শ্রীকুমার ভট্টাচার্য,
২৫ মে… রাতে দারুন একটা ঘুম দিয়ে ভোরেই উঠে পড়লাম। জ্যাকেট আর গরম টুপিটা মাথায় দিয়ে ঘরের বাইরে পা রাখতেই কাঁপানো ঠান্ডার একটা ঝটকা। গত সন্ধের সেই মেঘ জড়ানো আধো আঁধারি নাগলিঙ্গ গ্রামটা যেন কোন মন্ত্রবলে নিজেকে পাল্টে ফেলেছে রাতের আড়ালে। ঝকঝকে নীল আকাশের ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে নামনাজানা ছোট ছোট কয়েকটা বরফের চুড়ো, পঞ্চমীর চাঁদটা ভোরের আলোয় তার মাধুর্য হারিয়েও টিকে আছে পূব আকাশে।
পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে এসেছে এক নীলাভ ছায়া। নীচে, গিরিখাত দিয়ে ধৌলিগঙ্গা যেন সেই অজানা শিল্পির তুলির টানে এক মায়াবী ষোড়শীর ছন্দে বয়ে চলেছে। দু-একটা বাড়ির মাথা থেকে সদ্য জ্বালানো উনুনের ধোঁয়া, পাহাড়ের ধাপচাষের ছোট ছোট জমিতে চাষের ব্যস্ততা ভোরের প্রথম সোনালি রোদে,… সব মিলিয়ে যেন বহুদূরের কোনো এক হারানো স্বপ্ন রাজ্যে আমার বিচরণ তখন। খচ্চরের পিঠে মালপত্র বেঁধে, হালকা জলখাবার গলাদ্ধকরণ করে ১২ কিমি. পথ পেরোনোর জন্য বেরিয়ে পড়লাম। বিশেষ চড়াই নেই। গাড়ি চলার রাস্তা, তাই সে পথ দিয়ে হেঁটে চলা যেন বন্ধুর কাঁধে হাত রেখে পার্কে চলার মত। কিছুটা পথ এগিয়ে একটা টিলা পড়ল বাঁদিকে। তেমন উল্লেখযোগ্য নয়, তবু অনাদি কালের বিশ্বাসকে নিয়ে একটা গল্প দাঁড়িয়ে আছে সেখানে।
৩০০ ফুট মত উঁচু কালো পাথরের টিলাটা মেরকেটে ১০০০ খানেক ফুটের লম্বা হবে। তার গা বরাবর নারায়ণ শিলার মত লম্বা সাদা ছোপ এঁকেবেঁকে চলে গিয়েছে। গল্পটার শুরু এবং শেষ এখানেই। ‘পুরাকালে এই অঞ্চলে একটা বিরাট সাপ থাকত। সে সাধারণ মানুষকে বাঁচাতে অঞ্চলের সমস্ত হিংস্র জানোয়ারদের মেরে ফেলত… একদিন, এক ব্যাধ তার চলার পথে সাপটাকে দেখতে পেয়ে অজান্তেই তাকে মেরে টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলে। সেই টুকরো অংশগুলোই নাকি টিলাটাতে জড়িয়ে আছে। তারপর থেকে গ্রামটার নাম হয়ে গেল ‘নাগলিঙ্গ’।
গল্পটা শুনে, মোবাইলে টিলাটার একটা ছবি তুলে রাখতে গিয়ে দেখি মোবাইলটা পাচ্ছিনা, জ্যাকেট আর প্যান্ট মিলিয়ে গোটা পনেরো পকেট তন্য তন্য করে খুজেও সেটির আর দেখা মিলল না… অথচ, কিছুক্ষণ আগেই ছবি তুলেছিলাম। আমি আর পরিমল যন্তরটিকে খুঁজতে গিয়ে বারচারেক ঐ ছোট পরিসরের রাস্তাটায় ওঠানামা করেও যখন সেটির আর কোনো হদিশ পেলামনা, তখন