তপন মল্লিক চৌধুরী,
বিয়ের ২৫ বছর পরেও কোনও সন্তান না হওয়ায় ঘরে বাইরে নানা গঞ্জনা তো ছিলই তারপর একদিন সমাজ তাকে একঘরে করে দিল। সমাজের মাথাদের যুক্তি নারী হয়েও বিয়ের পর এতগুলি বছর পরও যখন গর্ভধারণ করতে না পারল না তার মানে সে সম্পূর্ণ নারী নয়। এমন নারীর সমাজে কি ঠাই হতে পারে? আজও আমাদের সমাজে এমন ধ্যান ধারণা কীভাবে টিকে থাকে সেটা খুবই আশ্চর্যের বিষয়। কিন্তু এমন ধারণা অনেকেরই। অযৌক্তিক চিন্তা ভাবনার উলটো দিকেও তো কেউ কেউ হাঁটেন। কেউ সেই ধ্যান ধারণা পাল্টেও দেন। যেমন দিয়েছেন থিম্মাক্কা। যাকে বলে সমাজের অন্যায় অবিচারের প্রতি মধুর প্রতিশোধ নেওয়া। থিম্মাক্কা সেটাও পেরেছেন।
থিম্মাক্কার বিয়ে হয়েছিল কর্নাটকের গুব্বি তালুকের বাসিন্দা বেকাল চিক্কাইয়ার সঙ্গে। সন্তান না হওয়ায় স্বামী স্ত্রী উভয়েরই মনোকষ্ট ছিল। তার ওপর পরিবার সামাজের নানা কথাবার্তা। সে জ্বালাও ত কম কিছু নয়। এতদুঃখ কষ্টের মধ্যেও বেকাল চিক্কাইয়ার সম্মতিক্রমে থিম্মাক্কা ঠিক করেন, গাছ লাগাবেন। আর সেই চারা গাছগুলিকে সন্তানস্নেহে বড় করবেন ।
থিম্মাক্কার স্কুল কলেজে যাওয়ার কোনও অভিঙ্গতা নেই। নেই কোনো ডিগ্রির শিক্ষা। গ্রামের আর পাঁচজন দরিদ্র মেয়ের মতোই তিনি শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন রুটি রুজির জন্য। বেকাল চিক্কাইয়া আর থিম্মাক্কা ভূমিহীন দিনমজুর দম্পতি তারওপর সমাজেও একঘরে, কারণ তারা বন্ধ্যা। কথা বলার সমস্যা থাকায় চিক্কাইয়াকে তার পড়শীরা বলত তোতলা চিক্কাইয়া। তাছাড়া সমাজ তাদের দুজনকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ায় চিক্কাইয়া আর থিম্মাক্কার দিনগুলো রাতগুলো কাটছিল যথেষ্ট একলা আর বিষণ্ণভাবেই। তখনই তাঁরা ঠিক করা সমাজের এই অন্যায় আর বঞ্চনার জবাব দিতেই হবে। তখনই তাঁদের মাথায় আসে গাছ লাগানোর কথা, পৃথিবীকে সবুজে ভরে দেওয়ার কথা।
সব কিছুরই একটা শুরু থাকে। চিক্কাইয়া আর থিম্মাক্কার এই জীবনেরও একটা আরম্ভ ছিল। সেই আরেক আরম্ভটা কেমন, শুরুটাই বা কীভাবে হল। প্রথম বছরে ১০টি, দ্বিতীয় বছরে ১৫টি, তৃতীয় বছরে ২০টি বটগাছের চারা লাগালেন তাঁরা। এক সময় এই সন্তান সন্ততিদের দেখভালের জন্য দিনমজুরির কাজও ছেড়ে দেন চিক্কাইয়া। থিম্মাক্কা রোজগার করতেন, আর বাড়ি ফিরে স্বামীর সঙ্গে সন্তানদের দেখভাল করতেন।
