মাসানুর রহমান : স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত একটি ঐতিহাসিক বাড়ি ভাঙতে গিয়ে তার নীচে থেকে বের হয়ে এল গুমঘর, লুকনো সিঁড়ি ও সুড়ঙ্গপথ৷ ওই সুড়ঙ্গ থেকে উদ্ধার হয়েছে হাঁড়ি, কড়াই, থালার-সহ পিতলের বেশ কয়েকটি বাসন৷ আশেপাশের এলাকা থেকে কয়েক হাজার গ্রামবাসী হুমড়ি খেয়ে পড়েন ওই ভগ্নস্তূপ দেখতে৷ কেউ কেউ লেগে পড়েন সুড়ঙ্গের ভিতরে ঢুকে গুপ্তধনের তল্লাশিতেও।
ডোমজুড় থানার পুলিশ এসে চেষ্টা করতে থাকে উন্মাদনা থামানোর৷ শেষ পর্যন্ত পুলিশের তাড়ায় পালায় উৎসুক জনতা৷ এলাকার লোকজন বলতে থাকেন, ছোটো থেকেই তাঁরা শুনে আসছেন, সরকার পরিবারের ওই বাড়িতে বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর আসা-যাওয়া ছিল। তাঁর বাল্যবিধবা বোন সুশীলার শ্বশুরবাড়ি ছিল এই সরকার বাড়ি৷ সুশীলাদেবী বিধবা হওয়ার পরে সুযোগ পেলে বোনের সঙ্গে এই বাড়িতেই দেখা করতে আসতেন রাসবিহারী বসু৷ বোনের পাশে দুঃখের দিনে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি৷
স্থানীয়দের কথায় রাসবিহারী বসু যে এই বাড়িতে আসতেন সে কথা আমরা ছোটো থেকেই শুনে আসছি৷ এমনও শুনেছি, দেশত্যাগের আগের রাতেই তিনি বোনের সঙ্গে দেখা করার জন্য এই বাড়িতে এসেছিলেন৷ এখানে মাছের ঝোল দিয়ে ভাতও খান রাতে৷ তারপর পুলিশের চোখে ধুলো দিতে রাতেই মহিলার ছদ্মবেশ ধরে এই বাড়ি ছেড়ে যান৷ অনেক আবার বলছেন, মহিলার ছদ্মবেশে নয়, তিনি পালিয়েছিলেন এই সুড়ঙ্গপথ ধরেই৷ ওই বাড়ির সামনেই ১৯৮৬ সালে রাসবিহারী বসুর জন্ম শতবার্ষিকীতে তিন দিন ধরে অনুষ্ঠান হয়েছিল৷ সে সময় ওই মহান দেশপ্রেমিকের স্মৃতিতে একটি প্রস্তর ফলকও বাসানো হয় কোলড়ার সরকার বাড়ির সামনে৷ সেটি অবশ্য এখন অবহেলায় পড়ে রয়েছে বাড়ির বাইরে৷ কোলড়ার ওই বাড়ির সঙ্গে রাসবিহারী বসুর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের কথা জানিয়েছেন তাঁর জীবনীকারও৷
রাসবিহারীর জীবনীকার অসিতাভ দাস জানালেন, ‘রাসবিহারী বসুর অনুজ বিজনবিহারী বসু ‘কর্মবীর রাসবিহারী’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘দেশত্যাগ করিবার পূর্বে রাসবিহারী কোড়লা গ্রামে (আন্দুলের নিকট) ভগিনী সুশীলার সহিত সাক্ষাত্ করিতে যান। এই ভগিনী বাল্যবিধবা। সকল কার্যের মধ্যেই তাহার জন্য রাসবিহারীর অন্তর কাঁদত। মৃত্যুর দিনেও এই ভগিনীর কথা ভাবিয়া রাসবিহারীর অন্তর কাঁদিয়াছিল৷…
সন্ধ্যার কিছু পূর্বে রাসবিহারী এক বন্ধুর সহিত সাইকেলে কোড়লা গিয়াছিলেন৷ সুশীলার দেওর শ্রী মন্মথনাথ সরকার ও তাঁর মাতা, রাসবিহারী ও তাঁর বন্ধুর বহু সমাদরের ত্রুটি করেন নাই৷ রাত্রির আহারাদির পর রাসবিহারী সকলের সহিত আলাপ করিতে করিতে কার্যবিশেষের জন্য দ্বিতলের ছাদে উঠিলেন৷ তথা হইতে ফিরিয়াই তিনি বলিলেন, ও এইবার আমায় বিদায় দিন, আমি এখনই যাইব৷ বহুদূর দেশে যাইবার পূর্বে কেবল আপনাদের সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিয়াছিলাম৷… রাসবিহারীর বন্ধু বহির্বাটিতে শয়ন করিবার উদ্যোগ করিতেছিলেন৷ রাসবিহারী তাঁহাকে লইয়া তত্ক্ষণাত্ বাহির হইয়া গেলেন৷ পরদিন সূর্যোদয়ের পূর্বেই পুলিশ সমগ্র বাটী ঘিরিয়া ফেলে৷ গ্রামময় একটা আতঙ্ক ছড়াইয়া পড়িল৷ পুলিশ এখানে অতি তীব্রভাবে খানা তল্লাশি চালাইয়া ছিল৷’ এদিনের ঘটনার পর পুরো বাড়িটি পুলিশ ঘিরে দিয়েছে৷ সেখানে পুলিশ প্রহরার ব্যবস্থাও হয়েছে৷ ঐতিহাসিক ওই বাড়ি সংরক্ষণের দাবিও করেছেন ডোমজুড়ের বাসিন্দারা৷
Be the first to comment