তপন মল্লিক চৌধুরী : জীবনটা তো মাত্র ছত্রিশ বছরের—৩০ অক্টোবর ১৮৮৭ থেকে ১০ সেপ্টেম্বর ১৯২৩। সময়টা তো গুছিয়ে বসার মতো একেবারেই নয়। যা করার তারই মধ্যে করে ফেললেন। আরে! করে ফেললেন মানে কি? সুনিপুণ, সুদক্ষ হাতেই সেরেছেন তাঁর সব কিছুকে। ছড়া ও কবিতা, গল্প আর নাটক। ধাঁধা ও গান, এরপরও? প্রবন্ধ-নিবন্ধ-ফোটোগ্রাফি-ননসেন্স ক্লাব, সন্দেশ-এর সম্পাদনা, ব্রাহ্মসমাজ আর তার দুই দলের মধ্যে তর্কাতর্কি—সেসব নিয়েও একখানা চমৎকার প্রহসন ‘চলচিত্তচঞ্চরী’। জ্ঞান-বিজ্ঞান নিয়েও আছে লেখা; ছোটোদের জন্য খুব সুন্দর করে সাজিয়ে দেওয়া, দেশ-বিদেশের জ্ঞানী বিজ্ঞানীদের জীবনবৃত্তান্ত, জীবজন্তুদের সঙ্গে ছোটোদের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্যও লিখেছিলেন। এ ছাড়া কত যে বিচিত্র বিষয়ের ওপর লিখেছিলেন, ইংরেজি রচনাও রয়েছে তাঁর। সব লেখা তো আর তখন তাঁর নিজের নামে প্রকাশিত হয়নি, হয়তো সেই জন্যই সুকুমার রায়ের সব লেখা এক জায়গায় করা জড়ো করা সম্ভব হয়নি। চেষ্টা একটা হয়েছিল শতবর্ষ উপলক্ষে কিন্তু সে কাজে বড্ড বেশি তাড়াহুড়ো ছিল। অযত্ন তাই রয়েই গেছে। কিন্তু তারপর আর কিছু করা হলো না কেন? হয়তো এর জন্য সার্ধশত উপলক্ষ্য পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
অসাধারণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা আর অফুরন্ত কল্পনাশক্তি—এই দুটি দুর্লভ গুণ ছিল সুকুমারের। ‘সন্দেশ’ পত্রিকায় যখন ‘আবোল-তাবোল’ প্রকাশিত হল তখনই লক্ষ্য করা গেল উদ্ভট সব প্রাণীর আবির্ভাব ঘটছে এই পত্রিকায়—হাঁসজারু, বকচ্ছপ, মোরগরু, সিংহরিণ, হাতিমি, কাঠবুড়ো, হুকোমুখো হ্যাংলা, হাট্টিমাটিমটিম, রামগরুড়, হ্যাংলাথেরিয়াম, গোমড়াথেরিয়াম, ল্যাগব্যাগর্নিস, চিল্লানোসরাস এরাও ছিল। ‘আবোল তাবোল’ একমাত্র বই যেটির সব কিছু মানে আগাগোড়া সুকুমার নিজে দেখাশোনা করতে পেরেছিলেন নিজে তাঁর জীবদ্দশায়। সমস্ত ছবি যা কিনা আশ্চর্য এবং অদ্ভুত সেসবও তিনি নিজেই করেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য গোটা বইটি তৈরি হয়ে গেলেও প্রকাশ-এর আগেই তাঁর মৃত্যু হলো। নিজের হাতে আদ্যোপ্রান্ত সাজিয়েও তার প্রকাশ আর নিজের চোখে দেখা হলো না। আবোল তাবোল-এর প্রথম প্রকাশ ১৯ সেপ্টেম্বর ১৯২৩ আর এর ঠিক ন-দিন আগে তিনি চলে যান। তিনি নিজেই লিখেছিলেন, ‘ঘনিয়ে এলো ঘুমের ঘোর/গানের পালা সাঙ্গ মোর।’ জীবন আর মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আর কোন রসস্রষ্টা এমন রসিকতা উপহার দিতে পেরেছেন জানা নেই।
