রাজকুমার ঘোষঃ
স্কুল থেকে প্রতিদিন ফেরার পথে নিজের অজান্তেই সাইকেল নিয়ে চলে যেতাম ভানুমতী বালিকা বিদ্যালয়ের কাছে। কোনো দিন তাকে দেখতে পেতাম আবার কোনোদিন পেতাম না । যেদিন পেতাম আনন্দে চলে আসতাম আমার বন্ধু শুভ-র কাছে । বেশ উৎফুল্ল হয়ে ওকে আমার মনের কথা বলতাম, আর বলতাম সেই মেয়েটার কথা, যে আমার অবচেতন মনে কবে জায়গা করে নিয়েছে, সে আমার স্বপ্নে আসে বারে বারে । শুভ আমার কথা গুলো শুনতো আর বেশ মজা নিতো । আর ভীষণ বার খাওয়াতো । কিন্তু আমার এই ভালোলাগা বা ভালোবাসার ব্যাপারে কিছুই বলতো না । তবুও শুভকেই বন্ধু ভেবে আমি আমার মনের এ টু জেড সব বলতাম ।
আমার বাড়ীর চিলে কোঠার ঘরে বসে আমি প্রতিদিন ভোর ৬টা থেকে ৯টা পর্য্যন্ত পড়াশোনা করতাম । আর আমার চোখ চলে যেত চিলে কোঠার ঘরের জানালা থেকে সোজা রাস্তার দিকে । সেই মেয়েটা কাঁধে স্কুলব্যাগ নিয়ে ৬টার সময় ঐ রাস্তা দিয়ে যেতো, আর ফিরতো ঠিক সকাল ৯টার সময় । আমার সকাল বেলার ৩ ঘন্টা পড়াশোনার আগ্রহ দেখে বাবা-মা দারুন খুশি । আর আমিও খুব খুশি । আর আমার আগ্রহ দিন দিন ওই ৬টা থেকে ৯টায় আটকে গিয়েছিল । কি যে ভাল লাগত সে আর বোঝানো সম্ভব নয় । এইভাবে মাধ্যমিকের গন্ডি মোটামুটিভাবে উতরে গেলাম । এরপর পরের প্লাটফর্মে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি । সেইভাবে আমি বিভিন্ন কোচিং-এ ভর্তি হলাম । স্বপন বাবুর কেমিস্ট্রী কোচিং-এ তৃতীয়দিনের ক্লাস করার উদ্দেশ্যে গিয়েছি, হঠাৎ আমার সামনে দেখি সেই মেয়েটি । আমি কি করবো বুঝতে পারছি না, একেবারে হতভম্ব ।
এরপর থেকে কেমিস্ট্রী কোচিং-এ আমার খুব আগ্রহ বেড়ে গেল । কেমিস্ট্রীর মতো কড়াপাকের সাবজেক্টকেও আমার সহজ মনে হতে লাগল । আমি যে খুব মেধাবী সেটা বোঝাতে হবে মেয়েটাকে । কিছুদিন পর দেখি ম্যাথ স্যার সুজিত সেন এর কোচিং-এ মেয়েটি ভর্তি হয়েছে আমাদের ব্যাচে । আর প্রথম বার আমার সাথে কথাও বলল। নিজেকে ব্যাপক স্মার্ট মনে হতে লাগল । মেয়েটি আমার খুব ভালো বন্ধু হয়ে গেল । সেই মেয়েটাকে আমি তুলি বলে ডাকতে লাগলাম । আমরা একে অপরের বাড়িতে যেতাম । এক সাথে মাঝে মাঝে পড়াশোনাও করতাম । ওর উপস্থিতি আমার কাছে ভীষণ মধুর লাগতো, ওর আমাকে কেমন লাগতো জানি না । ভগবান কে বলতাম, যাকে আমি শুধু দূর থেকে দেখতাম সে এখন আমার খুব কাছের বন্ধু । আমি খুব খুশি, কিন্তু আমার এই খুশির কথা তুলি কে ঘূণাক্ষরে বুঝতে দিইনি বা বোঝাতেও চাই নি । সেই ক্লাস নাইন থেকে আমি যে ওকে ভালোবেসে আসছি, সেটাও আমি ওকে কখনো বুঝতে দিইনি । এই কথা শুধু আমার বন্ধু শুভ জানতো । ইতিমধ্যে শুভও কোচিং-এ ভর্তি হয়েছে । ওর সাথে তুলির ও পরিচয় হয়েছে এবং বন্ধুও হয়ে গেছে দুজনে । কিন্তু কেন জানিনা, আমার সাথে তুলির এই বন্ধুত্ত্ব শুভ সহ্য করতে পারতো না । তুলি আমার কাছে যে কি, সেটা কেউ না জানুক, শুভ জানে । কিন্তু ও আমার সম্বন্ধে তুলিকে, আর তুলির সম্বন্ধে আমাকে ভুলভাল বলতে লাগল । এতে আমার আর তুলির মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি হতো, ভীষণ ঝামেলা হতো । আমাদের বন্ধুমহলে তুলি ও আমাকে নিয়ে মুচমুচে চানাচুরের মতো খবর রটে গেল যে আমাদের মধ্যে প্রেম নাকি জমে ক্ষীর । আমি ভীষণ ভাবে হতবাক । এইসব শুভর সামাজিক কাজ আর কি ! তুলি ও ভীষণ ভাবে হতাশ হল । ও আমাকে সম্পূর্ণ ভাবে ভুল বুঝলো । ও আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিল । তুলি ধরে নিয়েছে এই সব মুচমুচে খবর আমিই রটিয়েছি । তুলি আমাকে একদিন ডাকলো ওর বাড়িতে । আমি খুব ভয় পেয়ে গেলাম । ও বললো ওর বাবা-মা আমার সাথে কথা বলতে চায় । আমার বুক ধরফর করতে লাগল । বেশ স্বাভাবিক হয়ে আমি ওদের বাড়িতে গেলাম, সেদিন ও আমাকে ওর ছাদের ঘরে নিয়ে গেল । আমার তুলিকে বেশ অচেনা মনে হলো । কেমন যেন আলাদা আলাদা লাগছে । বুঝতে পারছি না আমি তুলিকে কি বলব । তুলি আমার হাতে একটা ছোট কাগজ ধরিয়ে দিল আর দেখতে বলল । কাগজটা ভালো করে দেখতেই আমি ভীষণ অবাক হয়ে গেলাম । এরপর তুলি কাঁদতে কাঁদতে কাগজের সেই লেখাটাই আমাকে বললো আর আমাকে ওর বুকে জ়ড়িয়ে নিল । আমিও ওকে বেশ আস্বস্ত করে বললাম “আই লাভ ইউ টু”……
Be the first to comment