”বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।”- কাজী নজরুল ইসলামের এই দুটি লাইন বুঝিয়ে দেয় পুরুষ ও প্রকৃতি মিলেই চলে সমাজ, চলে সভ্যতা। ৮ মার্চ, বিশ্ব নারী দিবস ধূমধাম সহকারে পালিত হয়। এটা ঠিক যে মেয়েদের অর্ধেক আকাশ বলা সত্ত্বেও এখনও মুক্তির স্বাদ মেলেনি সবার। শৈশবে পিতার অধীন, যৌবনে স্বামী ও বার্দ্ধক্যে পুত্রের অধীন যেন নারীর ভাগ্য লিখন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু একথাও ঠিক স্বাধীনতা দাবি করা, স্বশক্তিকরণকে মজবুত করতে গিয়ে অনেক্ষেত্রেই আমরা উৎশৃঙ্খলতাকে প্রশ্রয় দিয়ে ফেলি। নারীদের জন্য আছে নানা আইন। যা একান্তই তাঁদের নিজস্ব, আছে ৪৯৮A-এর মতো শক্তিশালী আইনি ব্যবস্থা, গ্রামে-গঞ্জে বহু নারী এখনও স্বাধীনতার আস্বাদ না পেলেও শহুরে মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত মহিলারা এই আইনের সুফল ভোগ করেন। কিন্তু কখনও কখনও ফলস ৪৯৮A করছেন বেশকিছু মহিলা। পুরুষদের অবস্থা তখন সত্যিই শোচনীয়। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে এক মহিলা তৈরি করেন ‘পুরুষকথা’ নামক একটি ম্যাগাজিন।
পুরুষদের অধিকার নিয়ে তৈরি কোনও ম্যাগাজিনের মুখপত্র এক মহিলা। এতে চমকা যাওয়ার কিছু নেই। কারন মেয়েদের কথাও তো বলেন পুরুষরা। এই ম্যাগাজিনের মুখপত্রের নাম নন্দিনী ভট্টাচার্য। নন্দিনী বলেন কর্মক্ষেত্রে সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্টের শিকার যেমন মহিলারা হন, তেমনই অনেক ক্ষেত্রে তাঁরা ফলস কেসও দেন। পাশাপাশি তিনি আরও বলেন, আগেকার দিনে মেয়েরা শুনেছি ‘গঙ্গাজল’, ‘চাঁদের আলো’, ‘বকুল ফুল’ পাতাতেন মনের কথা বলার জন্য। পুরুষ মানুষের এরকম কিছু পাতাবার কথা শুনেছেন কখনও ? আসলে পুরুষ মানুষ তাঁর জন্মলগ্ন থেকেই হয় রক্ষক আর নয়তো ভক্ষক এই দুই তকমাতেই আটকে থাকে। তাঁর অসহায়তা বা চোখের জল দুই বড় করুণার ও লজ্জার। আমাকে অনেকেই প্রশ্ন রেখেছেন নারী হয়ে আমি কেন পুরুষ অধিকার রক্ষার লড়াই এর পুরোভাগে। তাঁদের এবং সবাইকে জানাই, নারী অধিকার রক্ষার লড়াই এ বহু পুরুষ এগিয়ে এসেছিলেন এবং আজও আছেন। তাই পুরুষের জন্য আমি এক নারী নাহয় কথা বলা শুরু করলাম। আমরা মেয়েরা না এগিয়ে এলে আমাদের বাবা, ভাই, স্বামী, পুত্র কাউকে হয়তো এই আইনি সন্ত্রাসবাদের কবল থেকে মুক্ত করা যাবে না। কাল বা পরশু সে হয়তো থাবা বসাবে আমার ঘরে বা আপনার ঘরে বা আপনার, আপনার বা আপনার !!!!
যে দেশে পশু পাখির জন্য মন্ত্রণালয় আছে , পরিবেশ রক্ষায় আইন আছে, সে দেশে একটি পুরুষ কমিশন এর দাবি কি খুব বেশি চাওয়া ? আসুন সবাই লিঙ্গ নিরপেক্ষ আইনের পক্ষে সওয়াল করি।
শুধু যে পুরুষদের অধিকার নিয়ে অথবা তাদের আইনি সাহায্য দেওয়া নিয়ে এই ম্যাগাজিন তৈরি হয়েছে, তা নয়। পুরুষদের নানান অসুখ যেমন প্রস্টেট ক্যান্সার হলে কী করতে হবে? সেগুলি এই ম্যাগাজিনে লেখা থাকে। এছাড়াও হাইপার টেনশন, সুগার, পার্কিনসন্স আর অ্লযাজাইমাস প্রভৃতি রোগগুলি পুরুষদের ক্ষেত্রে বেশী হয়। সুতরাং তাদের একটি নিজস্ব জায়গা থাকা দরকার। এছাড়া পুরুষরা কেমন জামাকাপড় পড়বেন অর্থাৎ, জীবনের সব ক্ষেত্রে পুরুষদের জন্য চিন্তাভাবনা করে এই ‘পুরুষকথা’। নন্দিনী স্বীকার করেন, পুরুষরা অনেকসময় রক্ষক হয়ে ভক্ষক হয়ে ওঠে। সেক্ষেত্রে বলা যায় মেয়েদের জাগরণ না হলে পুরুষরাও পিছিয়ে পড়বে। স্ত্রী ও মায়ের চাপে পড়ে অনেক পুরুষেরই খুব খারাপ অবস্থা হয়। আমরা কথা বলেছিলাম বিশিষ্ট সাংবাদিক তরুণ গোস্বামীর সঙ্গে। তিনি বলেন নন্দিনী যে কাজটা করছে খুব ভালো, কিন্তু নিজে পুরুষ হয়ে বলছি এখনও মহিলারা পুরুষদের থেকে খারাপ অবস্থাতেই আছে। তার কারন অবশ্যই পুরুষরা।
যাই হোক, নন্দিনীর এই প্রয়াস কিছুটা হলেও যে অভিনব সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। নন্দিনীর স্বামী তাঁকে এই কাজে যথেষ্ট সাহায্য করেন। নন্দিনী বলেন পুরুষকথা আসলে মানুষ কথা। আমরা নারী-পুরুষকে আলাদা ভাবে না দেখে পুরুষকে একটা মানুষ হিসেবে দেখার চেষ্টা করি। সেইসময় থেকেই এই ম্যাগাজিন তৈরি করার চিন্তাভাবনা মাথায় আসে। পুরুষকথায় সদস্য সংখ্যা এখন ৩৫০ থেকে ৪০০। তার মধ্যে বহু মেয়েও আছেন। নন্দিনীর ব্যতিক্রমী প্রয়াসকে সাধুবাদ জানিয়ে একথা বলা যায়- এখনও পুরুষ যখন ধর্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় তখন সে দেখে না কোনও বয়স, দেখে না কোনও সম্পর্ক। সেক্ষেত্রে এইসব পুরুষদের প্রশ্রয় না দিয়ে তাদের মানসিক বিকার সারানোর জন্য উদ্যোগী হোক ‘পুরুষকথা’। তবেই এই ম্যাগাজিন সার্থক হবে।
Be the first to comment