জানা যায়, প্রতিদিন প্রায় চার কিলোমিটার পেরিয়ে তারা ওইসব গাছগুলোতে জল দিতেন। গবাদি পশুর হাত থেকে চারাগাছগুলোকে বাঁচাতে কাঁটাতারের বেড়াও বানিয়ে দেন। এইভাবে তাদের গ্রাম হুলিকাল থেকে কুদুর অবধি ২৮৪টি বটগাছের চারা লাগিয়ে ছোট থেকে বড় করেছেন গাছগুলিকে। প্রায় চার কিলোমিটার পথজুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছায়াময় সুবিশাল গাছগুলো যে থিম্মাক্কার ভালোবাসারই কারণেই বেড়ে উঠেছে এবং ডালপালা মেলেছে তা আজ আর কেউ অস্বীকার করতে পারে না। এভাবেই বেশ চলছিল নতুন জীবনের দিনরাত্রি। কিন্তু ১৯৯১ সালে চিক্কাইয়া চলে যাওয়ায় একলা হয়ে পরলেন থিম্মাক্কা। কিন্তু ভেঙে পড়লেন না। একলা লড়াই চালিয়ে গেলেন।
থিম্মাক্কা একাই অতগুলি সন্তানদের পরিচর্যার ভার কাঁধে তুলে নিলেন। একঘরে, একলা হয়ে যাওয়া থিম্মাক্কার দৃঢ় মনোভাবে একটুও টাল খায়নি। যে পরিবার ছিল একঘরে। সেখান থেকেই থিম্মাক্কার কাজের প্রতি সম্মান দেখিয়ে গ্রামবাসীরাই তাকেএকদিন ‘সালুমারাদা’, বলে ডাকতে শুরু করলেন। কন্নড় ভাষায় যার অর্থ ‘গাছেদের সারি।’
এলাকার সালুমারাদা থিম্মাক্কা তারপরও লোকচক্ষুর আড়ালেই রয়ে যেতেন। যদি না স্থানীয়দের মাধ্যমেই তার কথা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে না পড়ত। যারা একদিন তাঁকে বন্ধ্যা বলে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছিল তারাই শেষপর্যন্ত হয়ে ঊঠল থিম্মাক্কার প্রচার মাধ্যম। এরপর ১৯৯৬ সালে ‘জাতীয় নাগরিক সম্মান’ ভূষিত হওয়ার পর তার কথা জানতে পারে গোটা দেশ। বেশ কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থা এগিয়ে আসে তাকে সাহায্য করতে।
থিম্মাক্কার গাছগুলোকে সম্প্রতি দেখভালের দায়িত্ব নিয়েছে কর্নাটক সরকার। এ প্রসঙ্গে তার নিজের বক্তব্য অবশ্য অন্য, তিনি মনে করেন; সন্তানদের প্রতিপালন নিজে করতে পারলেই তিনি খুশি হতেন। কারণ কখনোই কারও সাহায্য চাননি তারা।
আন্তর্জাতিক স্তরের উদ্যোগে থিম্মাক্কা ফাউন্ডেশনেও তৈরি হয়েছে বিদেশের বিভিন্ন জায়গায়। সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশ খুনের প্রতিবাদ সভাতেও থিম্মাকাকে দেখা গিয়েছে সম্প্রতি। গত ৮০ বছরে প্রায় ৮ হাজার গাছ পুঁতে তাদের বড় করে তুলেছেন ১০৬ বছর বয়সী এই বৃক্ষমাতা। স্কুলে যাওয়ার সুযোগ পর্যন্ত যার হয়নি। সেই থিম্মাকাকে অবশ্য পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত করা হয়েছে পরিবেশ রক্ষা ও উন্নয়নের কারণেই। তাছাড়া আন্তর্জাতিক স্তরেও বহু পুরস্কার পেয়েছেন এই বৃক্ষমাতা। তবে পুরস্কারের অপেক্ষায় কি তিনি ছিলেন কখনো।
Be the first to comment