আত্মবিশ্বাস ভাল, কিন্তু অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস যে ভরাডুবিরও কারণ হতে পারে কর্নাটকে তা যেন হাড়ে হাড়ে টের পেল বিজেপি!
উনিশের ভোট আসছে। তার আগে দক্ষিণের এই রাজ্যে তিনটি লোকসভা ও দুটি বিধানসভা আসনের উপ নির্বাচনে এক প্রকার ভরাডুবি হল গেরুয়া শিবিরের। মোদী-অমিত শাহদের সব থেকে অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠল বেল্লারিতে বিপর্যয়! বেল্লারি লোকসভা কেন্দ্র বিজেপি-র থেকে ছিনিয়ে নিয়ে প্রায় আড়াই লক্ষ ভোটের ব্যবধানে জিতে গেল কংগ্রেস। বেল্লারির পাশাপাশি কংগ্রেস জিতে নিয়েছে জামাখণ্ডি বিধানসভা আসন। অন্যদিকে কংগ্রেস-জেডিএস সরকারের মুখ্যমন্ত্রী কুমারস্বামীর দল জিতে নিয়েছে মান্ডিয়া লোকসভা আসন। সেই সঙ্গে রামনগর বিধানসভা কেন্দ্র স্বস্তিজনক ব্যবধানে জিতে নিয়েছেন কুমারস্বামীর স্ত্রী অনিতা কুমারস্বামী। বিজেপি জিতেছে কেবল শিবমোগ্গা লোকসভা কেন্দ্রটি।
মাস কয়েক আগে কর্নাটকে বিধানসভা ভোট হয়েছিল। তখন একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল না হলেও সরকার গড়ার সমস্ত চেষ্টা করেছিলেন অমিত শাহরা। এমনকী ইয়েদুরাপ্পাকে মুখ্যমন্ত্রী পদ প্রার্থী করে শপথ গ্রহণের ব্যবস্থাও প্রায় করে ফেলেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রাহুল গান্ধী-কুমারস্বামীর কৌশলের কাছে পরাস্ত হন বিজেপি নেতৃত্ব। তাড়াহুড়ো করে ইয়েদুরাপ্পাকে মুখ্যমন্ত্রী করার জন্য তাঁকে শিবমোগ্গা লোকসভা কেন্দ্র থেকে ইস্তফা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন অমিত শাহ। একই ভাবে বেল্লারির সাংসদ শ্রীরামুলুকেও বলা হয়েছিল লোকসভা থেকে ইস্তফা দিতে। যার ফলে এই দুই লোকসভা কেন্দ্রে উপ নির্বাচন অনিবার্য হয়ে ওঠে।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা গেল শ্রীরামুলুর মন্ত্রী হওয়া তো হলই না উল্টে বেল্লারি হাতছাড়া হল। বেল্লারিতে বিজেপি এ বার প্রার্থী করেছিল শ্রীরামুলুর বোন ভি শান্তা। তাঁকে প্রায় বসিয়ে হারাতে চলেছেন কংগ্রেস প্রার্থী ভি এস উগ্রাপ্পা।
বস্তুত সর্বভারতীয় রাজনীতিতে বেল্লারি লোকসভা কেন্দ্রের নির্বাচন গত বিশ বছর ধরে শিরোনামে রয়েছে। সক্রিয় রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার পর ১৯৯৯ সালে এই বেল্লারি লোকসভা কেন্দ্র থেকে ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন সনিয়া গান্ধী। তাঁকে মোক্ষম লড়াইয়ে ফেলে দিতে বাজপেয়ী-আডবাণী তখন সনিয়ার বিরুদ্ধে প্রার্থী করেছিলেন সুষমা স্বরাজকে। সনিয়ার কাছে সে বার পরাজিত হন সুষমা। সনিয়া ওই আসনটি অবশ্য ছেড়ে দেন। পরে ২০০৪ সালে বেল্লারি থেকে লোকসভা ভোটে জেতেন সুষমা। এবং তাঁর পাদুকা আসনে রেখে খনি অঞ্চল বেল্লারিতে কার্যত রাজত্ব চালাতে থাকেন জনার্দন রেড্ডি ও তাঁর ভাই। যাঁরা রাজনীতিতে রেড্ডি ব্রাদার্স বলেই পরিচিত। সুষমাও প্রকাশ্যে তাঁদের ভাই বলতেন।
