প্রথম ইউপিএ জমানায় মনমোহন সিংহের সেই সাক্ষাৎকারের কথা মনে আছে! ভারত-মার্কিন পরমাণু চুক্তি প্রসঙ্গে উঠতে বসতে হুমকি দিচ্ছেন তৎকালীন সিপিএম সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাট। বলছেন, পরমাণু চুক্তি করলেই সরকার থেকে সমর্থন তুলে নেব! আর সে ব্যাপারে প্রশ্ন করতে একটি সংবাদপত্রে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মনমোহন সিংহ বলেছিলেন, তা হলে তাই করুক!
অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে মনমোহন সিংহের লেখা ৬টি খণ্ডে বই প্রকাশ হয়েছে, ‘চেঞ্জিং ইন্ডিয়া’। যে বইয়ে তিনি শুধু প্রধানমন্ত্রী পদে তাঁর অভিজ্ঞতার কথা লেখেননি, অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞ ও নীতি নির্ধারক হিসাবে তাঁর কর্মজীবনের নানা ঘটনারও বিবরণ ও ব্যাখ্যা দিয়েছেন। মঙ্গলবার তার আনুষ্ঠানিক প্রকাশ হল দিল্লিতে। এ দিন সন্ধ্যায় সেই অনুষ্ঠান মঞ্চে বলতে উঠে, দশ বছর আগের ওই সাক্ষাৎকারের কথা অবশ্য উল্লেখ করলেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী। তবে বললেন, আমি কখনওই মৌন প্রধানমন্ত্রী ছিলাম না। সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে কখনওই ভয় পাইনি।
তাঁর কথায়, “আমি যে মৌন ছিলাম না তা বইগুলিই প্রমাণ করবে। তাছাড়া সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে নিয়মিত কথা বলতাম। প্রতিটি বিদেশ সফরে সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিদের নিয়ে গিয়েছি। ফেরার পথে বিমানে বা নামার পর সাংবাদিক বৈঠক করেছি।”
প্রসঙ্গত, কেন্দ্রে প্রথম ইউপিএ জমানায় এক সময়ে মিডিয়াতেই প্রচার হতো ‘সিং ইজ কিং’ বলে। বিশেষ করে প্রকাশ কারাটের উদ্দেশে মনমোহনের ওই জবাবের পর মিডিয়া সে ভাবেই মনমোহনের প্রশংসা করেছিল। কিন্তু মনমোহনের দ্বিতীয় মেয়াদে বদলে যায় ছবিটা। মনমোহনের বিরুদ্ধে নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ বাহিনীর তখন অন্যতম প্রচারই ছিল যে প্রধানমন্ত্রী মৌন। এমনকী মনমোহনকে কটাক্ষ করে ‘মৌন মোহন’ বলে মন্তব্য করতেও ছাড়েননি বিজেপি নেতারা। মঙ্গলবার মনমোহন তারই জবাব দিয়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে। এও মনে করা হচ্ছে যে মোদীকে সূক্ষ খোঁচাও দিয়েছেন।
কারণ, গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন মোদী কখনও সাংবাদিক সম্মেলনে প্রশ্নের মুখোমুখি হননি। প্রধানমন্ত্রী হিসাবে গত চার বছরে একটি সাংবাদিক সম্মেলনও করেননি নরেন্দ্র মোদী। সংবাদমাধ্যমে তাঁর যে সব সাক্ষাৎকার প্রকাশ হয়েছে বা সম্প্রচারিত হয়েছে, তাও সাজানো বলে সমালোচনা হয়েছে মিডিয়াতেও। সম্ভবত সেই বিষয়টিকেই এ দিন চোখে আঙুল দিয়ে দেশের মানুষকে দেখাতে চেয়াছেন মনমোহন সিংহ। এ ব্যাপারে মনমোহন এ দিন স্মৃতি হাতড়ে তুলে আনেন আরও কিছু কথা। বলেন, মনে পড়ে ২০০৫ সালে ওয়াশিংটনে ন্যাশনাল প্রেস ক্লাবে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের অনেক আমলাই তখন নার্ভাস হয়ে পড়েছিলেন। তাঁরা ভেবেছিলেন, আমি হয়তো সামলাতে পারব না। কিন্তু ওটা অত্যন্ত সফল একটি সাংবাদিক বৈঠক ছিল। এর থেকেই বোঝা যাবে কতটা পারদর্শিতার সঙ্গে সংবাদমাধ্যমের সাংবাদিকদের মুখোমুখি হতাম।
তাঁর জীবন কতটা রোমাঞ্চ এবং অভিজ্ঞতায় ভরপুর এ দিন সে কথা বলেন মনমোহন। কিছুটা আবেগঘন হয়ে এও বলেন, দেশ আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে। সেই ঋণ কখনও শোধ করতে পারব না।
অর্থনীতি প্রসঙ্গে মনমোহন এ দিন বলেন, গত আড়াই দশকে এ দেশে সরকার অনেক বার বদলেছে ঠিকই। কিন্তু অর্থনীতির মৌলিক দর্শন বদলায়নি। ভারত মুষ্টিমেয় কয়েকটি রাষ্ট্রের মধ্যে একটি, যেখানে গত ২৫ বছরে গড়ে ৬.৭ থেকে ৭ শতাংশ বৃদ্ধি হয়েছে। এবং আমার মনে কোনও সংশয় নেই যে অর্থনীতির হাল শীঘ্র শুধরে যাবে। বিশ্বে অন্যতম শক্তিধর রাষ্ট্র হিসাবে ভারতের উত্থান এখন সময়ের অপেক্ষা। মধ্যপ্রদেশ, ছত্তীসগড়, রাজস্থানে কৃষি ঋণ নিয়ে মকুবের সিদ্ধান্ত নিয়ে এ দিন প্রশ্ন করা হয়েছিল মনমোহনকে। জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, এই সিদ্ধান্ত অর্থনৈতিক ভাবে কতটা তর্ক সঙ্গত? জবাবে প্রাক্তন
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “কৃষি ঋণ মকুবের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল ভোট ইস্তাহারে। তা পালনের দায়বদ্ধতা রয়েছে। এর প্রভাব কী পড়বে তা এখনও বিশ্লেষণ করে দেখিনি। কিন্তু প্রতিশ্রুতি যখন দেওয়া হয়েছিল, তখন তার মর্যাদা রক্ষা করাটাই দস্তুর।”
Be the first to comment