ক্রিং, ক্রিং, ক্রিং,,, এতো
সকালে কে হতে পারে .. বিরক্তি ভরা চোখে ফোন টার দিকে তাকিয়ে তুলবেনা ভেবেও অন্যমনস্ক ভাবে তুলেই তৃপ্তি শুনতে পেল “হ্যালো —-
কি ম্যাডাম চিনতে পারছো ?”
“—-অনি, তুমি
এতো সকালে? তুমি ভালো আছো তো? কি হয়েছে এক্ষুনি বলো ?”
“—-ধীরে
বন্ধু ধীরে —-
আমি মানুষ মেশিন না , চিন্তা করোনা আমি একদম ফিট … এখন আমার প্রশ্নের উত্তর দাও বলোতো আমি কোথায়” ?
তৃপ্তি হেসে ফেলল, “কি যে বলো তার ঠিক নেই ,,,,এতো সকালে কোথায় আর থাকবে, ঘরেই আছো , চা খেয়েছো কি”?
“–ভুল বললে ম্যাডাম, আমি তোমার পাশে —দেখতে পাচ্ছো কি ” ?
“– খুব দেখতে পাচ্ছি, আর বুঝতে পারছি কাল কিছু খেয়েছিলে, তার জের চলছে .. আমার স্কুলের দেরি হচ্ছে, পরে কথা হবে কেমন”……।
“–উঁহু উঁহু এখন ফোন রাখলে ভুল করবে কিন্তু “…..।
“–অনি কেন বলতো সকালে বিরক্ত — আমার কিন্তু দেরি হচ্ছে….”।
“—প্রীতি, তুমি কিন্তু বলতেই পারলে না আমি কোথায় ?”
“—আমি এখন ট্রেনে,. আর কিছুক্ষণের মধ্যে দিল্লি…….”
—“কেন মজা করছো অনি ” ?”
—“এতো কথা বললে তুমি কিন্তু সময়ের কাছে হেরে যাবে, প্লাটফর্মে নেমে যদি তোমাকে না পাই তাহলে পাখি ফুরু্রর্ “ ।
–“সে কি তার মানে
—–?“
–“কথা না বলে দৌড়তে শুরু করো “….।
–“আমার কিন্তু খুব রাগ হচ্ছে অনি “….।
“–আমার বাঁধ ভাঙা আদরে তোমার রাগ থই পেলেতো, কিন্তু আর কথা না “….।.
অবাক হয়ে ঘুমিয়ে পড়া ক্লান্ত ফোন টার দিকে তাকিয়ে তৃপ্তিও বিছানায় এলিয়ে পড়ল , ভাবতে পারছে না যা শুনল তা কি সত্যি না তার উবর্র মস্তিষ্কের ফসল , সত্যি কি অনি আসছে –?
অনিকেত মজুমদার — ছোট্ট একটা পরিচয় তাও ফেসবুকের পাতায় কিন্তু দিনে দিনে তার রঙের প্রাচুর্যে আমাদের দুজনেরই মন ভরে উঠেছে। আমার জীবনের নিবিড় শূন্যতাকে অনি ভরে দিয়েছে আলোর প্রাচুর্যে, অনিকে ছাড়া নিজেকে চিন্তাই করতে পারিনা ,,,।
আজ প্রায় বছর হয়ে এলো ,,, কি ভাবে যে কি হয়ে গেল ,,, অনির ভালবাসার কাছে হারিয়ে গেলাম
—–।
নিজেকে ধরে রাখতে পারলামনা ভেসে গেলাম
…..।
ডেকেছিলাম তো আমি কিন্তু সা রে গা মার সপ্তম সুর বেজে উঠেছিল দুজনের মনে একসাথে, ভুল অনির ভালোবাসা অনেক বড় ..।
অনি ভীষণ একলা ,,, বিবাহিত জীবনে সুখী হতে পারেনি, অত্যন্ত জেদি আর অহংকারী ছিল ওর বৌ —তাই ওদের দুজনের জীবনের ছন্দ আলাদা। —ও রে বাবা দেরি হয়ে গেল যে, কি যে খালি পুরনো দিনে হারিয়ে যাই— সামনে খুশির জোয়ার আর আমি কিনা
….. সত্যি
আমি বোকা ।
‘না বাবা, আর দেরি না, বলা যায়না, যা খেয়ালি মানুষ
