সহেলী রায়
মেহুলীর রোববারটা একেবারেই বিছানা ছাড়তে চাই না। সপ্তাহের এই একটা দিন সারা সপ্তাহের ধকলের একটি বিশ্রাম দিবস হিসেবে রেখেছে সে। কিন্তু সকাল থেকে বন্দনার খুট খাট শব্দে ঘুম যেন চোখ ছুঁয়ে আবার তছনছ হয়ে ভেঙে যায়। চোখ বন্ধ করে ঘুমের বন্দনা করতে থাকলেও কিছুতেই বাগে আনতে পারে না।
-‘উফ, বন্দনা কি যে কর না সকাল থেকে’
-‘ কি করব দিদিভাই, আমার ভোরে ঘুম ভেঙে যায়, তাছাড়া বাড়ির কাজগুলো তো সব সারতে হবে নাকি? কাল থেকে তো পায়ে জিন লাগাবে। দু তিনটে রান্না আমায় করে রাখতে হয়,কিছু কেটে বেটে রেডি রাখতে হয়, আমি তোমার সাথে পাল্লা দিতে পারি না বাপু’।
মেহুলী খবরের কাগজে ডুবে যায়। আজ প্রায় বারো বছর বন্দনা মেহুলীর সঙ্গী। এই তিন বেডরুমের বিশাল ফ্ল্যাটটা জুড়ে তাদের সংসারিকা। এত বড় ফ্ল্যাটের প্রয়োজনীয়তা ছিল কিনা জানা নেই মেহুলীর কিন্তু তার বর্তমান স্ট্যাটাস টা বোঝাতে গেলে এটা খুব দরকার। একটি নাম করা বিজ্ঞাপণ সংস্থার ম্যানেজিং ডিরেক্টর সে। তার এই ফ্ল্যাট এ মাঝে মধ্যেই তার বন্ধুবান্ধবরা হামলা করে।তার সংসারের ম্যানেজিং ডিরেক্টর বন্দনা তখন সব সামাল দেয়। মেহুলী এ সংসারের ধারে পাশেও থাকে না। শুধু টাকা ফুরলে বন্দনাকে সেটা দিয়ে দেওয়া ছাড়া তার কোন দায়িত্ব নেই। বন্দনা বহুবার হিসেব বোঝাতে গেছে। মেহুলী খুব বিরক্ত প্রকাশ করেছে। এই সংসার ব্যাপারটা বুঝতে পারলে সুরঞ্জন তার জীবনে থাকত।
পেপারটা চোখ বোলাতে বোলাতে স্মার্টফোনে বোতাম টিপে বিতানকে মেসেজ পাঠাল মেহুলী
– ‘সুপ্রভাত’
– ‘সুপ্রভাত মেহু পাখি’ বিতানের জবাব
বিতান তাকে এ নামেই ডাকে। মেহুলী অবশ্য খুব আনন্দ পায় এতে। সারাক্ষণ দৌড়ের মধ্যে একমাত্র বিতান ই মনে করিয়ে দেয় মেহুলীর নিজের একটা অস্তিত্ব আছে। প্রতিদিন রাতে এগারোটা থেকে বারোটা স্কাইপে বিতানের সাথে থাকে মেহুলী। এই একটা সময় ই মেহুলীর খুব নিজের। সুরঞ্জন কে ছেড়ে চলে আসার পর বাপ মা মরা মেহুলীকে অনেকটাই সামলেছে বন্দনা। তার অগোছালো জীবনযাপন কে পুরোটাই হাতে ধরে গুছিয়েছে সে। শেষ দুবছর বিতান কানায় কানায় পরিপূর্ণ করছে তার জীবন। বিতান সিঙ্গাপুরে একটা ছোটখাটো বিজনেস চালায়। বিতানের স্ত্রী একটি ফ্যাশন ম্যাগাজিনের ফটোগ্রাফার। এদেশ সেদেশ ঘুরে বেড়ায় সে তার কাজে। মেহুলীর কোম্পানির একটি সিস্টার কোম্পানি আছে সিঙ্গাপুরে। সেখানেই বিতানের কোম্পানির কিছু বিজ্ঞাপন বানিয়েছে মেহুলী। সেই সূত্রেই আলাপ। তারপর দুজনের নিঃসঙ্গতা কখন একে অপরকে এক্কেবারে কাছাকাছি এনে