আকাশ কাঁপিয়ে তীব্র গতিতে ছুটে যাবে উল্কাপিন্ড। আলোর ঝর্ণায় ভরবে আকাশ। শোনা যেতে পারে কান ফাটানো বিকট শব্দ। ১১০ বছর আগের সাইবেরিয়ার তুঙ্গুস্কার স্মৃতি ফিরিয়ে ফের কি কোনও মহাজাগতিক চমকের সাক্ষী হতে চলেছে বিশ্ববাসী? সেই সম্ভাবনার কথাই বলছেন বিজ্ঞানীরা।
আমেরিকার লস অ্যালামস ন্যাশনাল ল্যাবরেটরির পদার্থবিজ্ঞানী মার্ক বসলাফ ও অন্টারিওর ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটি অফ লন্ডনের পদার্থবিদ পিটার ব্রাউন তাঁদের গবেষণায় বলেছেন, ২০১৯ সালের জুন মাসেই বিকট মহাজাগতিক বস্তুর বিস্ফোরণ ও সেই সঙ্গে ভয়ঙ্কর উল্কাবৃষ্টি দেখবে বিশ্ববাসী। ঠিক যেমনটা হয়েছিল ১১০ বছর আগে সাইবেরিয়ার তুঙ্গুস্কায়। আমেরিকান জিওফিজিক্যাল ইউনিয়নের বৈঠকে এই গবেষণার কথা পেশ করেন বসলাফ ও পিটার ব্রাউন।
গবেষণায় তাঁরা বলেছেন, সম্ভাবনা রয়েছে আগামী জুনেই বিশাল কোনও অ্যাস্টারয়েড (Asteroid) বা গ্রহাণু পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ঢুকে পরবে। পৃথিবীর জোরাল ‘মায়ার টানে’ (অভিকর্ষ বল) জড়িয়ে পড়ে ধূমকেতুর নিউক্লিয়াস থেকে ছিঁড়ে-ছিটকে বেরিয়ে আসতে থাকবে খন্ডগুলো। সেগুলো শনশন করে ছুটে আসবে পৃথিবীর দিকে। ঘণ্টায় প্রায় ১ লক্ষ ৩২ হাজার মাইল গতিবেগে। তবে পৃথিবীর রক্ষাকবচ তার বায়ুমণ্ডলের চাদর। ফলে ধূমকেতুর নিউক্লিয়াসের খণ্ড-বিখণ্ডগুলোর সঙ্গে বায়ুমণ্ডলের কণাগুলোর সজোরে ধাক্কায় হবে বিকট বিস্ফোরণ। জ্বলে উঠবে আগুন। গরম হয়ে উঠবে আশপাশের এলাকা। সেই আগুনই ছিটকে ফুলঝুরির মতো ছড়িয়ে পড়বে গোটা আকাশে।
বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, পৃথিবীতে ফি বছরই উল্কাপাত হয়। প্রায় ১৫০০ মেট্রিক টন উল্কাপিন্ড প্রতিবছর পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে প্রবেশ করে। ভূপৃষ্ঠ থেকে ৬৫ কিমি-১১৫ কিমি এর মধ্যে এই খণ্ডগুলো দৃষ্টিগোচর হয়। ঝাঁকে ঝাঁকে, দলে দলে উল্কা যখন পৃথিবীর দিকে ছুতে আসে তখন তাকে উল্কাবৃষ্টি বা উল্কাঝড় বলে। দেখে মনে হয় প্রকৃতি যেন আলোর উৎসবে মেতেছে। উল্কাপাতের ঘটনাকে বলা হয় “ইটা আ্যকুয়ারাইডস”। বছরে দু’বার এই ধরনের উল্কাঝড় বা ‘টরিড’ দেখা যায়। এপ্রিলের শেষ সপ্তাহ থেকে মে মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত, আবার অক্টোবরের শেষ থেকে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত। মেঘহীন রাতের আকাশেই এই উল্কাবৃষ্টি সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে। বিষুবরেখার কাছাকাছি এলাকার লোকজন সূর্যোদয়ের তিন ঘণ্টা আগেই দেখতে পায় এই উল্কাবৃষ্টি।
পৃথিবীতে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর উল্কাবৃষ্টি হয়েছিল আজ থেকে ১১০ বছর আগে ১৯০৮-এর ৩০ জুন। সাইবেরিয়ার তুঙ্গুস্কার আকাশে আচমকাই কোনও মহাজাগতিক বস্তর বিকট বিস্ফোরণে কেঁপে উঠেছিল বিস্তীর্ণ এলাকা১৯০৮-এর ৩০ জুন। পূর্ব সাইবেরিয়ার প্রায় ২,০০০ বর্গ কিলোমিটার (৭৭০ বর্গ মাইল)এলাকা ছাড়খাড় হয়ে গিয়েছিল সেই বিস্ফোরণের ঝলকানিতে ১৯০৮-এর ৩০ জুন। হতাহতের কোনও ঘটনা না ঘটলেও সেই উল্কাপাতকে পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ঙ্করতম উল্কাপাত হিসেবে বর্ণনা করেন বিজ্ঞানীরা। মনে করা হয়, ৬০-১৯০ মিটার (২০০-৬২০ ফিট) দৈর্ঘ্যের কোনও গ্রহাণুর সঙ্গে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের সংঘর্ষেই ওই বিস্ফোরণ ঘটেছিল। বিস্ফোরণের তীব্রতা ছিল প্রায় ১০-৩০ মেগাটন টিএনটি (বিস্ফোরক ট্রাইনাইট্রোটলুইন) বিস্ফোরণের সমান। বিশাল এই উল্কাপাতকে তাই ‘বিটা টরিড’ বলা হয়।
বিজ্ঞানী বসলাফের মতে, তুঙ্গুস্কার বিটা টরিডের মতো ঘটনা ঘটবে কি না সেই ব্যাপারে এখনও পর্যাপ্ত তথ্য না পেলেও মনে করা হচ্ছে, পৃথিবীর কাছাকাছি কোনও মহাজাগতিক বস্তুর সঙ্গে (NEO-near earth object) বায়ুমণ্ডলের সংঘর্ষ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। নাসার জেট পপুলেশন ল্যাবরেটরির মহাকাশবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক অ্যামি মেইনজার ও তাঁর সতীর্থরা গবেষণায় বলেছেন, ইনফ্র্যারেড টেলিস্কোপে ধরা পড়েছে পৃথিবীর কাছাকাছি এমন হাজারো মহাজাগতিক বস্তু রয়েছে যাদের ৯০ শতাংশই বিকট বিস্ফোরণ ঘটাতে সক্ষম। এই বস্তুগুলোর ৩০ শতাংশেরই দৈর্ঘ্যে ১৪০ মিটারের (৪৬০ ফিট) কাছাকাছি। সুতরাং, ১১০ বছর তুঙ্গুস্কায় উল্কাপাতের মতো ফের বড়সড় কোনও ঘটনা অপেক্ষা করে রয়েছে কি না সেটাই বা কে বলতে পারে!
Be the first to comment