‘—–।
আলমারি টা খুলে তূপ্তি ভাবছে কি পরা যায় । একটা হালকা আকাশি রঙের শাড়ি বার করল, শাড়ি পড়তে গিয়ে হঠাৎ হেসে ফেলল জীবনের মাঝবয়সে এসে এ কি ছেলেমানুষি হয়ে গেল …..।
আয়নার সামনে হালকা মেকআপের জন্য দাঁড়িয়ে তৃপ্তি অবাক হয়ে গেল নিজেকে দেখে !! সত্যি অনেকদিন নিজেকে দেখেনি , সময় কখন তার শরীরের ওপর নিজের হাত বুলিয়ে চলে গেছে সে বুঝতেই পারেনি ,, সময়ের সাথে পাখা মিলিয়ে কতো ঝড়ও বয়ে গেছে হিসেব তো সে কিছুরই রাখেনি , শুধু লড়াই করে গেছে একটু ভালোভাবে বাঁচার চেষ্টাতে দুর্গম মরুভূমির তপ্ত বালিতে একলাই হেঁটেছে , হিসেব রাখেনি কোনও ক্ষতের ….! বন্ধু বিহীন জীবনের বন্ধুর পথে একলাই হেঁটে চলেছে।
প্রীয়ো, প্রীয়োতোষ ব্যানার্জী, যে একদিন অঙ্গীকার করেছিল আমার সুখ দুখের সাথী হবে , সে তো নিয়তির ডাকে নিজের অঙ্গীকার ভুলে আমাকে জীবনের অন্ধকার পথে ছেড়ে চলে গেল– । অবশ্য ভাববার সময় ও সে পায়নি …। সময় তো থেমে থাকেনি, সে তো নিজের খেয়ালে বেড়েই চলে, কখনো ফিরেও তো দেখেনা ,, কারও সুখ দুখের সঙ্গীও তো হয়না !!
ছেলে মেয়েরাও ধীরে ধীরে বড় হয়ে নিজেদের পথে চলতে শুরু করল। শেষে এমন একদিন এলো যেদিন তারা আমাকে ছাড়াই চলতে শুরু করল এবং তারা এতদু-উ-র চলে গেল যে আমি আর তাদের দেখতে পাইনা ,, কি জানি কিসের অভাব ….
ভালোবাসার, না বয়েসের ভারে আমার এই চোখ দুটোর দৃষ্টির অভাব ??
শুধু নিঃস্ব ক্লান্ত সৈনিকের মতন হেরে যখন পড়ে গিয়েছিলাম, তখনই অনি দু হাত দিয়ে তুলে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরেছিল, সাহস দিয়েছিল, বলেছিল আজ থেকে তুমি আর একলা নও আমি পাশে আছি চিরদিন থাকব ..। .সেই প্রথম দিন থেকেই আমাকে প্রীতি বলে ডাকে, আমি মনে করি অনির ভালোবাসা আমার কাছে ঈশ্বরের দান…।
–আজ কত দিন হয়ে গেল এতো দুরে খেকেও ঠিক ছায়ার মতন অনি আছে আমার সাথে …।
—- উফ
আবার পেছনে চলে যাচ্ছি, আজ একটা ঝামেলা হবেই আমার, এই পাগলের মতন ভাবনার পেছনে না নিজেকে হারালে চলবেনা । অনি অপেক্ষা করছে,, মানুষ টার সাথে যতো কথা বলি ততোই আমি অবাক হয়ে যাই, কি ভালো সরল একটা মানুষ, অথচ কতো নিঃসঙ্গ ..।
নিজের যন্ত্রণাকে লুকিয়ে রাখার কি ভয়ানক চেষ্টা, যদি কখনও ব্যথাতে লাগে কি সংযমের সাথে নিজেকে গুটিয়ে নেয়, কিছুই প্রকাশ করেনা, হাসি গান দিয়ে সব কিছু সুন্দর ভাবে ঢেকে রাখে।
তৃপ্তি ভাবতেই পারছেনা ফেসবুক দুরের বন্ধুকে এতো কাছে আনতে পারে —কি জানি বাবা চিনতে পারবতো আমি যা বোকা !!