ফেলেছে সে খবর নেই কারোর কাছেই। বিতানের শান্ত স্বভাব সবচাইতে বেশী আকর্ষণ করে মেহুলীকে। মেহুলীর মধ্যে সবসময় একটা অস্থিরতা কাজ করে। বিতানের সামনে সেই অস্থিরতা যেন একনিমেষে উবে যায়। যখনি কলকাতার আবহাওয়ায় হাঁফিয়ে ওঠে তার মন তখনি সে হাওয়া বদল করতে পালিয়ে যায় বিতানের শহরে। একসাথে কটা দিন কাটালেই মেহুলী আবার নতুন উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
একটা সাদা খোলের শাড়ি পরেছে বন্দনা আজ। মেহুলীর ই দেওয়া। স্নান করে শাড়িটা পরে বেশ দেখাচ্ছে বন্দনাকে। খোলা দরজা দিয়ে বন্দনাকে দেখা যাচ্ছে তার ঘরে কোলে তার মৃত স্বামীর ছবি। অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছে বন্দনা ছবিটার দিকে। খুব মায়াময়ী লাগছে বন্দনাকে। এক মুহূর্তের জন্য মেহুলী ভাবল, কি এমন আছে ওই মৃত ছবিটায় যা বন্দনাকে এত তৃপ্ত করছে। আট বছর আগে রোগে ভুগে মারা যায় বন্দনার স্বামী। তার ও দু বছর আগে মেহুলীর কাছে আসে বন্দনা তার অসুস্থ স্বামীকে সারিয়ে তোলার জন্যে। কিন্তু শত চেষ্টা করেও মানুষটা কে বাঁচানো যায়নি।
খেতে বসে মেহুলী আর কৌতূহল চাপতে পারল না।
– ‘কি দেখো বন্দনা ওই ছবিটার মধ্যে ?’
– ‘তোমার কাছে যখন থেকে আছি দিদিভাই , অভাব কাকে বলে ভুলে গেছি। ওই মানুষটা অভাব ভোলাতে পারেনি। তবে একটা সুখ, তৃপ্তি ঘিরে থাকতো। ‘
– ‘ সে তো মানুষটা যখন জীবিত ছিল, এখন কি পাও বন্দনা?’ – মেহুলী সত্যি অবাক হয়ে জানতে চাইল।
– ‘ নিজের জিনিস আবার জীবিত আর মৃত কি দিদিভাই? এ তো পরের জিনিস নয়। আমি এখনো ওই ছবির দিকে তাকিয়েই সেই সুখ খুঁজে পাই। তুমি ওসব বুঝবে না।‘
পরের জিনিস? মেহুলী মুখের রঙটা যেন কেমন বদলে গেল। হ্যাঁ পরের ই তো বোধহয়, একটা মৃত ছবি বন্দনাকে যা দেয়, বিতান কি?-
এখুনি তার একবার বিতানকে খুব দরকার। মনটা খুব অস্থির করছে। মেসেজ টাইপ করল।
– ‘কি করছ? খুব কথা বলতে ইচ্ছে করছে’
ঝকঝকে স্মার্টফোনের মেসেজ টোন বেজে উঠল।
– ‘ মেহু এক্ষুনি ভাবছিলাম তোমায় মেসেজ করব, কাল আমার রানীর বিবাহবার্ষিকী , পাঁচ বছর পূর্ণ হবে। আমরা আর খানিক্ষনের মধ্যেই বাংলাদেশ যাচ্ছি। এই প্রথম রানী আমার পছন্দের জায়গায় বেড়াতে যাচ্ছে। আমার খুব ভালো লাগছে। কটা দিন তোমার সাথে কথা বলতে পারব না মেহু। নিজের খেয়াল রেখো। ফিরে জানাবো।‘
পাশের ঘর থেকে বাসনের খুটখাট শব্দ আর মাঝে মাঝে বন্দনার গুন গুন গান আবহ সংগীতের মতো ভেসে আসছে। খুব অচেনা লাগছে বন্দনাকে মেহুলীর। নিজের থেকেও বেশী অচেনা।
Be the first to comment