তপন মল্লিক চৌধুরী :
একই সঙ্গে বাংলা বেসিক ও সিনেমার গান, হিন্দি ছবির জন্য সুরারোপ এমনকী দক্ষিণ ভারতের আঞ্চলিক সিনেমার সংগীত পরিচালক হিসেবেও খ্যাতি লাভ—সলিল চৌধুরী ছাড়া দ্বিতীয় কেউ নেই। না বললে ভুল হবে তাঁর লেখা গল্প এবং চিত্রনাট্যতেও তৈরি হয়েছে বিখ্যাত ছবি। এ ছাড়া উল্লেখ করতে হয় তাঁর কবিতার বিশেষ করে ‘শপথ’। বহু প্রতিভার বিচ্ছুরণ ঘটেছিল সলিল চৌধুরীর। কলের গানের চোঙায় কান পেতে দেশি-বিদেশি নানান সুর শুনেছিলেন ছেলেবেলায়। জ্যাঠতুতো ভাই-এর অক্রেস্টয় পিয়ানো-এসরাজ-বেহলা শিক্ষা, বিক্ষিপ্তভাবে তবলা ও বাঁশির তালিম—এভাবেই সংগীতের সঙ্গে নিবিড় আত্মীয়তা কৈশোর অবস্থাতেই, পরিণত হয়েছে কোদালিয়া গ্রামের পাঁচালি-যাত্রা-আখড়াই-ঢপ্-এর মতো আরও বহু লোকসুরে। এরপর সাধনা বসুর নাচের সঙ্গে বা তিমিরবরণের দলে দু-একবার বাঁশি বাজানোর সুযোগ থেকেই গান বাধার প্রেরণা। তাতে ইন্ধন জুগিয়েছে সময়, পারিপার্শ্বিকতা, সমাজ-অর্থ-রাজনীতির দায়বোধ।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে ১৯৪৯-এ নিজের কথা ও সুরে ‘গাঁয়ের বধু’ বাংলা সংগীতের মাইলফলক। এই বছরই সিনেমা সংগীতের সঙ্গে যোগসূত্র ‘পরিবর্তন’ ছবির সংগীত পরিচালনা সূত্রে। পরের বছর ‘বরযাত্রী’ এবং তার পরের বছর ‘পাশের বাড়ি’ ছবিতে তাঁর কথা ও সুরে ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য-র গাওয়া ‘ঝিরঝির ঝির বরষায়’, ‘রূপসায়রের বুকে’, ‘নয়নে তারই ভোমরা’ বিপুল জনপ্রিয়াত লাভ করে। ১৯৫৩-তে সলিল চৌধুরী মুম্বাই যান, উদ্দেশ্য কিন্তু গোড়াতে সংগীতে পরিচালনা ছিল না। বিমল রায়ের ডাকে সপরিবারে হাজির হয়ে প্রথমে ‘দো বিঘা জমিন’-এর চিত্রনাট্য রচনা করেন। কিন্তু চিত্রনাট্যকার এবং সংগীত পরিচালক একই ব্যক্তি এমন দুর্লভ দৃষ্টান্ত তিনিই স্থাপন করেন। নিজের লেখা গল্প থেকে চিত্রনাট্যকার হিসেবে সলিল চৌধুরী পেয়েছিলেন লন্ডনের এশিয়াটিক ফিল্ম সোসাইটির পুরস্কার। মুম্বাইয়ের বিনোদন ছবির দুনিয়ায় এমনকী ভারতীয় ছবির ক্ষেত্রেও ‘দো বিঘা জমিন’ ল্যান্ডমার্ক হয়ে আছে। লতা মঙ্গেশকর ও মান্না দে-র কণ্ঠে ‘মৌসন ভি তাজবহ্যায়’, ‘ধরতী কহে পুকারকে’ ‘আজা রে নিন্দিয়া তু’ গানের সূত্র ধরেই সলিল চৌধুরী মুম্বাইতে তাঁর আসন পাকা করে ফেলেন। হিন্দি ছবির দুনিয়ায় সলিল চৌধুরীর ওজন বোঝা যায় তাঁর তৈরি ‘বোম্বে ইউথ কয়্যার’-এ অনিল বিশ্বাস, নৌশাদ, রোশন থেকে শুরু করে লতা-মুকেশ-মান্না প্রমুখের যোগদানে।
স্বর্ণালি সৃজনের সিংহভাগ সময় মুম্বাই কাটালেও ওই সময়ে বাংলা বেসিক গানে হেমন্ত-সন্ধ্যা-লতা থেকে শুরু করে মুকেশ-সুবীর সেন-মাধুরী চট্টোপাধ্যায় প্রমুখর কণ্ঠে সোনাল ফসল যেমন ফলিয়েছিলেন, ‘আজ সন্ধ্যায়’, ‘রাতভোর’, ‘বিরাজ বৌ’, ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’, ‘অয়নান্ত’, ‘রায়বাহাদুর’, ‘কিনু গোয়ালার গলি’ প্রভৃতি ছবিতে সংগীত পরিচালক হিসেবে দৃষ্টান্ত রেখেছিলেন। এরপর আরও উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন ‘লালপাথর’, ‘গাড়ি’, ‘গঙ্গা’ প্রভৃতি ছবির গানে। ‘রানার’, ‘পাল্কির গান’ ছাড়াও বিভিন্ন শিল্পীর কণ্ঠে বেসিক গান তাঁর কথা ও সুরের জাদুতে যেমন জনপ্রিয় ও জনপ্রিয় হয়েছে পাশাপাশি উল্লেখ করতে হয় উনষট্টি থেকে সাতাত্তর সাল পর্যন্ত লতা-সলিল দৃষ্টিতে যে বাইশটি গান জন্ম নিয়েছিল তা একেকটি হীরক খণ্ড। বাংলা ছবির ক্ষেত্রে কথা ও সুর রচনা ছাড়াও আবহ সংগীতেও নিজস্বতার স্পষ্ট ছাপ রেখেছিলেন সলিল চৌধুরী কিন্তু ছবির সংখ্যা তুলনায় কম।