বিস্মৃতির অতল থেকে আবোল তাবোল পুনরুদ্ধার করে ১৯৪৫ নাগাদ যে বা যারা নতুন সাজ-সজ্জায় আবোল তাবোল ছাপলেন সেই সিগনেট প্রেস তথা দিলীপকুমার গুপ্ত-র উদ্যোগেই বের হয় ‘হযবরল’, পুনর্সংকলিত হয় ‘পাগলা দাশু’, ‘খাই খাই’ ইত্যাদি। ‘হযবরল’-র রচনাকাল ১৯২২। বাংলা ১৩২৯-এর জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ ও ভাদ্র সংখ্যায় ‘সন্দেশ’-এ ‘হযবরল’ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। সুকুমারের মৃত্যুর বছর খানেক পর রায় পরিবারের প্রকাশনা সংস্থা ইউ রায় অ্যান্ড সন্স, ১০০ গড়পার রোড থেকে বইটি প্রথম মুদ্রিত হয়। দ্বিতীয় মুদ্রণ সিগনেট প্রেস। ‘হযবরল’-তে এমন কিছু দার্শনিক ধারণা মেলে যা হয়তো ছোটোদের নয়, কিন্তু বড়োদের অনেক হিসেব-নিকেশ তালগোল পাকিয়ে দেয়। কারণ এখানে এমন এক স্বপ্ন-র শিল্পমহল তৈরি হয়ে আছে চিহ্ন ও চিহ্নিত-র মধ্যেকার ভাগাভাগিটাকে গুলিয়ে দেয়। ছোটোদের মন এই এলোমেলো হয়ে যাওয়াটা নিয়ে একেবারেই বিচলিত হয় না কারণ চিহ্ন-র জগতে তারা ঢুকে যদি পড়েও তারা অনায়াসে সেখান থেকে বেরিয়ে পড়ে। তা ছাড়া ‘হযবরল’ পড়া যায়া রীতিনীতিহীনভাবেই, শুধুমাত্র মজাদার চরিত্রগুলির রসিকতা উপভোগ করে। মনে রাখা দরকার সুকুমার রায়কে কোনওভাবে শিশু সাহিত্যিক এই অভিধায় আটকে রেখে তাঁর রচনার রস উপভোগ সম্ভব নয়।
কেবলমাত্র ‘আবোল তাবোল’ কিংবা ‘হযবরল’-ই নয়, তার প্রবন্ধ-নিবন্ধ-অন্যান্য রচনা কি আমাদের একটি অবিভক্ত স্বর্গের তোরণ দ্বারে হাজির করে না? সেখানে ছোটোরা, বড়োরা সবাই তো হাজির হয়ে যায় কারণ যখনই ব্যবহারিক জগতের অভিভাবকত্বের দমন থেকেও এমন কোনও মুহূর্ত হাজির হয়ে যায় তাকে কমিক মুহূর্ত কিংবা হাস্যরসের ফোঁটা যাই বলি না কেন আসলে তখন শুধু মনে মনে নয় প্রাণে প্রাণেও হেসে উঠি, হেসে উঠতে চাই হো হো করে। এরও পিছনে একটি নিহিত দর্শন রয়েছেন—যে ভুল আইনকানুন, রীতিনীতিতে অবরুদ্ধ, অভ্যস্ত আমরা মানিয়ে নেওয়া নামক বেড়াজাল থেকে নিজেকে সামান্য সময়ের জন্য হলেও মুক্ত করে ফেলি। সুকুমার রায়ই পারেন সেই ঐশী বিভূতি ছড়িয়ে দিতে, মুক্তির দিকে উদ্বুদ্ধ করতে। মেঘমুলুকে ঝাপসা রাতে রামধনুকের আবছায়াতে আপনাকে আপন হতে খেয়াল স্রোতে ভাসিয়ে দিয়ে আরোগ্যময়তার যে সব নিদর্শন তিনি রেখে গেছেন তা তথাকথিত আধুনিকতা-প্রযুক্তি নির্ভরতায় পর্যুদস্ত ছোটো-বড়ো সবারই উত্তরণের পক্ষে কতভাবে কতখানি প্রয়োজন তা মনে হয় না আকুল রেখে রেখে উদাহরণ আর প্রমাণ করার অপেক্ষা রাখে।
Be the first to comment