কিন্তু পরবর্তী কালে এই রেড্ডি ভাইদের বিরুদ্ধে পাহাড় প্রমাণ দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। এও বলা হয়ে কর্নাটকে বিজেপি-র প্রধান ফান্ড ম্যানেজার তাঁরাই। রেড্ডি ভাইয়ের ছত্রছায়ায় থেকে ফুলে ফেঁপে ওঠেন শ্রীরামুলুও। এবং সে সবের দাপটে ২০০৪ সাল থেকে নাগাড়ে বেল্লারিতে জয়ের পতাকা উড়িয়ে চলে বিজেপি।
বেল্লারিতে বিজেপি-র এ হেন দুর্গের ভিতে মঙ্গলবার যে ধস দেখা গেল তা অনেকেই অশনিসংকেত বলেই মনে করছেন। স্বাভাবিক ভাবেই উপ নির্বাচনের ফলাফলে খুশি কংগ্রেস। নয়াদিল্লির চব্বিশ নম্বর আকবর রোডে কংগ্রেসের সদর দফতরের সামনে আগাম দিওয়ালি শুরু হয়ে গিয়েছে। বাজি, বাদ্যি, স্লোগান মায় মায় দৃশ্যত জমজমাট।
বিপরীতে দীনদয়াল উপাধ্যায় রোডে বিজেপি সদর দফতর খাঁ খাঁ করছে। যদিও ঘরোয়া আলোচনায় দলের এক কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের ফলেই এই ভরাডুবি হল। কর্নাটকে বিধানসভা ভোটে ফল বেরনোর চব্বিশ ঘন্টার মধ্যেই ইয়েদুরাপ্পা ও শ্রীরামুলুর লোকসভা থেকে ইস্তফা দেওয়ার দরকার ছিল না। সে জন্য ৬ মাস সময় ছিল। কিন্তু বাড়াবাড়ি করতে গিয়েই বিপদ হল। দলের শীর্ষ নেতাকে এ ব্যাপারে খোঁচা দিয়ে বিহার বিজেপি নেতা শত্রুঘ্ন সিনহা বলেন, আসনে বিণাশ কালে বিপরীত বুদ্ধি দেখা যায়।
সেই ২০০৪ সাল থেকে বল্লারি লোকসভা কেন্দ্রে টানা জিতে আসছে বিজেপি । কিন্তু মঙ্গলবার সকালে সেই কেন্দ্রের উপনির্বাচনের গণনা শুরু হতে দেখা গেল ভিন্ন ছবি । বিজেপির ভি শান্তাকে পিছনে ফেলে ক্রমেই এগিয়ে যাচ্ছেন কংগ্রেসের ভি এস উগরাপ্পা ।
বল্লারি অঞ্চলে কর্ণাটকে মাইনিং ব্যারন রেড্ডি ভাইদের যথেষ্ট প্রভাব আছে। তাঁরা বিজেপির সমর্থক বলে পরিচিত । সেখানকার সাংসদ ছিলেন বিজেপির স্ট্রংম্যান বলে পরিচিত বি শ্রীরামুলু । তিনি বিধানসভা ভোটে লড়াই করার জন্য ইস্তফা দেন । ভি শান্তা তাঁরই বোন ।
বিজেপির হাত থেকে বল্লারি ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য ব্যাপক প্রচার চালিয়েছিল কংগ্রেস । রাজ্যে জেডি এস-কংগ্রেস জোটের যিনি প্রধান কারিগর, সেই ডি কে শিবকুমার এখানে প্রচারের দায়িত্বে ছিলেন ।
১৯৯৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বল্লারি কেন্দ্রের দিকে নজর ছিল সারা দেশের । কারণ এখানে প্রার্থী ছিলেন কংগ্রেসের তৎকালীন সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী। বিপরীতে ছিলেন বিজেপির শীর্ষস্থানীয় নেত্রী সুষমা স্বরাজ । সেবার সুষমা পরাজিত হন । কিন্তু তার পরের বার থেকে এই আসনটি টানা জিতে এসেছে বিজেপি ।
Be the first to comment