স্তন ক্যান্সারের প্রতিষেধক আবিষ্কারের পথে ৪ বাঙালি গবেষক

Spread the love

বিশ্বজুড়ে মহিলাদের মধ্যে বেড়ে চলেছে স্তন ক্যান্সারের প্রবণতা। ৪০ থেকে ৫৫ বছরের মহিলাদের মধ্যে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা সবচেয়ে বেশি। এতদিন মনে করা হত, প্রাথমিক স্তরে স্তন ক্যান্সার ধরা পড়লে তা সম্পুর্ণভাবে সারিয়ে তোলা সম্ভব। কিন্তু সম্প্রতি বেশ কিছু সমীক্ষায় দেখা গেছে, স্তন ক্যান্সারের প্রকৃতি যদি জটিল হয় তবে তা প্রাথমিকভাবে ঠিক হলেও আবার ফিরে আসতে পারে মহিলাদের শরীরে। এই ট্রিপল নেগেটিভ ব্রেস্ট ক্যান্সার সেরে গিয়েও কেন ফিরে আসছে এবং কীভাবে এর প্রতিরোধ সম্ভব, এই বিষয়গুলি নিয়েই গবেষণা করেছেন কলকাতার চার গবেষক। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের (বালিগঞ্জ সায়েন্স কলেজ ) প্রাণিবিদ্যা বিভাগের উদ্যোগে করা হয় এই গবষণাটি। বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর ঊর্মি চট্টোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে এই গবেষণায় যুক্ত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়েরই পিএইচডি স্কলার পৃথা মুখোপাধ্যায়। গবেষণাটিতে ক্লিনিকাল সহায়তা এবং তথ্য বিশ্লষণে সাহায্য করেছেন কলকাতার ঠাকুরপুকুর ক্যান্সার হাসপাতাল (সরোজ গুপ্ত ক্যান্সার কেয়ার অ্যান্ড রিসার্চ ইন্সটিটিউট) এর অধিকর্তা ডাঃ অর্ণব গুপ্ত এবং   কলকাতার অ্যামিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ধ্রুবজ্যোতি চট্টোপাধ্যায়।

কিন্তু কী এই ট্রিপেল নেগেটিভ স্তন ক্যান্সার?
গবেষকরা জানাচ্ছেন, স্তন ক্যান্সারের ক্ষেত্রে ইস্ট্রোজেন, প্রজেস্টেরন, হারসেপ্টিং নামক তিনপ্রকার হরমোন রিসেপ্টরের ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। স্তন ক্যান্সার নির্ণয়ের সময় এই তিন প্রকার হরমোন রিসেপ্টরের মধ্যে যদি একটি বা দুটি রিসেপ্টরের ফল নেগেটিভ আসে তাহলে হরমোন থেরাপির মাধ্যমে স্তন ক্যান্সারের চিকিৎসা সম্ভব হতে পারে। কিন্তু যদি কোনও মহিলার ক্ষেত্রে তিনটি রিসেপ্টরের ফলাফলই নেগেটিভ আসে, তখন বলা হয় তিনি ট্রিপল নেগেটিভ স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছেন এবং এক্ষেত্রে আর হরমোন থেরাপি কাজ করে না। ক্যান্সার প্রতিরোধে তখন সাহায্য নিতে হয় কেমোথেরাপির।
গবেষণা দলটির নেতৃত্ব দিয়েছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বালিগঞ্জ সায়েন্স কলেজের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের প্রধান প্রফেসর  উর্মি চট্টোপাধ্যায়। তিনি জানান, ট্রিপল নেগেটিভ স্তন ক্যান্সারের ক্ষেত্রে হয়তো কেমোথেরাপির মাধ্যমে ক্যান্সার নিরাময় সম্ভব। কিন্তু পাঁচ থেকে সাত বা ন’বছর পর ওই মহিলা ফের ক্যান্সারে আক্রান্ত হতে পারেন। অর্থাৎ স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত কোনও মহিলা কেমোথেরাপির পর ভাবলেন তিনি সম্পুর্ণ সুস্থ হয়ে গেছেন, কিন্তু কিছু বছর পর ফের তা শরীরে বাসা বাঁধতে পারে। দ্বিতীয়বার এই রোগে আক্রান্ত হলে সেই চিকিৎসা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে এবং ক্যান্সারের মারণ ক্ষমতাও বৃদ্ধি পায়।

কিন্তু কেন তা ফিরে আসছে এবং এর নিরাময় কীভাবে সম্ভব?
এখানেই কৃতিত্বের দাবি রাখছেন শহরের এই চার গবেষক। তাঁদের গবেষণায় প্রকাশ, ক্যান্সার আক্রান্ত স্টেম সেলগুলি কেমোথেরাপির প্রভাব থেকে বাঁচতে নিজস্ব একটি প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করতে সক্ষম। ফলে প্রাথমিকভাবে রোগ নিরাময় সম্ভব হয়েছে মনে হলেও নিজস্ব এই প্রতিরোধ ব্যবস্থার হাত ধরে ভবিষ্যতে ফের মাথাচারা দিতে পারে এই স্টেম সেলগুলি। বাড়তে পারে সংখ্যায়। এর জন্য দায়ী ABCG2 এবং TWIST1 নামের দু’ধরনের প্রোটিন। যেগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করে ক্যান্সার আক্রান্ত স্টেম সেলের মধ্যে অবস্থিত SOX2 নামের এক বিশেষ জিন। এই ABCG2,TWIST1 এবং SOX2 মিলেই ক্যান্সার স্টেম সেল থেকে বের করে দেয় কোমো থেরাপির ড্রাগগুলি। ফলে ফের সক্রিয় হয়ে ওঠে ক্যান্সার স্টেম সেলগুলি। যা ফের স্তন ক্যান্সার রূপেই ফিরে আসে। কখনও বা রক্তের মাধ্যমে (বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় ইএমটি) বাহিত হয়ে বাসা বাঁধে শরীরের অন্য কোনও স্থানে।

গবেষকদের দাবি, ‘জিন টার্গেটিং’ এর মাধ্যমে SOX2 নামের এই দুষ্টু জিনকে কমানো সম্ভব। আরএনএ-‘জিন সাইলেন্সিং পদ্ধতি ব্যবহার করে তাঁরা এবিষয়ে সাফল্য পেয়েছেন। আর SOX2 সংখ্যায় কমলে কমবে ABCG2 এবং TWIST1 নামের এই দুটি প্রোটিনের দাপাদাপি। ফলে তারা আর ক্যান্সার স্টেম সেল থেকে কেমোথেরাপির ড্রাগগুলি বাইরে বের করে দিতে পারবে না। কমবে ক্যান্সার স্টেম সেলগুলির পুণরায় মাথাচারা দেওয়ার প্রবণতা। কমবে সেগুলির মারণ ক্ষমতা। তখন ক্যান্সার স্টেম সেলগুলির উপর কাজ করতে পারবে paclitaxel এর মতো কেমোথেরাপির ড্রাগগুলি। যে আরএনএ- জিন সাইলেন্সিং পদ্ধতি এক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে , তা রোগীদের ব্যবহারিক স্বার্থে ইনজেকশন বা ট্যাবলেট আকারে ভবিষ্যতে বাজারে আনার চেষ্টা চলছে বলে গবেষকরা জানিয়েছেন।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*