চট্টগ্রামের হাসপাতালে প্রয়াত ‘একাত্তরের জননী’

Spread the love
প্রখ্যাত লেখিকা  রমা চৌধুরী (৭৮) চলে গেলেন। গত সোমবার (৩ সেপ্টেম্বর) ভোরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হসপিটালে প্রয়াত হয়েছেন বাংলাদেশের সর্বজনশ্রদ্ধেয়া এই মুক্তিযোদ্ধা।
একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে রাজাকার ও খানসেনাদের হাতে সম্ভ্রম হারিয়েছিলেন হাজার হাজার বাঙালি মা বোন। তাঁদেরই একজন ছিলেন চট্টগ্রামের রমা চৌধুরী। একাত্তরের ১৩ মে ভোরে , নিজের বাড়িতেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর  হাতে নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন রমা চৌধুরী।  খানসেনাদের হাতে সম্ভ্রম হারানো রমা চৌধুরী সারাটা জীবন সংগ্রাম করেই কাটিয়েছেন। স্বাধীন বাংলাদেশে হারিয়েছেন তাঁর তিন সন্তানকে ।
‘একাত্তরের জননী’ বইটির শুরুতেই বীরাঙ্গনা রমা চৌধুরী লিখেছেন, “সবদিক ভেবে দেখলে একাত্তরের জননী আমি নিজেই। পাক হানাদার বাহিনী আমাকে প্রাণে না মারলেও আমার আত্মার অপমৃত্যু ঘটিয়েছে, যার ফলে নেমে এসেছে জীবনে শোচনীয় পরিণতি। আমার দুটি মুক্তিপাগল অবোধ শিশুর সাধ স্বপ্ন আশা আকাঙ্ক্ষা ভরা জীবন কেড়ে নিয়েছে বাংলার মুক্তিসংগ্রাম…।“ ওই ভয়ংকর মুহূর্তটির বর্ণনাও রয়েছে ‘একাত্তরের জননী’ বইতে: ‘যখন আমাকে নির্যাতন করতে উদ্যত হলো পাক সেনা, তখন জানালার পাশে দাঁড়ানো আমার মা ও দুই ছেলে বারবার আকুতি করছিলেন। ছিল আমার পোষা বিড়াল কনুও। তখন আমি মাকে আমার সন্তানদের নিয়ে সরে যেতে বলেছিলাম।’
১৯৪১ সালের ১৪ অক্টোবর , চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার পোপাদিয়া গ্রামে জন্মগ্রহন করেন বীরাঙ্গনা রমা চৌধুরী। ১৯৬১ সালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে কক্সবাজার বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তখন তাঁর বয়স মাত্র ২০ বছর।ছোটবেলা থেকে লেখালেখিও করতেন। ১৯৭১ সালে হলেন বোয়ালখালী বিদু গ্রাম উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে তাঁর স্বামী, বীরাঙ্গনা রমা চৌধুরী ও তিন সন্তানকে রেখে ভারতে চলে যান। এরপর শুরু হয় তাঁর দুঃখের দিন । ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে মাস। স্বাধীন বাংলাদেশ যখন বিজয়ের আনন্দে উত্তাল, তখন বোয়ালখালীর পোড়া ভিটের কোলের শিশুকে বাঁচাতে লড়ছেন নিঃসঙ্গ , ধর্ষিতা রমা চৌধুরী। না ,শিশুটিকে বাঁচাতে পারেননি তিনি। নিউমোনিয়া আক্রান্ত বড় ছেলে সাগর মারা গেল ২০ ডিসেম্বর । পরের বছর ১৫ ফেব্রুয়ারি মারা যায় রমা চৌধুরীর মেজ ছেলে টগরও। পুত্রশোকে উন্মাদপ্রায় রমা চৌধুরী সেই দিন থেকে আর পায়ে জুতো পরেননি।
সন্তানহারা মা রমা চৌধুরী বলতেন , ‘আমার ছেলেদের আমি পোড়াতে দিইনি। এই মাটিতে তারা শুয়ে আছে। আমি কীভাবে জুতা পায়ে হাঁটি। পারলে তো বুক দিয়ে চলতাম–ফিরতাম। তারা কষ্ট পাবে।’ একবার তিনি বলেছিলেন , ‘আমার সন্তানেরা শহীদের মর্যাদা পায়নি। কিন্তু তারা আমার কাছে শহীদ। কারণ একাত্তর আমাকে দিয়েছে ‘পোড়া ভিটে, কাঁধের ঝোলা, ছেলের শোক আর খালি পা।’
নিজের এবং একমাত্র জীবিত ছেলের মুখের ভাত জোটাতে প্রায় ৩০ বছর ধরে খালি পায়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে নিজের লেখা বই বিক্রি করেছেন তিনি। কখনও কারও কাছে সাহায্যের জন্য হাত পাতেননি। বীরাঙ্গনা রমা চৌধুরী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহায্যের প্রস্তাবও ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। সংবাদ মাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে রমা চৌধুরীর কথা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানতে পারেন। ২০১৩ সালের ২৭ জুলাই , গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর সাথে দেখা করার জন্য অনুরোধ করেন। প্রধানমন্ত্রী সেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেন রমা চৌধুরী। তবে একটাই শর্তে , কোনো ধরনের সাহায্য নেবেন না ।
আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে নিজের লেখা বই  বিক্রি শুরু করেন রমা চৌধুরী। ২০১৭ সালের জুন মাস পর্যন্ত ঘুরে ঘুরে বই ফেরি করে গেছেন তিনি। ১৯৯৮ সালে, আরেক বিজয় দিবসে রমা চৌধুরীর চতুর্থ ছেলে টুনু সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। মানসিক ভাবে সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়েন রমা চৌধুরী। এই সময় তাঁর পাশে এসে দাঁড়ান আলাউদ্দিন খোকন । খোকন নিজে একজন একজন সাংস্কৃতিক কর্মী এবং লেখক। রমা চৌধুরীর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত খোকন তাঁর দিদির পাশেই ছিলেন । রমা চৌধুরীর বইয়ের তালিকা নিচে দেওয়া হলো। বইগুলি রমা চৌধুরী নিজেই প্রকাশ করেছেন।রোদ জল বৃষ্টিতে দরজায় দরজায় মেলায় মজলিশে ঘুরে ঘুরে বই বিক্রি করতেন। তাই তার প্রকাশনার নামও “মাধুকরী প্রকাশন”।
রবীন্দ্র সাহিত্যে ভৃত্য, নজরুল প্রতিভার সন্ধানে মূল্য, সপ্তরশ্মি , চট্রগ্রামের লোক সাহিত্যের জীবন দর্শন, অপ্রিয় বচন, যে ছিল মাটির কাছাকাছি , ভাব বৈচিত্রে রবীন্দ্রনাথ , নির্বাচিত প্রবন্ধ।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*