প্রায় এক দশক হতে চলল তিনি সক্রিয় রাজনীতির আড়ালে চলে গিয়েছিলেন। ইদানীং তাঁর খোঁজখবর বিশেষ পাওয়াও যেত না। বুধবার বিকেলে চিরতরে লোক চোখের আড়ালে চলে গেলেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী।
শুধু বিজেপি রাজনীতিতে কেন, বাজপেয়ীর মৃত্যুতে সর্বভারতীয় রাজনীতিতে একটা যুগের যেন অবসান হয়ে গেল! স্বাধীনতা উত্তর সময়ে দেশে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে বিকল্প রাজনৈতিক শক্তির উত্থানের জন্য ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে থাকবেন মধ্যপ্রদেশের গোয়ালিয়রের এই সন্তান।
হৃদরোগে ও কিডনির সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে গত ১১ জুন এইমসে ভর্তি হয়েছিলেন বাজপেয়ী। তখন থেকেই এইমসে চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। ১৪ অগস্ট দুপুর থেকে তাঁর শারীরিক অবস্থার আরও অবনতি হয়। বুধবার বিকেলে ডাক্তাররা জানান, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছে। তার পর বৃহস্পতিবার সাড়ে বিকেল পাঁচটা পাঁচ নাগাদ এইমস কর্তৃপক্ষ মেডিকেল বুলেটিনে জানিয়ে দেয়, তিনি আর নেই।
২০০৮ সাল থেকেই শরীর ভাল যাচ্ছিল না বাজপেয়ীর। তখনও লখনউয়ের সাংসদ তিনি। কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার কারণে সংসদে আসা বন্ধ করে দিয়েছিলেন বাজপেয়ী। তার পর ২০০৯ সালে একবার বড় রকমের হৃদরোগে আক্রান্ত হন তিনি। তখন থেকেই তিনি প্রায় কাউকেই আর চিনতে পারতেন না। বসিয়ে রাখলে বসে থাকতেন, শুইয়ে দিলে সে ভাবেই। এমনকী ২০১৫ সালে তাঁর বাড়ি বয়ে গিয়ে তাঁকে ভারত রত্ন সম্মানে ভূষিত করেছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। সে দিনও চুপচাপ চেয়ারেই বসেছিলেন তিনি। কোনও সাড়া শব্দ করেননি।
এই বাজপেয়ীকে অবশ্য চিনতেন না রাজনীতিতে অনেকেই। বরং তাঁরা এখনও চোখ বুজলে যেন দেখতে পান সংসদের ভিতরে বাইরে সেই প্রাণবন্ত মানুষটিকে। বেশ খানিকটা থেমে থেমে কথা বলতেন। তার পর বাছা বাছা শব্দ সাজিয়ে কখনও এমন কথা বলতেন যে, জাতীয় রাজনীতির গায়ে তীরের মতো বিঁধত। কখনও বা তাঁর কথায় হেসে গড়িয়ে পড়তেন সতীর্থরা। কখনও রাজনৈতিক মর্মোদ্ধার করতে খুব কাছের মানুষ জনেরও লেগে যেত অনেকটা সময়।
রাজনীতিতে তাঁর গ্রহণযোগ্যতাও ঈর্ষা করার মতো! ইদানীং যখন শাসক-বিরোধী নেতাদের এতো আকচাআকচি, তখন অনেকেরই মনে পড়ে যায় বাজপেয়ীর কথা। বাংলাদেশ যুদ্ধের পর যিনি কোনও দ্বিধা না রেখেই ইন্দিরা গান্ধীকে মা দুর্গা বলে সম্মোধন করেছিলেন।
বাজপেয়ী ছিলেন এমনই। গেরুয়া রাজনীতির বৃত্তে থেকেও উগ্র ধর্মীয় রাজনীতিকে কখনও প্রশ্রয় দেননি তিনি। যথার্থ রাষ্ট্রনেতার মতোই কখনও কঠোর। কখনও উদার। রাজধর্ম পালনে অটল। গুজরাতে দাঙ্গার পরে বাজপেয়ী তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে নিয়ে এতটাই অসন্তুষ্ট ছিলেন যে তিনি মোদীকে পদ থেকে সরানোর বিষয়ে কার্যত মনস্থির করে ফেলেছিলেন। সে দিন লালকৃষ্ণ আডবাণী না থাকলে মোদীকে কেউ বাঁচাতে পারত না।
ধর্ম ও রাজনীতির সংকীর্ণতার তুলনায় তাঁর কাছে প্রাধান্য পেয়েছিল আর্থিক ও প্রশাসনিক সংস্কার। দেশে টেলিকম বিপ্লব ঘটানো, সোনালি চতুর্ভূজের নির্মাণ। অপূর্ণ ইচ্ছা রয়ে গিয়েছিল ভারত জুড়ে নদী সংযুক্তিকরণের।
রাজনীতিতে তাঁর ঘোর বিরোধীরাও তাই বলেন, সংঘাত, ঘৃণা ও অবিশ্বাসের রাজনীতি যখন দেশকে আচ্ছন্ন করে ফেলছে তখন ফের ওই মানুষটিকেই দরকার। সশরীরে না থাকলেও তিনি অন্তত ভাবনায় থাকুন। যিনি বলেছিলেন, “সত্তা কা খেল তো চলেগা / সরকার আয়েঙ্গি, জায়েঙ্গি, পার্টিয়া বনেঙ্গি, বিগড়েঙ্গি/ মগর ইয়ে দেশ রহেনা চাহিয়ে / ইসকা লোকতন্ত্র অমর রহেনা চাহিয়ে”।
বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী জে পি নাড্ডা বললেন, বাজপেয়ী ইজ ভেরি ক্রিটিক্যাল। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর শারীরিক অবস্থা খুব খারাপ। চিকিৎসায় সাড়া দিচ্ছেন না। তার পরেই বদলে যায় বিজেপি অফিসের ছবি। বুধবার স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে বিজেপির দলীয় অফিস সাজানো হয়েছিল ফুল দিয়ে। খুব দ্রুত সেই উৎসবের সাজসজ্জা খুলে ফেলা হয়।
বাজপেয়ির বাড়ি ৬ এ কৃষ্ণমেনন মার্গের বাড়ির সামনে একটি মঞ্চ বাঁধতে দেখা যায়। এই দেখে মানুষের মধ্যে জল্পনা ছড়ায়, বাজপেয়ীর অবস্থা ঠিক কতদূর খারাপ। বিকাল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ খবর আসে, তিনি আর নেই।
Be the first to comment