লেখক- পবিত্র চক্রবর্তী
১
উত্তর আমেরিকার এক জঙ্গলে তখন বেশ হই চই পরে গেছে । প্রবল শীতের খরা কাটিয়ে হাল্কা বৃষ্টির ছোঁয়া লাগতেই চারিদিকে সাজ সাজ রব । কানা , শুকনো নদীগুলো একটু করে রিম ঝিম করে গান গাইতে লেগেছে । বরফের কুচিরাও টুপ টুপ করে খসে পরছে ওই জলের ধারাতে । যেন বলছে , নদী ভাই আমাদেরকেও তোমার সাথে নিয়ে চল না ! ঠান্ডার জন্য জমে গিয়েছি । বৃষ্টি বন্ধুকেও ধন্যবাদ জানায় মনে মনে তারা ।
অনেকদিন পর ,লেপার্ড ব্যাঙ পরিবারেও খুশীর হাওয়া । এই জঙ্গলে তারা অনেক দিন ধরেই বাস করে । কয়েকদিন হল রানী ব্যাঙের ফুটফুটে চারটি ছা হয়েছে । ঠাম্মা ব্যাঙ কত মানসা করার পর দুই নাতির আর দুই নাতনীর মুখ দেখে আহ্লাদে আটখান । রাজা ব্যাঙ তার মন্ত্রীদের বলল , “ মন্ত্রী যাও , সব কুনো , সোনা , পাখি সকলকে নেমন্তন্ন করে এস ।”
লাফাতে লাফাতে একদল মন্ত্রী ব্যাঙ চলল সবাইকে খবর দিতে । আজ রাতেই প্রচুর খাওয়া দাওয়া , নাচগান হবে । অনেককাল গলা সাধা হয় নি । তাই রাজা ব্যাঙ তার বউ রানী ব্যাঙকে সঙ্গে নিয়ে গাছের ডালে উঠে ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর করে গলা ঠিক করতে বসে গেল ।
সন্ধ্যে হতেই নদীর ধারে সুন্দর ভাবে ব্যাঙ রাজার প্রাসাদ সেজে উঠল । রাজা , রানী , ঠাম্মা আর ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চা ব্যাঙরা ঝলমলে জামা কাপড় পরে সাজতে শুরু করেছে । রানী ব্যাঙ আদর করে তার চার বাচ্চাকে সাজিয়ে তুলছে । ঝক ঝকে সবুজের উপর কালো কালো ছোপ । মাথায় আবার এক ফোঁটা লাল টোপরের মত ক্যাপ ।
মায়ের কথা এরা খুব মানে । মা বলে দিয়েছে , “ শোন , হুটপাটি করবে না আর যে কোন জিনিষ আমাকে না জিজ্ঞাসা করে মুখে দেবে না ।”
মায়ের কথায় বাচ্চারা একে অপরের মুখের দিকে তাকাল ! এদের মধ্যে সব চেয়ে যে ছোট্ট সে আদুরে গলায় বলে উঠলো , “ মা আমরা তো বড় হয়ে গেছি !”
– “ সে বড় তো হয়েছ কিন্তু আরও বড় হতে হবে, তারপর তো তোমরাই নিজেদের কাজ করতে পারবে ,” পাশ দিক থেকে বাবা ব্যাঙ বলে ওঠে ।
কি আর করা ! মা বাপীর কথা শুনতে তো হবেই যত দিন না বড় হয়ে উঠছে । এখন তাদের ল্যাজটা সবে খসেছে । আর ছোট ভায়ের তো আরও ক’টা দিন লাগবে । সুতরাং , বড়দের কথা এসময় ভাল করে শুনতেই হবে । যাইহোক , সবাই মিলে সভায় উপস্থিত ।
এরই মধ্যে কুনো , সোনা থেকে শুরু করে রেইন ডিয়ার , আর্মাডিলো সব এসে গিয়েছে । প্রত্যেকেই রঙ বেরঙের পোশসাকপড়ে এসেছে । রেইন ডিয়ার আবার তার শিং-এ কয়েকটা ঘন্টাও ঝুলিয়েছে ।
– “ কি গো ভায়া , এখনও ঘন্টাটা খোলো নি !” আর্মাডিলো তার মোটা কবচের দেহ থেকে সরু মুখটা বার করে বলে বসে ।
– “ না গো, ক্রিসমাসের সময় পরেছিলাম তাই ভাবলাম নতুন বছরে এটা পরেই আসি ,” হাঁসতে হাঁসতে জবাব দেয় সে ।
ব্যাঙ আর পশু-পাখীদের উৎসব দারুণ জমে উঠেছে । সবাই , চার ছানাকে নানা উপহারও দিল । বাচ্চারা তো বেজায় খুশী । মা ব্যাঙ পরম স্নেহে আদর করে ওদের খাইয়ে দিচ্ছে নানা খাবার । ব্যাঙ রাজা তার মন্ত্রীদের সাহায্যে প্রায় ঢালাও খাবারের ব্যবস্থা করে রেখেছে । কি নেই খাওয়ারের মেনুতে ! কুচো পিঁপড়ের ডিম ফ্রাই , নরম নরম সবুজ ঘাসের ভেজ রোল , মধু ভরা সন্দেশ আরও কত কি ! সবাই বেশ চেটে পুটে খাচ্ছে । আহা , হাল্কা শীতের আমেজ , জমজমাট পার্টি নাইট !
