গুচ্ছগল্পঃ জন্ম

Spread the love

পায়েল খাঁড়া –

১.
আজ দশ বছর পর বসাক পরিবারের কূলপ্রদীপ এসেছে।বাড়ির ছোটবউ মালিনীর কোল আলো করে ফুটফুটে একটা শিশু।এতদিন বাদে নাতির মুখ দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েছেন মহেন্দ্রবাবু।নিজের হাত থেকেই দামী আংটি খুলে বকশিস দিয়ে দিলেন বাড়ির চাকরদের।
২.
ভাতটা মুখে তুলতে গিয়ে বুক ফেটে গেল লছমীর।পেটের দায়েই নিজের পেটের সন্তানকে ধনী দম্পতির কাছে বিক্রি করে এসেছে সে__ছেলে বেচার টাকায় আজ অন্ন জুটেছে তার।দারিদ্র্যের ছোবলে নাড়ি ছেঁড়া সদ্যোজাতও বাজারের পণ্য।
৩.
বাড়ির ঝিয়ের ছেলে দীপ্তকে সন্তান জ্ঞানেই মানুষ করেছে রমলা।তার এই মাতৃত্ব পাড়া প্রতিবেশী এমনকি নিজের পরিবারের কাছেও নেহাত ‘আদিখ্যেতা’।আজ সরকারি পরীক্ষায় সারা দেশের মধ্যে প্রথম হয়েছে দীপ্ত।জনৈক সাংবাদিকের অনুরোধে নিজের অনুভুতি প্রকাশে একটা কথাই বলল রমলা, -আমাদের গল্পটা একটু অন্যরকম, এখানে মা সন্তানকে জন্ম দিতে পারেনি বরং এক সন্তানের ভালোবাসাই প্রতি পদক্ষেপে জন্ম দিয়েছে এক মা’কে আর আজ সেই মা তার সন্তানের সাফল্যে গর্বিত।
৪.
টাকা খাইয়ে বে-আইনি ভাবে গর্ভের লিঙ্গ নির্ধারন করিয়েছে শ্রীপর্ণা আর অজিত। এই প্রগতিশীল আধুনিকতায় ফ্যামিলি প্ল্যান সম্পর্কে তারা ভীষন রকম সচেতন।তাদের কম্প্যাক্ট ফ্যামিলিতে একটাই চাইল্ড প্ল্যান করেছে তারা সেটা মেয়ে হোক এটা কোনো মতেই কাম্য নয় তাদের দুজনেরই কাছে।তাই কাউকে না জানিয়েই একটা প্রাইভেট নার্সিং হোম থেকে শ্রীপর্ণার অ্যাবরশন করিয়ে আনল অজিত।শুধুমাত্র স্ত্রী-লিঙ্গ হওয়ার অপরাধে নৃশংসভাবে অপঘাতী হল একটা নিষ্পাপ অজন্মা প্রাণ___হায় রে প্রগতি! 
৫.
এস.আই. ইন্দু চক্রবর্তীর ইউনিফর্মে লাগানো গোল্ড মেডেলটার দিকে তাকিয়ে দু-চোখ আর্দ্র হয়ে উঠল তার বাবা রনদীপবাবুর।তিনি নিঃশব্দে হাত রাখলাম মেয়ের মাথায়। তাঁর স্নেহ সজল চোখের দিকে তাকিয়ে ইন্দু বুঝল বাবার মন থেকে আজ তার জন্মের সমস্ত আক্ষেপ ধুয়ে মুছে গেছে।মেয়ে হিসেবে আজ তার জন্ম সার্থক।
৬.
ভারতের জাতীয় পতাকা ঢাকা শহীদের শবদেহ এনে রাখা হল উঠানে।বাড়ি জুড়ে কান্নার কলরোল।আঁতুড় থেকে সদ্যোজাতকে নিয়ে বেরিয়ে এল তার স্ত্রী রূকসার। কোলের শিশুকে শুইয়ে দিল বাবার রক্তভেজা ইউনিফর্মের উপর।নির্ভীক স্বরে বলল,
-তোর বাবা এ দেশের বীর সিপাহী আর বীরদের গল্প মৃত্যুতে শেষ হয় না।তোর মধ্যে দিয়েই তিনি আবার ফিরে আসবেন আরও একটা জন্ম দেশ মাতৃকার সেবায় উৎসর্গ করতে।”
৭.
আজ একুশ বছর ধরে নিজেকে ক্ষমা করতে পারেন নি ঊষাদেবী।সেদিন লোক লজ্জার হাত থেকে বাঁচতে নিজের গর্ভজাত সন্তানকে আস্তাকুঁড়ায় ফেলে এসেছিলেন আর হয়ত সেই নির্মমতার শাস্তিই তিনি পেয়েছেন__আজ মা হওয়ার সামাজিক ছাড়পত্র পেলেও মাতৃত্বের সুখ থেকে চিরদিনের জন্য বঞ্চিত হয়ে গেছেন তিনি। 
৮.
মস্ত ঠাকুরদালানে সাড়ম্বরে মা মহামায়ার পুজার আয়োজন হয়েছে।ভক্তিভরে গদগদ কন্ঠে চন্ডীপাঠ করছেন জমিদারবাবু স্বয়ং।ঢাকের বাদ্যির তলায় চাপা পড়ে গেল আরেক মায়ের আর্তকন্ঠ।বাড়ির বউ মৃত সন্তান প্রসব করেছে।মায়ের বুকের যন্ত্রনা ছাপিয়ে তার অপরাধটাই মুখ্য হয়ে দাঁড়ালো__ডাইনি অপবাদে বিজয়ায় মৃন্ময়ী প্রতিমার সাথেই অকাতরে বিসর্জন দেওয়া হল রক্ত-মাংসে গড়া এক মা’কে। 

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*