যদি চিনতে না পারি অনি ঠাট্টা করে ওকে পাগল করে দেবে ,, তা দিক ওর ঠাট্টও তো পাগল করা ভালোবাসা.. ও শুধুই ভালোবাসতে জানে তার বিনিময়ে অবশ্য ও শুধু আঘাত পায় সকলের থেকে ।
দিল্লির রাস্তার যা অবস্থা ঠিক সময়ে পৌঁছতে পারলে হয় ,, অটোতে বসে তৃপ্তির বেশ ভয় করতে লাগল, আবার আনন্দ ও হচ্ছে কেমন যেন এক অচেনা আনন্দ, কোন একটা অজানা সুর রিনরিন করে বেজে চলেছে মনকে মাতাল করে শরীরের সমস্ত গ্রন্থি যেন এক সুরে প্রশ্ন করছে , “কি গো কথা বলতে পারবেতো ? যে ছিলো অনেক দুরে– স্বপ্নের মধ্যে আসতো সে আজ তোমার সামনে আসছে !”
যে ছিল আমার স্বপন চারিণী
,,,,, তৃপ্তি
মনের উচ্ছ্বাস কে চাপা দিতে গুনগুনিয়ে উঠল ।
— কিন্তু অনির জন্য কিছু ব্যবস্থা তো করলামনা ,, ভেবে পারছিনা কোন দিকে যাব — এতো কম সময় যাই হোক আগে স্টেশনে তো যাই আগে অনিকে দেখি …. ওকে পাব আমার সামনে এইটাইতো আমার সবথেকে বড় পাওনা ….।
–ও রে বাব্বা স্কুলে তো ফোন করা হয়নি !!!
তাড়াতাড়ি স্কুলে ফোন করে কৃষ্ণা ম্যাম কে জানিয়ে দিলাম যে আসছিনা, আজ .. শরীর খারাপ ।
–“কিধার জানা হ্যায় ম্যাডাম?”
“–ন্যু দিল্লি স্টেশন, থোড়া তেজ চলনা ভাইয়া”
গাড়ির সাথে তৃপ্তির লাগাম ছাড়া মন আবার ছুটে চলেছে সেই পুরনো দিনের পথে …….অনির কথা অনির হো হো করে মন মাতান হাসির কথা , নানা বিষয়ে অনির আলোচনা তার সাথে অনির গান , সব ফ্ল্যাশ ব্যাকের মতন একের পর এক চোখের সামনে ছুটে চলেছে .।
কৃষ্ণা ম্যাম কে মিথ্যে বলে খুব বাজে লাগছে, কিন্তু কি আর করা যাবে –অনির জন্য সব করতে পারি ..।
ভাড়া মিটিয়ে একটু দৌড়েই স্টেশনে ঢুকলাম ,, বোর্ডের দিকে দেখে নিশ্চিন্ত হলাম যাক হাওড়া দিল্লি দুরন্ত এখনও ঢোকেনি। হাজার ভীড়ের ভেতরেও অনিকে চিনতে অসুবিধে হবেনা কিন্তু
…..।.
এন্যাউন্সমেন্ট হচ্ছে…. তৃপ্তির বুকের ভেতর এতো জোরে ঢিপ ঢিপ করছে !!
দুমিনিট চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকল নিজেকে শান্ত করে বুক স্টলের পাশে গিয়ে দাঁড়াল, ভীড় এখন বেশ পাতলা ।
ফোন টা নিয়ে নাম্বার ডায়াল করে অতিকষ্টে বলল হ্যালো অনি, আমি,,,,
“তুমি হেরে গেছ প্রীতিইইইই……..”
“অনি” ! অবাক হয়ে ঘুরে দেখে তার স্বপ্ন আজ বাস্তবের রূপ নিয়ে তার সামনে , ঠিক যেমনটি তার চোখের সামনে রোজ অনি থাকে ।
অনি তার দিকে তাকিয়ে মিটি মিটি হাসছে ,,,।
তৃপ্তি ভেবে পাচ্ছেনা কি বলবে ,,,সমস্ত ভাষা যেন হারিয়ে যাচ্ছে।
“কি ব্যাপার কথা বলবে না, ও বুঝেছি রাগ,, তা এই খানেই কি রাগ ভাঙ্গাব”?
