সে সময় মুর্শিদাবাদের রাজনীতিতে তাঁকে ‘দাবাং’ বললেই চলে! লাল সন্ত্রাসের পরিবেশে নইলে রাজনীতিতে টিকে থাকাই মুশকিল হতো! সনিয়া গান্ধীও তাই ঘরোয়া মহলে তাঁকে ‘রবিনহুড’ বলেই ডাকতেন।
সেই তিনি, বহরমপুরের কংগ্রেস সাংসদ অধীর রঞ্জন চৌধুরী একদিন সংসদের অলিন্দে অটলবিহারী বাজপেয়ীকে ঢিপ করে প্রণাম করে বসলেন। ঝুঁকে পড়ে পায়ে হাত দিয়ে! কংগ্রেস, বিজেপি, রাজনীতি, মতাদর্শ, ছুঁতমার্গ — আশপাশে তখন কারও দেখা নেই! ভাল ছবি হতে পারত! ফ্রেমের মধ্যে কেবল বাজপেয়ী তাঁর নিরাপত্তায় এসপিজি জওয়ানরা এবং অধীর চৌধুরী।
ঘটনাটা ১৯৯৯ সালের কোনও এক সময়ে। সবে মাত্র বহরমপুর লোকসভা কেন্দ্র থেকে ভোটে জিতেছেন অধীরবাবু। লোকসভার সদস্য হয়েছেন। অটলবিহারী বাজপেয়ী তখন দেশের প্রধানমন্ত্রী। সংসদে বিরোধী বেঞ্চে বসে কিছুটা তফাত থেকে অধীরবাবু রোজ দেখেন বাজপেয়ীকে। এবং তাঁর বাগ্মিতায়, স্বভাবে, আচরণে, হেঁয়ালি মাখানো কথায় মুগ্ধ হন।
একদিন দেখলেন বাজপেয়ীজি লোকসভা দিয়ে বেরিয়ে পার্লামেন্টের লবি দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। অধীরবাবুও পিছনে হাঁটা লাগালেন। পাশাপাশি এসে বললেন, একটু দাঁড়াবেন! বাজপেয়ী বিস্মিত! বললেন, কেন, কোনও দরকার আছে? সংসদের প্রথমবারের সাংসদ বললেন, না কাজ নেই। আপনাকে একটু প্রণাম করতে চাই। এমনি। বাজপেয়ী এবার ইতস্তত। তবে বাধা দেননি। বলেছিলেন, ভাল থাকবেন।
বাজপেয়ীর মৃত্যুর পর এই স্মৃতিচারণা করেছেন অধীরবাবু নিজেই। বলেছেন, বাজপেয়ী গ্রহণযোগ্যতা ছিল একেবারে অন্যরকম। এটা ঠিক তাঁর দলের রাজনৈতিক মতাদর্শের থেকে কংগ্রেস ছিল ভিন্ন মেরুতে। কিন্তু রাজনীতির উর্ধ্বে উঠে সময় বিশেষে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে চলতে পারতেন তিনি। অসাধারণ বাগ্মিতায় মন জয় করে নিতে পারতেন তাঁর অতি বড় সমালোচকদেরও।
তার পর প্রায় দু’দশক কেটে গিয়েছে। সংসদের অলিন্দে ঘুরে এই দু’দশকে পোড় খাওয়া রাজনীতিক হয়ে উঠেছেন অধীর চৌধুরী। এখন পশ্চিমবঙ্গের প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি তিনি। কিন্তু এখনকার পরিণত রাজনৈতিক চিন্তার সঙ্গে সে দিনের তরুণ অধীর চৌধুরীর ভাবনার মধ্যে এখনও ফারাক নেই। তাঁর একবারও মনে হচ্ছে না, বাজপেয়ীজিকে সে দিন প্রণাম করা ভুল হয়েছিল! বরং প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতির কথায়, “রাজনীতিতে ইদানীং সৌজন্যের বড়ই অভাব। বিশেষ করে বাংলার রাজনীতিতে তো বটেই। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ মানে তো শত্রু নয়! লড়াইটা এখানের মতের সঙ্গে মতের, পথের সঙ্গে পথের। ব্যক্তিগত সম্পর্কে সৌজন্য থাকবে না কেন?”
তাঁর কথায়, বাজপেয়ীর শেষযাত্রায় শুক্রবার স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে মানুষের যে ঢল নেমেছিল দিল্লির রাজপথে তা ২৭ বছর আগের কথা মনে পড়িয়ে দেয়। রাজীব গান্ধীর মৃত্যুর পর এমন ভাবেই আবেগ উপচে পড়েছিল। তখনও পুরোদস্তুর রাজনীতিতে ছিলেন রাজীব। কিন্তু বাজপেয়ীর প্রধানমন্ত্রিত্ব চলে গিয়েছিল ২০০৪ সালে। গত দশ বছর লোকে প্রায় তাঁকে দেখেই নি! তার পরেও এই আবেগ, ভাবা যায় না!
প্রসঙ্গত, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গেও ব্যক্তিগত স্তরে অধীরের পরিচয় মন্দ নেই। বেশ কিছু দিন আগে একবার গুজরাতের কচ্ছ্বে বেড়াতে গিয়েছিলেন বহরমপুরের সাংসদ। তার পর একদিন সংসদের লবি দিয়ে যাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী তখন লোকসভার ঠিক বাইরে লবিতে একটি চেয়ারে বসে রয়েছেন। সামনে দাঁড়িয়ে দুই মন্ত্রী অনন্ত কুমার এবং বিজয় গোয়েল। দূর থেকে বহরমপুরের সাংসদকে দেখে নরেন্দ্র মোদী ডাকেন, “আরে অধীর! কচ্ছ্ব ক্যায়সা লাগা?”অধীরবাবু এক গাল হেসে দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসেন মোদীর দিকে। করমর্দন করে বলেন, “বহুত আচ্ছা লাগা। বহুত আচ্ছা!”
Be the first to comment