ধীরে ধীরে রাতও গভীর হচ্ছে । তারারা যেন ঝাড় লণ্ঠনের মত আলো দিয়ে সারা আকাশকে সাজিয়ে তুলেছে । মাঝে মাঝে হাল্কা শীতল হাওয়া নদীর কোল দিয়ে বয়ে যেতেই নদীও মজায় মাতোয়ারা হয়ে নেচে উঠছে । ঠাম্মা ব্যাঙ এবারে ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ করে বলে উঠলো , “ বাচ্চাগুলোকে ঘড়ে নিয়ে যাও , ছোট্ট মানুষ ঠাণ্ডা লেগে যেতে পারে ।”
ম্যাকাও পাখিও তার লাল-নীল ডানাটা টান টান করে বলে উঠল , “ ব্যাঙ রাজা এবার আমাদেরও যেতে হবে ।”
উপস্থিত সবাই বলল , “ ঠিক ঠিক ।”
আর্মাডিলো আর প্যাঁচা অবশ্য সাহস দেখিয়ে বলল , “ আরে ভয় পেও না , যাদের প্রবলেম থাকবে আমাদের পিছু পিছু এস ।”
রানী ব্যাঙও সম্মতি জানিয়ে বলে , “ হ্যাঁ ভাই , তোমরা তো রাতে দিব্যি দেখতে পাও , আমার অতিথিদের একটু বাড়ী দিয়ে এস দয়া করে ।”
কথাটা বলে মা ব্যাঙ বাচ্চাদের হাত ধরে নদীর ঠিক পাশেই যেখানে নরম গোল গোল পাতা দিয়ে বিছানা বানিয়েছিল সেই দিকে হাঁটা লাগাল ।
একটা বাদুড় গাছের ডালের উপর মাথা নীচু করে নেমন্তন্ন বাড়ীর ফল খাচ্ছিল সে আচমকা সজোরে চিঁ চিঁ চিঁ করে ডেকে উঠল । বাড়ী ফেরার জন্য যারা পা বাড়িয়েছিল সকলেই হঠাৎ এই বিপদ ধ্বনিতে দাঁড়িয়ে পড়ল । পরে গেল হুর মুড়িয়ে ছোটা ছুটি ।
২
কিছুদিন ধরেই তক্কে তক্কে ছিল কুমীর আর তার বন্ধু । প্রবল ঠাণ্ডার জন্য কিছু মাস পেটে কিছু পরে নি । টুক টাক পাখী , ব্যাঙ আর মাছ যা একটু পাওয়া যাচ্ছিল তাই দিয়েই কাজ চালাতে হচ্ছিল । তার উপর আজ এখানে উৎসব । খাওয়ারের গন্ধে চারিদিক ম ম করছে । বেজায় রেগে গেছে কুমীররা ।
– “ এত বড় সাহস ! আমরা বাড়ীর পাশেই থাকি আর আমাদের একবারও বলল না ” মোটা কুমীর অন্য এক রোগা কুমীরকে বলল ।
– “ দাঁড়াও আজ ওদের মজা দেখাব !” রোগা কুমীর জলের থেকে নাকটা বার করে বলে উঠল ।
খাওয়া দাওয়া হয়ে যাওয়ার পর সবাই যখন বাড়ীর দিকে যাবে ঠিক তখনই রেইন ডিয়ারের তেষ্টা পায় । এমনিতে ও একটু জল কমই খায় কিন্তু আজ বহুকাল পর গুরু ভোজ হয়ে গেছে । পেট ফুলে জয় ঢাক । ভাবল , পাশেই তো নদী , যাওয়ার আগে কয়েক ঢোঁক জলও খেয়ে নেই ।
একেই অচেনা জায়গা তারপর জানেও না এখানে দুই দুষ্টু কুমীর থাকে ! তাই , ল্যাজ নাড়াতে নাড়াতে জলের ধারে গিয়ে মাথাটা নামিয়েছে । দূর থেকেই অনেকক্ষণ ধরে মোটা আর রোগা কুমীর ব্যাপারটা দেখছিল । রোগা কুমীর ফিস ফিস করে মোটাকে বলে , “ ভাই মোটা , ভালো করে দেখো !