“আঃ কি হচ্ছে ! আমিতো কখন এসেছি তুমিই তো দেরি করলে আবার ভুতের মতন পেছনে লুকিয়ে থাকলে”।
“এ্যা..ই..ই আমি ভুত, মজা দেখাব” ?
“আ অনি কি ছেলেমানুষি হচ্ছে , তুমি এখন আমার কাছে এসেছ আমি যা বলব তাই শুনবে”..।
“ঠিক আছে দিদিমনি, চল আপাতত একটা ট্যাক্সি ডাকি তারপর ট্যাক্সিতে বসে তোমার কথা শুনব “।
দুজনে প্লাটফর্ম থেকে বেরিয়ে এসে ট্যাক্সিতে উঠে অনিকেত হোটেলের ঠিকানা বলতেই তৃপ্তি অবাক হয়ে বলল ,” তুমি হোটেলে উঠবে !”
“হ্যাঁ তাহলে আমরা দুজনে দুজনের কাছে টাইম দিতে পারব । আমরা অনেক ঘুরব , অনেক কথা আছে বলবার ও শোনবার”।
“কিন্তু অনি আমি যে”—
অনিকেত তৃপ্তির ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে খুব ফিসফিস করে বলল , “একদম চুপ এই দুটো দিন শুধুই আমার”।
“ঠিক আছে চুপ করলাম”।
ট্যাক্সি ও হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল। ভাড়া মিটিয়ে ওরা নেমে পড়ল …।
“তোমার রুম বুক আছে” ?
“হ্যাঁ দুদিনের জন্য”।..
কাউন্টারের ফর্মালিটি পুরো করে ওরা রুমে এলো ।
“বা সুন্দর রুমটা তো” !
“হুঁ, শুধু তোমার কথা মনে করেই এই রুম নিয়েছি। তুমি রাস্তা দেখতে ভালোবাস, বাস্তবে তো তোমাকে কোনোদিন এমন একটা জায়গা দিতে পারবনা তাই ক্ষণিকের চেষ্টা । দাঁড়াও আগে ব্রেকফাস্ট অর্ডার করি , “বল তুমি কি খাবে” ?
“যা ইচ্ছে,, খাবার নিয়ে আমার কোনও মতামত নেই , তুমি যা খাবে তাই খাব , অর্ডার করে তুমি কিন্তু ফ্রেশ হয়ে নাও সারারাত জার্নি করে এসেছ” ।
“তাহলে তুমি অর্ডার করো আমি যাই “।
অর্ডার করে তৃপ্তি জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াল ,, সামনেই দিল্লির ব্যাস্ত রাজপথে দুর্দম গতিতে গাড়ি গুলো ছুটে চলেছে। কোনোদিকেই ওদের দেখবার সময় নেই। অবশ্য গতির একটা আনন্দ আছে। প্রীয়োর সঙ্গে যেমন ছুটতাম। কি সুন্দর ছিল সেই দিনগুলো , মাথায় ভুত চাপলেই প্রীয়ো বেড়িয়ে পড়তো। কতো দুর চলে যেতাম। কোথায় হারাল, কেন হারাল সেই দিনগুলো, কেন আমি একলা হলাম ??? কখনোই কোনও উত্তর আমি পাইনি ,,,জানি পাবোও না কোনোদিন ….।
ভেতরের কষ্ট আবার ওর চোখ জলে ভর্তি করে দিল, একটা মানুষের চোখে কতো জল থাকতে পারে , সবসময় তো বার হচ্ছে, শেষ তো আর হয়না .।
“–প্রীতি আবার তুমি কাঁদছো? আজ আমরা প্রথম মিলেছি, এই দিনটাও কি তুমি কাঁদবে? আমি কি তোমায় ভালোবাসতে পারিনি ?”
তৃপ্তি নিজেকে আর সামলাতে পারলোনা হারিয়ে গেলো অনির বুকে \ “—প্লীজ্ অনি এমন বলনা। তোমার ভালোবাসাতেই আমি দাঁড়িয়ে আছি …।“
অনি আদর করে ওর চোখের জল মুছিয়ে দিল । “– কেঁদনা প্রীতি, আমি আছি, তুমিতো একলা নও ,, আর কোনওদিন তুমি একলা হবেনা`.. ।“
—প্রীতি বাঁচতে শেখো , দুর্বল কে এই দুনিয়া জায়গা দেয়না, তুমি বাঁচবে তোমার নিজের জন্য , তোমার খুশিতে তুমি হাসবে ,,দুনিয়াকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে বাঁচো, আর এখন আমার জন্য একটু হাসো…”।..
