তিতে বিশালরাজ্যের সীমানায় রাক্ষস-দানব আসলেই সব ধ্বংস হয়ে যাবে । মায়াপ্রাসাদের কাজ বন্ধ করতে হলে শ্রমিকদের খেয়ে ফেলাই একমাত্র উপায় ।
শ্রমিক-প্রজা মরলে রাজার আফসোস একটাই , প্রাসাদ তৈরীর কাজে ব্যাঘাত । রাজা পরেছে আরেক সমস্যায় ! দুধসাগর কোথায় ! নামটা যে সে শোনে নি তা নয় ! তবে রাজ্যে এত প্রাসাদ , সবই তো খাল-বিল মাটি ফেলে তৈরী করেছে , তাই সঠিক স্থানের হদিস পেতে অসুবিধা হচ্ছে !
সেদিন রাতে মন্ত্রীর সাথে আলোচনা করে কুম্ভক রাজার দরবারে দূত পাঠিয়েছে । দূত ভয়ে ভয়ে রাক্ষস দরবারে ঢুকতেই দেখে রাজা কুম্ভক প্রকান্ড এক মণিমাণিক্য বসানো হাড়ের সিঙ্ঘাসনে আধশোয়া অবস্থায় রাজকার্জ সারছে ।
দূত লম্বা এক পেন্নাম ঠুকে বলে ওঠে –
“ এসেছি বিশালরাজের দূত হয়ে –
করি নিবেদন ,
রাজা আপনার সাথে রয়ে –
আনিবে গজমতির ধন ।”
কথাটা শুনেই গনগনে ভাঁটার মত চোখ লাল করে রাক্ষসরাজ বলে –
“ গজমতি ! কী সে !
আমি তো জানি না যে !”
দূত পুনরায় বলে –
“ আজ্ঞে , রাজা রাক্ষস করি কাজ সমাপন –
গজমতি নেবেন, রাজার এই নিবেদন ।”
কথা শেষ করেই দূত দ্রুত প্রস্থান করে । এর বেশী বলা বারণ । বিশালরাজা জানে গজমতির স্পর্শেই রাক্ষসকুল ধ্বংস হবে । রাক্ষসরাজও রত্নের লোভ সামলাতে পারবে না ! অর্থাৎ এক ঢিলে দুই পাখী । সব থেকে বড় ব্যাপার রাক্ষসের সাহায্য না নিলে দুধসাগরের হদিসও মিলবেই না , রত্ন পাওয়াও অসম্ভব !
৩
দূতের মুখে প্রস্তাব শুনে কুম্ভকের লোভের শেষ নেই ! সে রাতেই আকাশে ভর করে উড়ে যায় বিশালরাজার সভায় ।
তাকে দেখেই চালাক বিশালরাজ বলে ওঠে –
“ আরে এস এস বন্ধুবর
এনেছো নিশ্চয়ই সুখবর !”
এই বাক্যে ভিড়মি খাওয়ার জোগাড় কুম্ভক । প্রাকান্ড মূর্তি ফুলিয়ে জবাব দেয়-
“ দেখ রাজা , উদ্দেশ্য কী, কেন দেবে রত্ন !
বহুকালের সংঘাত ভুলি আজ কেন এত যত্ন !”
রাজা জিভ কেটে বলে –
“ যুদ্ধ যুদ্ধ করে কী হবে দিনরাত –
গজমতি দিয়ে বাড়াব বন্ধুত্বের হাত ।”
কুম্ভকের মনে ক্রমেই লোভ বেড়ে চলেছে । সে জানায় রাক্ষস রাজ-জ্যোতিষী জানিয়েছে , যেখানে মায়াপ্রাসাদ নির্মাণ হচ্ছে সেখানেই একদা দুধের মত স্বচ্ছ সুবিশাল হ্রদ ছিল । সেই দুধসাগরকে মাটি চাপা দিয়ে তৈরী হচ্ছে বিশ্বখ্যাত ভবন ।
এই কথা শুনে রাজা হকচকিয়ে যায় । শেষে তার সাধের ওই ভবন ভাঙতে হবে ! রাক্ষসরাজের পরের কথায় বিশালরাজ জ্ঞান হারাবার মত অবস্থা । কুম্ভক জানায় সহজে ওই ভবন ভাঙা যাবে না ! রাজ্যের আরও একশটি ভবন , যা গড়ে উঠেছে নদী, পুষ্করিণীর বুকে- সবকটি ভাঙলেই তবে মায়াপ্রাসাদ ভাঙা সম্ভব হবে , নচেৎ নয় ।
বিশালরাজা মেনে নেয় ।
৪
রাক্ষসরাজার আদেশে আকাশ ধুলোয় আচ্ছন্ন করে ভাঙতে শুরু হয় একের পর এক প্রাসাদ । বিশালরাজা দূর থেকে এসব দেখে যায় । যেখান থেকে প্রাসাদ ভাঙছে সেখান থেকেই বেরোচ্ছে নদীর ধারা । আবার কোনটা থেকে কুলকুল করে ছাপিয়ে যাচ্ছে দিঘীর জল !
জলের ছোঁয়া পেতেই শুকনো বিশাল রাজ্যের গাছে গাছে ফুটে উঠল ফুল , নানা পাখী একসাথে গাইল গান । জলের স্পর্শেই চারিধার সজীব ! খাঁচার মধ্যে রসহরিও আনন্দে নাচতে থাকে ।
এদিকে একশো প্রাসাদ নিমেষেই শেষ করে মায়াপ্রাসাদের দিকে হাত বাড়ায় রাক্ষসরাজা কুম্ভক । বিশালরাজার প্রাণ কষ্টে ছটফট করলেও আজ অন্য কারনে আনন্দ লাগছে । প্রাসাদের চাপে যে বাতাস পারছিল না বইতে , এখন সেই বাতাস মনকে জুড়িয়ে দিয়েছে । প্রকৃতিও যেন সেজে উঠেছে !
চক্ষের এক পলকেই কুম্ভক প্রায় ফুঁ মেরে আধ-নির্মিত মায়াপ্রাসাদ উড়িয়ে দিল । তারপর সব রাক্ষসরা দুধসাগরের বুকে জমে থাকা মাটি সরাতেই দুধসাগরের দু’কুল জলে টইটুম্বুর হতে শুরু করে ।
কুম্ভকরাজ চটপট দুধসাগরের তলা থেকে যেই না গজমতি তুলেছে অমনি তা গলে গিয়ে ধোঁয়ায় পরিণত হয় । সেই ধোঁয়ার ছোঁয়ায় সব রাক্ষস পটাপট করে মরতে থাকে ।
কিন্তু একী অপরূপ পরিবেশ ! বিশালরাজা বুঝল খাল-বিল-নদী সব শেষ করে দিলে প্রকৃতি-মানুষের মনও হয়ে ওঠে শুকনো ! রসহরির প্রখর বুদ্ধিতে রাজা খুব খুশী । খাঁচা থেকে তাকে দিল মুক্তি । এখন সে মনের আনন্দে প্রাসাদে ইচ্ছামত ঘুরতে পারে ।।
Be the first to comment