– “ কি দেখব রে রোগা ?”
– “ খাওয়ার উপস্থিত সামনেই । আস্তে আস্তে করে চল আর তারপর…” যারপর নাই খুশী হয়ে ওঠে কথাটা বলতে বলতে রোগা কুমীর ।
– “ ওরে বাবা ! কি মস্ত শিং ভাই ! ধরতে গেলেই গুঁতিয়ে দেবে যে ,” একটু ভয় পেয়ে মোটা কুমীর বলে ।
– “ দূর তুমি না আস্ত একটা ভীতু ! ছিঃ ছিঃ । এত বড় মোটা শরীর আর তুমিই ভয় পাচ্ছ !” হাঁসি থামিয়ে গম্ভীর গলায় রোগা মোটা কুমীরকে তিরস্কার করে ওঠে ।
মোটা কুমীর নিজের দিকে তাকিয়ে লজ্জা পেয়ে গেল । সত্যিই তো এত বড় চেহারা ! আর সামনেই পুটকে একটা রেইন ডেয়ার । যাইহোক, রোগার পিঠে হাত দিয়ে স্বান্তনার ভঙ্গীতে বলল , “ ও.কে চল । গিয়েই ঝপাত করে পা’টা ধরব ।”
হরিণ খেয়ালই করে নি জলের মধ্যে নড়াচড়া হচ্ছে । আপন মনে চোঁ চোঁ করে তেষ্টা মেটাচ্ছে । আর ঠিক তখনই জলের মধ্যে ঝপাস করে তুমুল শব্দ ।
বাদুড়ের চীৎকারে সবাই জলের কাছে দৌড়ে চলে এসেছে । ব্যাঙ রাজাও তার সাথীদের নিয়ে হাজির । কাছে গিয়ে দেখে নদীর জল তোলপাড় হচ্ছে । ভয়ে সবাই তটস্থ । কী করবে ভেবে পাচ্ছে না কেউই । একেতেই এই কুমীরগুলো দুষ্টু তারপর ওই ইয়া ইয়া চেহারা !
এমন পরিস্থিতে আবার , “ ও গো আমাদের খোকা খুকিরা কোথায় গেল ? ” মা ব্যাঙ কাঁদতে শুরু করে দেয় ।
– “ কী সর্বনাশ ! ওরা কোথায় ছিল রানী ,” চোখ কপালে তুলে ভয়ে বলে ওঠে রাজা ব্যাঙ । ঠাম্মাও কান্না জুরে দিয়েছে ।
রানী ব্যাঙ কাঁদতে কাঁদতে বলে , “ আমি যে ওদের সকলকে ওই দিকেই ঘুম পাড়িয়ে রেখে এসেছিলাম । গিয়ে দেখি নেই !”
সবাই থম মেরে গেছে । শুধু মাত্র জলের শব্দ আর মাঝে মাঝে ঝপাং ঝপাং আওয়াজ উঠছে ।
৩
কারোর আর সেই রাতে বাড়ী যাওয়া হয়ে ওঠে নি । এত বড় বিপদে বন্ধু ব্যাঙ পরিবারকে ফেলে কী করে যায় ওরা !