ওর কথার ঢঙে তৃপ্তি হেসে ফেলল অনিকে জড়িয়ে ধরে বলল,
—“চিন্তা করোনা, কথা দিলাম আজ শুধুই হাসব তোমার জন্য। কিন্তু চল খাবার ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে” ।
“–চলো আমার ভীষণ খিদে পেয়েছে,”।
দুজনে খেতে বসে গেল , তৃপ্তি মুখ নিচু করে খাচ্ছে আর মনে ভাবছে —একি সত্যি যা আমার সঙ্গে ঘটে চলেছে আজ সকাল থেকে না, কি সত্যিই আমার মাথাটাই খারাপ হয়েছে !!
“আমাদের তাহলে সত্যি দেখা হল,– কি বল প্রীতি ..?”
“জানো আমি কিন্তু এখনো ঠিক ভাবতেই পারছিনা যে সত্যি তুমি আমার সামনে ….উ ..উ…ফ ধ্যাত এতো জোরে … লাগেনা বুঝি আমার “ ..।
“লেগেছে, তাহলে তো আমি সামনেই আছি” ।
“–বাব্বা , সামনে থাকার এই ব্যাখ্যা ,,, খাওয়া তো হল এখন কি করবে ?,, কোথাও বেরুবে ?”
“–না বলেছিতো আজ শুধু তুমি আর আমি ,,, আমাদের নিজেদের কথা”।
“–সে তো হল, কিন্তু হঠাৎ তুমি কিভাবে বেরিয়ে এলে? তোমার রিটায়ারমেন্টের মাত্র কয়েক মাস বাকি”?
“কি জানি– হঠাৎ তোমার কথা ভীষণ মনে পড়ছিল, তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করছিল, ব্যাস চলে এলাম”।
“—বাজে বকোনা, কলকাতা থেকে হাওয়ায় উড়ে কেউ আসতে পারেনা , একদিন আগে টিকিট কাটতেই হবে আর একদিনের জার্নি, সব ছাড়ো কাল আমাকে জানাওনি কেন ?”
“–জানালে কি আর দিদিমনির এই রূপ দেখতাম,, আসলে আমি চেয়েছিলাম তোমাকে একটা বিরাট সারপ্রাইজ গিফট্ দিতে , কিন্তু কিছুই পছন্দ হলনা তাই নিজেই চলে এলাম”।
“–জীবন যুদ্ধে ক্লান্ত সৈনিকের কোনও চাহিদা থাকেনা , জানতো সে শুধু সূর্যাস্তের অপেক্ষায় থাকে , আর মনের গভীরে কোথাও যদি কোনও অপূর্ণ পাত্র আমার থেকে থাকে তাও আজ পূর্ণ তোমার দানে ”।
“–তোমার কাছ থেকেই আমিও জীবনের রঙ চিনেছি , মাধুর্যতার স্বাদ পেয়েছি, তোমার প্রাণের ছোঁয়ায় আমিও যে চলতে শিখেছি.”।
“–জানো একএক সময় ভাবি কলকাতা-দিল্লি না হয়ে যদি একটু কাছে হতাম”।
“–দূরত্ব কে কখনো কিলোমিটার দিয়ে মাপ করোনা .. আমি তো কখনোই মনে করতে পারিনা তুমি দুরে আছো , সবসময় জানবে মানুষের মনের টান দূরত্বকে হাতের মুঠোয় নিয়ে আসে”।
“তাহলে এখন ওঠো একটু ঘুরে আসি , জানতো আমি কোথাও যেতে পাইনা, কিন্তু আমি ঘুরতে ভীষণ ভালোবাসি ”।
অনিকেত দু হাতের মাঝে তৃপ্তির মুখ টা তুলে খুব আস্তে করে বলল ,”–
আমার এই দুহাতের মাঝে যতটুকু আনন্দ আছে সব তোমার .”।
“–সব আমাদের তাই না” এখন চল তাড়াতাড়ি ।
ওরা তৈরি হয়ে রুম লক করে নিচে নেমে এলো ..।
“–কোথায় যাবে ? –চলো ইন্ডিয়া গেট যাই অনেক বছর আগে এসেছিলাম ..”