একটা চাপা আফশোস নিয়ে এগিয়ে চলা ছাড়া আর কিছু রইল না। আমার বার পাঁচেক মোবাইল হারানোর অভিজ্ঞতায় ভেতরটা বেশ শক্তই হয়ে গেছে, বেড়ানোর কয়েকটা মুহূর্তের ছবি চিরকালের মত হারিয়ে যাওয়ার যতটুকু আফশোস…এই আরকি। মনের ভেতরে তবু একটা বিশ্বাস ছিল যে, পথচলা পাহাড়ি মানুষগুলোর চোখে পড়লে নিশ্চয়ই মোবাইলটা ফেরৎ পাব। অপূর্ব চারিদিক।
হেঁটে যাচ্ছি বটে, তবে ক্লান্তির কোন উপলব্ধি নেই শরীরে। পথের পরে দু-একজন পাহাড়িদের সাথে দেখা হতেই ফোন হারানোর কাহিনীটা তাদের জানিয়ে যাচ্ছি। ঘন্টা দেড়েক মত চলার পর বেশ উঁচুতে একজনকে দেখি হাত নাড়িয়ে আমাদের উদ্দেশ্যে কিছু বলতে চাইছে, দূরত্বটা অতিক্রম করে কাছে যেতেই দেখি একগাল ঈশ্বরের হাঁসি নিয়ে আমাদের বলছে, “ আপমে কিসিকা মোবাইল রাস্তেমে খো গিয়া হোগা, পার মিল গয়া হ্যায়…উপর ‘ডুক্তু’ গাঁও-মে রাখা হুয়া হ্যায়।” তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে আরও একবার অনুভব করলাম যে বারবার হিমালয়ের অমোঘ হাতছানিতে কেন সাড়া দিই। শুধুই কি বাঁধনহারা প্রকৃতির লোভে…, আর এই মানুষগুলোর সান্নিধ্য? শহুরে জীবনের ফাঁদে নিজেকে যতটা লোভী আর বিকৃত করতে সক্ষম হয়েছি, কয়েকদিনের জন্য এদের সংস্পর্শে এসে যেন কিছুটা হলেও সুদ্ধিকরণের উপলব্ধি ঘটে। হাঁসিমুখে যৌথভাবে বেঁচে থাকার সামান্য শিক্ষাটাও যদি রপ্ত করতে পারতাম…।
হাঁটতে হাঁটতে ‘বারলিং’ গ্রামে পৌছে গেলাম। ছবির মত গ্রাম। বরফে মোরা অনামি পাহাড়গুলো ঘিরে রখেছে গ্রামটাকে। এই সৌন্দর্যের অন্তরালেও কিন্তু তৈরী হয়েছে এক অজানা আশঙ্কা। শ’দেড়েক ফুট একটা হিমবাহের ওপর দাঁড়িয়ে আছে গ্রামটা। বিশ্ব-উষ্ণায়ণের হাত থেকে নিস্তার নেই। স্তর গলতে শুরু করেছে। অদূর ভবিষৎতে গ্রামটার অস্তিত্ব হয়’ত মুছে যাবে চিরতরে। দুপুর দেড়টা নাগাদ সেখানে পৌঁছে দেখি গ্রামের অধিকাংশ লোকজনই দলবেধে বেড়িয়ে গেছে ‘কীড়াবোটি’ খুঁজতে। এই ‘কীড়াবোটি’ হল একধরণের শেকড় যাতে একপ্রকার ‘ফাঙ্গাস’ জন্মায়। চোরাবাজারে এর দাম প্রায় ১১ লক্ষ টাকা/কেজি! মর্তে কে এমন আছেন ভাই যে, এই লোভ থেকে নিজেকে বিরত রাখবে, বিশেষ করে এইসব প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেখানে মাত্র ছ’মাসের জন্য চাষাবাদ আর মেষ পালনই মূল জীবিকা। এই অনিয়ন্ত্রিত সংগ্রহের জন্য হিমালয়ের বাস্তুত্বত্তের যে কি ভয়ঙ্কর সর্বনাশ ঘটতে চলেছে তার প্রমাণ হয়ত আমাদের প্রজন্মই পত্যক্ষ করে যাবে।
