রাজকুমার ঘোষ:
অনেক বিচিত্র লোকের সমাহারে এই আজব দুনিয়া। এই আজব দুনিয়ায় এক আজব পাবলিকের নাম নেপালচন্দ্র সর্দার। তাকে নিয়ে বলতে গেলে অনেক গপ্পের সৃষ্টি হয়, সেই গপ্পের যে কত পাতা হবে তা আন্দাজ করা মুশকিল। নেপোদাদু থুরি নেপালচন্দ্র সর্দারের মতো বিচিত্র মানুষ ও তার কান্ডকর্মের জন্য অনেক মানুষ তাকে অনেক নাম দিয়েছিল। তারই মধ্যে একটা নেপো, আমারা সবাই তাকে আদর করে নেপোদাদু বলি।
নেপোদাদুর বাবা হারাধন সর্দার ধনী লোক ছিলেন। নেপোদাদু ছিলেন তার একমাত্র সন্তান । ছোট থেকেই দাদু খামখেয়ালী এবং চঞ্চল প্রকৃতির ছিলেন । তার বাবা তাকে অনেক চেষ্টা করেছিলেন ভালো করে পড়াশোনা করিয়ে মানুষের মতো মানুষ করবার, কিন্তু সব কিছুই ভস্মে ঘি ঢালা… নেপোদাদুতো পড়াশোনা সেভাবে করলেনই না । উলটে বাপের সম্পত্তিতে গদ গদ হয়ে সক্কলকে বলতে থাকতেন, “কি হবে পড়াশোনা করে, আমার এত সম্পত্তি কে দেখবে ? আমার যা আছে তা পাঁচ-ছয় জেনারেশন বসে বসে খাবে”। ছেলের এই ধরণের মনোভাবে হারাধন বাবু ভীষণ অখুশি ছিলেন । ছেলেতো…! তাই তার ভবিষ্যতের কথা ভাবতে ভাবতে দিশেহারা হয়ে যেতেন । তিনি ছেলেকে অনেকগুলো গরু কিনে দিলেন । যাতে গরুর দুধ বিক্রি করে নিজের জীবন নির্বাহ করতে পারে । কিন্ত নেপোদাদু ভীষণ কুঁড়ে… গরুগুলোর ঠিক দেখাশোনা করতেন না । অন্যলোকের ওপর দেখভালের দায়িত্ব দিয়ে নিজে ঘরে বসে থাকতেন । বন্ধুদের সাথে তাস খেলায় ব্যস্ত থাকতেন । হারাধনবাবু ছেলের কথা ভাবতে ভাবতে ইহলোক ত্যাগ করলেন ।
নেপোদাদুর বয়স বাড়তে থাকে । সেইভাবে নিজের উপার্জিত কিছুই নেই, অনুভব করলেন যে কিছু একটা করতেই হবে, এই ভাবনা মাথায় নিয়ে তিনি গরুর দুধ বিক্রি বন্ধ করে গরুর গোবর থেকে ঘুটে তৈরি করে বিক্রি করা শুরু করলেন । আমাদের পাড়ায় ফিস্টে রান্নার আঁচের জন্য প্রথম কাস্টমার হিসাবে নেপোদাদুর ঘুটে নেওয়া হয়েছিল । দাদু নিজের হাতেই ঘুটে তৈরি করতেন । সেই ঘুটে বেশ বিখ্যাত হয়ে গিয়েছিল। শুধু আমাদের পাড়া নয়, আশেপাশের পাড়া থেকেও লোক এসে নেপোদাদুর ঘুটে নিয়ে যেত । দাদুর ইনকাম এইভাবে শুরু হল । দাদুর নিজের সম্পত্তি তো ছিলোই এবং ঘুটের পসার ছড়িয়ে পরাতে দাদুও খুব ব্যস্ত হয়ে পড়ল। দাদু ঘুটের কারখানাও তৈরী করে ফেললেন । এইভাবে নিজের জীবনের আরো ২০ বছর কাটিয়ে ফেললেন ।
দাদুর আর একটা পরিচয় দেওয়া হয়নি । দাদু ভীষণ কিপ্টে ছিলেন । দাদু ভীষণ ঝেড়ে খেতে ভালোবাসতেন । দাদুর কাছে থেকে এক-কানা বার করাও ভীষণ দুস্কর ব্যাপার । এই কিপ্টেমি নিজের জীবনের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করেছিলেন । বাপের যা বাড়ি বা সম্পত্তি ছিল তার ভোগ সে তো করতই কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের জন্য যে মেরামতি দরকার, তার দিকে কোনো নজরও দিতেন না। বাপের তৈরি করা বাড়িটি ধীরে ধীরে ভঙ্গুর হতে থাকে । নিজের পোশাকের ব্যাপারে তিনি স্বছন্দ্য ছিলেন না । তার প্রিয় পোশাক হল লুঙ্গি । উনি লুঙ্গি পরেই সবজায়গায় যেতেন । শীতকালে খুব জোর একটি গেঞ্জী ও চাদর পড়তেন । এহেন নেপোদাদুর কিপ্টেমিও সকলের চর্চার কারণ হয়ে উঠেছিল ।
নেপোদাদু কুঁড়ে, কিপ্টে কিন্তু ভীষণ রকমের সেয়ানা। দাদুকে মুরগী করা সহজ ব্যাপার নয় । আমাদের পাড়ার অনেকেই দাদুকে হেনস্থা করতে গেলে নিজেই হেনস্থা হয়ে ফিরে যায় । নেপোদাদু লোককে টাকা ধার দিতেন, এবং সেই সাথে চড়া সুদও নিতেন । কেউ এক পয়সাও যদি না দেয় দাদু তার পুঙ্গি বাজিয়ে ছাড়তেন । দাদু তার পৈতৃক বাড়িতে একাই থাকতেন । বাবা গত হবার পর তার মাও বেশিদিন আর থাকলেন না । সেক্ষেত্রে বিশাল বড় বাড়িতে একাকিত্বে জীবন কাটাতেন । দাদু বিয়েও করেন নি । এখানেও তার এক লজিক ছিল, তিনি নিজে কিপ্টে ছিলেন… তাই বিয়ে করলে সংসারে আর একজন এসে সব কিছুতে ভাগ বসাবে, অতিরিক্ত খরচ হবে… অতএব দাদু আইবুড়ো কার্তিক হয়েই থাকতে চাইলেন । একুলে দাদুর আর কেউ নেই বললেই চলে । তবে দাদুর প্রিয় সঙ্গী হল তার প্রিয় টিভি এবং টিভিতে থাকা স্পোর্টস চ্যানেলগুলো। যদিও এই টিভি তিনি এক বন্ধুকে পটিয়ে আদায় করেছিলেন, নিজে কেনেননি । তিনি তার কজন বন্ধুকে নিয়ে প্রতিদিন টিভি দেখতেন এবং সেই কেবল চ্যানেলের টাকাও তার বন্ধুরাই মেটাতেন ।
তা বুঝতেই পারছেন নেপোদাদুর মতো বিচিত্র মানুষ এই দুনিয়ায় সত্যি বিরল…! এই বিচিত্র মানুষের গপ্পো এখানেই শেষ নয়, এতো শুরুমাত্র…
Be the first to comment