“–আমিও বহুদিন যাইনি কিন্তু দেরি করনা ..”
সামনেই অটো পাওয়া গেল , বেশি দুর তো না তাই ওরা জলদি পৌঁছে গেল .
“–কি সুন্দর জায়গা তাই না অনি ,সারাদিন বসে থাকলেও ক্লান্তি আসবে না !!”
“–হুঁ কিন্তু কোথায় বসি –?”
“–একদম না চলো ঘুরি — ওই দেখো আইসক্রিম।”
“–হুঁ তোমার প্রিয় জিনিষ, চলো।”
এই ভাবেই এক সময় ওদের হাসি গল্পের মাঝে দিনের শেষ আলো ক্লান্ত বিহঙ্গের মতন তার পাখা ছড়িয়ে বসে পড়ে তাদের চারপাশে। . আকাশের সমস্ত পাখিরা নিজেদের প্রিয়োজনদের ডেকে নিয়ে ঘরে ফিরছে । পাখিদের কলকাকলিতে ওদেরও মনে হল এইবার ঘরে ফিরতে হবে —।
“– প্রীতি চল কোথাও ডিনার সেরে তোমাকে ছেড়ে আসি”।
“–কিন্তু অনি আমার আর একটু বসতে ইচ্ছে করছে”।
“– না ডিয়ার , সময়ের তারে মানুষের জীবন বাঁধা আছে, তাই সুর আছে। না হলে ছন্দ-হীন হতো যে ”।
“–খুশি টা শুধুই দৌড়ায় আর সুখ টা ভালো করে হাঁটতেই পারেনা কেন বলতো অনি”?
“–দুখ, কষ্ট এরা আছে বলেইতো আমরা আছি , কাঁটা আছে বলেই তো গোলাপের এতো রূপ ”।
ওরা এসে ছোটো একটা হোটেলে ঢুকল ..
খাওয়া সেরে ফেরার পথে হঠাৎ অনিকেত বলে উঠল, “–
যা হারিয়ে গেল .”!
“–কি হারালে ?”
“–তোমার গান”।
–উফ, এমন কথা বল, কাল তুমি আগে শোনাবে , কোনটা জানো —-
“জীবন মরণের সীমানা ছাড়ায়ে,, বন্ধু হে আমার রয়েছো দাঁড়ায়ে “
… জানো অনি এইটা আমার বড় প্রিয় গান
….”।
ঠিক আছে দুজনে দুজনের জন্য গাইব, কাল কিন্তু খুব জলদি বার হতে হবে … অনি ওর হাত দুটো ধরে ছোট্ট চুমু দিয়ে গুনগুনিয়ে উঠল “—
আজ তবে এইটুকু থাক বাকি কথা কাল হবে
….”।.
“–আজ দিনটা কত তাড়াতাড়ি শে.”…… তৃপ্তির গলা ধরে এলো কান্নাতে —।
“—প্রীতি, শেষ বলে কিছু নেই, শেষ থেকেই শুরু হয় সব কিছু .”।
বুঝলাম গুরুমশাই, এখন ঐ দেখো অটো …
“ বা !! বেশতো , এখন নিজেই দৌড়াচ্ছো , রাতের দিল্লি বড়ই মায়াবী,” অটোতে বসে বাইরের দিকে চোখ রোখে অনি বলল।
তৃপ্তি শুধুই দেখছিল , তাই মাথা নেড়ে বলল হুঁ..