সকালে কিন্তু পরিবেশটা নতুন সূর্যের আলোর মত ঝলমলে হয়ে উঠলো । নদী এখন শান্ত বাচ্চার মত । বাদুড় আর প্যাঁচা আলো সহ্য করতে পারে না বলে ব্যাগের থেকে সানগ্লাস করে পরে নিয়েছে । ম্যাকাও ডানা ফর ফর করে মেলে দূর থেকে কিছু অজানা লতা পাতা নিয়ে এসে আর্মাডিলোকে দিল । আর্মাডিলো আবার একটু কবিরাজ ধরণের ।
– “ একটু সহ্য কর ভাই হরিণ , ওষুধটা লাগিয়ে দিলেই দেখবে ব্যাথাটা গায়েব হয়ে যাবে একটু পরেই ”, আর্মাডিলো তার ছুঁচলো লম্বা জিভ দিয়ে ওসুধ রেইন ডেয়ারের পায়ে লাগাতে লাগাতে বলল গম্ভীর ভাবে ।
দাঁতে দাঁত চিপে হরিণ ব্যথাটা সহ্য করে কঁকিয়ে উঠে মা ব্যাঙের দিকে তাকিয়ে বলে , “ ধন্যি মা তুমি ! আর ধন্য তোমার ওই সাহসী বাচ্চাগুলো ।”
মা , বাবা আর ঠাম্মা লেপার্ড ব্যাঙরা তখন বেজায় খুশী তাদের সাহসী বাচ্চাদের নিয়ে ।
সকলে বলে উঠলো , “ ভাই হরিণ কি হল বল না আমাদের , আমরাও একটু শুনি !”
– “ আরে আমাকে তো তখন ওই হুমদো মাথার কুমীরটা ধরেছে আর পেছন দিক থেকে রোগা পটকাটা…”
– “ তারপর তারপর ।” ওষুধ লাগান বন্ধ করে আর্মাডিলো চোখ গোল গোল করে বলে ওঠে ।
– “ তারপর , তারপর আমি জানি না, চোখে অন্ধকার দেখছিলাম আর অসহ্য ব্যাথা ।”
সানগ্লাসটা চ্যাপ্টা নাকে ভালো করে গুঁজে প্যাঁচা বলে উঠলো সোল্লাসে , “ বাকীটা এই সব বীরদের সাহস । ওরা না থাকলে আমাদের ভাই রেইন ডিয়ারকে বাঁচানোই যেত না !”
খুঁদে খুঁদে ব্যাঙদের গোল করে ঘিরে সবাই নদী থেকে একটু দূরে গাছে তলায় এসে বসেছে । জানতে চাইছে কী করে বাঁচালো তারা । বাচ্চাগুলোর মধ্যে যেটি একটু বড় সে বলল, “ আমাদের মধ্যে যার লেজ এখনও খসে পরে নি তারই আসল সাহস !”
– “ বলিস কি রে !” ওদের মা চমকে উঠে বলল ।
– “ ও যখন দেখল , হরিণ মামাকে ওই দুষ্টুগুলো ধরে ফেলেছে তখন ও কিছু না ভেবে বিছানা থেকে ঝপাং করে জলে ঝাঁপ দেয় ।”
সবাই চুপচাপ করে শুনতে থাকে । বাবা ব্যাঙ বলে ওঠে , “ তারপর !”
– তারপর অর দেখা দেখি আমরাও জলে । কেও মোটা কুমীরের চোখে আর কেওবা রোগাটার নাকের মধ্যে ঢুকে পড়ি !”
ঠাম্মা তো ওদের কথা শুনে হাঁ । তার বাঁধানো দাঁত খুলে যাওয়ার জোগাড় ! করেছে কী এরা !
– “ আমাদের , লেপার্ড ব্যাঙদের একটা জ্বালা ধরানো বিষাক্ত রস যেই না ওদের চোখে , নাকে লেগেছে অমনি মামার পা ছেড়ে পালিয়ে বাঁচে !”
ধন্য ধন্য করে উঠলো সকলে । এই বয়েসে এদের সাহস দেখে । মা ব্যাঙ বলল হাঁসতে হাঁসতে , “ দেখো , তোমরা ভীষণই ভালো কাজ করেছ কিন্তু খেয়াল রেখো এই হাতিয়ার শুধু ভাল কাজের জন্যই ব্যবহার কর, কেমন ।”
ঠাম্মা ব্যাঙ আনন্দে বুড়ি বয়সেও কোমরে ব্যথা নিয়ে লাফাতে লাফাতে বলল , “ বাচ্চারা বলত, এই উপকার থেকে আর কী শিখলে ?”
বাচ্চারা জোরে চিৎকার করে একে অপরের হাত ধরে একসাথে বলে উঠল, “ একতাই শক্তি , একতা আর বুদ্ধি থাকলে কেউ ক্ষতি করতে পারবে না ।।”
Be the first to comment