‘মুসাফির’ ছবিতে সলিল চৌধুরী লতার সঙ্গে ডুয়েট গাইয়েছিলেন দিলীপকুমারকে দিয়ে ‘লাগি নহি ছুটে রাম চাহে জিয়া যায়’, বিমল রায়ের ‘মধুমতী’ ছবির গানের কথা বিশেষ ভাবেই উল্লেখযোগ্য—‘আজারে পরদেশি’, ‘সুহানা সফর’, ‘খড়ি খড়ি মেরা দিল’, ‘দিল তরপ তরপ’। এরপর বলতেই হয় ‘পরখ’ ছবির ‘সজনা বরখা বাহার’ (লতা)। ‘ছায়া’ ছবির তালাত-লতা ডুয়েট ‘ইতনা না মুঝসে তু’, কাবুলিওয়ালা ছবিতে মান্না দে-র কণ্ঠে ‘অ্যায় মেরে প্যারে বতন’, ‘মায়া’ ছবির রফি-লতা ডুয়েট ‘তসবির তেরে দিলমে’, ‘যারে উড় যা রে পঞ্ছী (লতা), ‘অ্যায় দিল কাঁহা তেরি মঞ্জিল’ (দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়), ‘আনন্দ’ ছবিতে মান্না দে-র কণ্ঠে ‘জিন্দেগি অ্যাইসি হ্যায় পহেলি’, লতার কণ্ঠে ‘না জিয়া লাগে না’, মুকেশের কণ্ঠে ‘ম্যায়নে তেরে লিয়ে’, ‘কহি দূর যব দিন’, ‘মেরে আপন’ ছবিতে কিশোরকুমারের কণ্ঠে ‘কোই হোতা জিসকো আপনা’—সলিল চৌধুরীর সুরে এমন চিত্রগীতির সংখ্যা আরও আছে। আছে প্রায় ২৬টি মালায়লাম ছবিতে সুর করা গান। উল্লেখ করতে হয় ‘চেস্মিন’ ছবির একটি গান যা ‘চাগড়া’ উৎসবে থিম সং হয়ে গিয়েছে। বেসিক সং কিংবা সিনেমার গান—কথা ও সুরের এমন মেলবন্ধন, সংগীতায়োজনে এমন অভিনবত্ব, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সুরের প্রয়োগ সব মিলিয়েই ভারতীয় জনপ্রিয় সংগীত ধারায় নতুন ধারা ও দিকচিহ্ন সৃষ্টি করেছিলেন সলিল।
সম্পূর্ণ বেআইনি সংগঠনের গণনাট্যকর্মী হিসেবে অনেকটা গেরিলা কায়দায় দুটি নাটক অভিনীত হত ১৯৪৮ সালে ‘সংকেত’ ও ‘জনান্তিকে’। এতে অভিনয় করতে কালী বন্দ্যোপাধ্যায়, করুণা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ। এই দুটি নাটক লিখেছিলেন সলিল চৌধুরী। তাঁরই লেখা ও সুরে সুচিত্রা মিত্র পেয়েছিলেন হয়তো তাকে দেখিনি কেউ/কিংবা দেখেছিলে/ ছিন্নশত আঁচল ঢেকে শীর্ণ দেহখানি/… (সেই মেয়ে) মান্না দে গেয়েছিলেন জন্মভূমির গান—‘ধন্য আমি জন্মেছি মা’। এরপর ‘শান্তির গান’, ‘আমাদের নানান মতে নানান দলে দলাদলি’। সুকান্ত ভট্টাচার্যর অবাক পৃথিবীতে সলিল চৌধুরীর সুরারোপ, দেবব্রত বিশ্বাসের কণ্ঠে আমার প্রতিবাদের ভাষা/ আমার প্রতিরোধের আগুন’, ‘হেই সামালো ধান’, কাস্তের গান, মাঝির গান, জেলেদের গান এণন আরও বহু গানেই বঞ্চনা, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আর প্রতিরোধের আগুন জ্বালিয়েছিলেন সলিল চৌধুরী। সেগুলি কেবল যে জনসমাবেশে গণচেতনা জাগানোর গান নয় তা বলাবাহুল্য। সে সব গানে ও তিনি কথা ও সুরের অভিনবত্ব রচনা করেছিলেন। গণসংগীত হিসেবেও কালজয়ী।
তবে গীতিকার-সুরকার সলিল চৌধুরীর আড়ালে এখনও ঢাকা পড়ে আছে তার গদ্য রচনা। যেমন গল্প পাশাপাশি কবিতাও। মেহমুদ আর মীনাকুমারী অভিনীত সলিল চৌধুরীর পরিচালনায় ‘পিঞ্জরে কে পঞ্ছি’ ছবিটির কথাও তো অধিকাংশ মানুষ জানেন না।
Be the first to comment