“— চুপ
কেন কিছু তো বল …”
অনির হাতটা নিজের দু হাতের মধ্যে ধরে খুব আস্তে করে তৃপ্তি বলল “—
ঘরে গিয়ে বলব …”।
সময়কে কেউ অস্বীকার করতে পারেনা ,,, তাই শুভরাত্রি বলে দুজনে দুজনের রাস্তায় চলে গেল …।
তারপরের দিনটা কিভাবে যে উড়ে গিয়ে দুরন্তের টাইম টাকে কাছে টেনে আনল ওরা কেউ তা বুঝতে পারলনা , শুধুই জানল এইবার যেতে হবে .।
প্লাটফর্মে ঢুকে দুজনেই চুপ, মনের ভাষাকে কথায় প্রকাশ করতে পারছেনা কেউই, শুধু দুজনের হাতের স্পর্শ অনেক না বলতে পারা কথার নীরবে আদান প্রদান করে গেল .।
বেশ কিছুক্ষণের পর অনিকেত বলল, “–
প্রীতি কথা দাও কাঁদবেনা, কখনো মন খারাপ করে থাকবে না, আর তুমি কলকাতা আসবে, আমি তোমার সব ব্যবস্থা করে দেব”।
দুরন্তের এ্যানাউন্সমেন্ট হয়ে গেল .।
“—প্রীতি কিছু তো বল ?”
“–ভাবছি আমার চকলেটটা কোথায় গেল, তোমার পকেটে না দোকানেই পড়ে আছে ..”।
হো হো করে অনি হেসে উঠল,
“—তাইতো পকেটেই পরে আছে, এই নাও”।
“–দাও “।
“–প্রীতি তোমার আমার এই সুন্দর সম্পর্ক যেন সারাজীবন আমাদের দুজনের হৃদয়ে অক্ষত থাকে , কোনও মলিনতা , কোনও গ্লানি , কোনও ক্লান্তি যেন আমাদের এই ভালোবাসার বন্ধনকে ভেঙ্গে টুকরো করতে না পারে ”।
“– অনি তোমার দেওয়া এই চকলেটটার মতোই মিষ্টি আমাদের এই ভালোবাসা ,এর কি শেষ হতে পারে ?”
ট্রেন ঢুকছে , সকলেই ট্রেনে উঠতে ও নিজের প্রিয়োজনদের কাছ থেকে বিদায় নিতে ব্যাস্ত ..।
তৃপ্তি নিজের অজান্তে অনির হাতটা কখন দুহাতে জড়িয়ে ধরেছে বুঝতেই পারেনি , ঘোর কাটল যখন অনি নিজের হাতটা টেনে বলল, “–ম্যাডাম এবার ছাড়ো যেতে হবে তো .”।
“Sorry —“।
অনি ট্রেনে উঠে পড়ল, “–
প্রীতি একটু এসো .”।
কিন্তু প্রীতির যে একটুও নড়বার ক্ষমতা নেই ,, তার দু চোখের এই দুর্বার জলস্ফীতিকে আটকাতে হবেই .।
অনিকেত বুঝতে পারল , ওর নিজের ও ভালো লাগছিলোনা …।
একসময় বিদায়ের বাঁশি বেজেই উঠল , প্রীতির দিকে দেখে অনিকেতের মনটা ব্যথায় অস্থির হয়ে উঠল ।
তৃপ্তিও হাত নেড়ে বিদায় জানাল , ধীরে ধীরে অনির হাতটা মিলিয়ে যেতেই নিজেকে আর সামলাতে পারলনা —নীরব কান্নায় দুহাতে মুখ ঢেকে বসে পড়ল , মনে হল সব হারিয়ে কি অপরিসীম অন্ধকার তাকে গ্রাস করছে ..।
টুং টাং শব্দ শুনে আনমনে ফোনটা তুলতেই অনি বলে উঠল,
“– প্রীতি তুমি আবার কাঁদছ, তুমি তো জানো তোমার কান্না আমি সহ্য করতে পারিনা ।“
“—না অনি, আর কাঁদবনা ,, তুমি সাবধানে যেও ।“
“মনে থাকে যেন —-আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি তোমার কষ্ট আমাকেও যে কষ্ট দেয়, .আমাদের এই ভালোবাসার ছোট্ট তরী টা আমরা দুজনেই বেয়ে যাব . “।
“—হ্যাঁ , তোমার দেওয়া এই অচেনা আনন্দ আমার জীবন খুশিতে ভরে রাখবে .”।
“—তাহলে এখন বাড়ি যাও .. একটু পরেই ফোন করছি আবার …”।
ধীর পায়ে তৃপ্তি ফিরে চলল নিজের শূন্য ঘরের দিকে ….
না শূন্য নয় , অনির ভালোবাসার সাথে আজকের পাওয়া অচেনা আনন্দকে সাথে নিয়ে ..।
Be the first to comment