খিদেতে পেট চুঁইচুঁই। যাবতীয় শুকনো খাবার খচ্চরের পিঠে চেপে ডান্টু গ্রামে পৌছে গেছে হয়’ত ততক্ষনে। মহেশের পরিচিত একটা বাড়িতে দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা হল। উফ্! পাঁচতারা হোটেলের ব্যবস্থা! মোটা চালের ভাত আর নানান ডালের সমাহারে একটা ডাল। সাথে একটাই তরকারির ‘স্যালাড’! কাঠের তাক থেকে পেড়ে নামানো ‘ফাইলেরিয়া’ সদৃশ মাস ছয়েকের পুরোনো একটা তোবড়ানো মূলো! গাড়ির রাস্তা বন্ধ, তাই আলু বা পেঁয়াজ কল্পনায় আঁকা রইল। সামান্য আয়োজনটুকু ঢাকা পড়ে গেল তাদের ছলনাহীন আন্তরিকতায়। তৃপ্তির ঢেঁকুড় তুলে আর মাত্র চার-পাঁচ কি.মি.র পথের উদ্দশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। আবার একটা খরস্রোতা হিমবাহ-ঝর্ণা। সেটাকে কোনোরকমভাবে পেরিয়েই দেখি মহেশ আর তার এক চেলা দুটো ‘মটরসাইকেল’ নিয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। আমাদের চারজন, অর্থাৎ, আমি, দীপান্বিতা, পরিমল ও অমিতই পেছনে রয়ে গেছি। বাকিরা আগেই ‘মটরসাইকেল’ চেপে ‘ডুক্তু’ গ্রামে পৌছে গেছে। শেষ কিলোমিটার দেড়েক আমরা দ্বিচক্রযানের সোয়াড়ি হয়েই ‘দুক্তু’ গ্রামে ঢুকলাম, অবস্য তার আগেই আমার মোবাইলটা আমার হাতে গুঁজে দিয়ে গেছে মহেশের সাকরেদ।
‘দুক্তু’ গ্রামে ঢুকতেই পঞ্চচুল্লির পাঁচটা চূড়োর মধ্যে তিনটে দেখা মিলল। এখানে সবাই একসাথে জড়ো হয়ে এক রাউন্ড চা খেয়ে দেড় কিমি দূরে ‘ডান্টু’ গ্রামে মহেশের ‘হোম-স্টে’র দিকে এগোলাম। পথে ‘নেওলা ইয়াঙটি’ পেরোতে হল। তীব্বতি ভাষায় ‘ইয়াঙটি’ মানে নদী। এই ‘নেওলা’ নদী নেমে আসছে পঞ্চচুল্লি থেকে, কিছুদূর গিয়ে মিশেছে ধৌলিগঙ্গার সাথে। আহা! ঠিক এই জায়গাটা থেকেই পাঁচটা চূড়ো পরিস্কার দেখা যায়। অবর্ণনীয় রূপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে চোখের সামনে। ‘হোম-স্টে’র পাথরের বাড়িটায় পৌঁছে যেন এক স্বর্গীয় অনুভূতি। পাশাপাশি দুটো কার্পেট আর কম্বল বেছানো ঘরে কোনো রকমে মালপত্রগুলো রেখেই বাড়ি সংলগ্ন সামনের ঘাসে ঢাকা উঠোনে শেষ বেলার রোদ পোয়াতে যে যার মত বসার জায়গা খুঁজে নিল। মাত্র কিমি. সাতেক দূরেই পঞ্চচুল্লি রাজ-মহিমায় দাঁড়িয়ে আছে।
পরবর্তী অধ্যায় জানতে/পড়তে রবিবার চোখ রাখুন রোজদিনের ওয়েবসাইটে।
Be the first to comment