জম্মু-কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা (Article 370) প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিলো নরেন্দ্র মোদি সরকার ৷ এই ধারায় জম্মু-কাশ্মীরকে বিশেষ স্বশাসিত মর্যাদা দেওয়ার উল্লেখ রয়েছে ৷ তবে ৩৭০ ধারা (Article 370) তুলে দেওয়া মানে কাশ্মীর বিশেষ মর্যাদা হারাবে ৷ একই সঙ্গে জম্মু-কাশ্মীর ও লাদাখকে আলাদা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল গড়ার সিদ্ধান্তের কথাও জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ৷ লাদাখে কোনও বিধানসভা থাকবে না ৷
প্রসঙ্গত, বহুকাল ধরেই জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদার বিরোধিতা করছে বিজেপি ৷ ২০১৪ সালে বিজেপি-র নির্বাচনী ইস্তেহারে কাশ্মীর নিয়ে এই প্রতিশ্রুতির কথা বলা হয়েছিলো ৷ ইস্তেহারে জানানো হয়েছিল, কাশ্মীরি পণ্ডিতদের সম্মানের সঙ্গে ফেরাতে ও নিরাপত্তা দেওয়া বিজেপির অন্যতম অ্যাজেন্ডা ৷
৩৭০ ধারা কী?
এই ধারায় প্রতিরক্ষা, বিদেশনীতি, যোগাযোগ-সহ কিছু বিষয় ছাড়া যে কোনও আইন জম্মু-কাশ্মীরে লাগু করতে সংসদকে জম্মু-কাশ্মীর সরকারের সম্মতি নিতে হবে ৷ নাগরিকত্ব, সম্পতির মালিকানা ও নাগরিক অধিকার সম্বন্ধীয় বিষয়ে রাজ্যের বাসিন্দারা পৃথক আইনের আওতায় থাকবেন ৷ ভারতের অন্যান্য রাজ্যের বাসিন্দারা সেই আইনের আওতায় থাকবেন না ৷
এই ধরনের আইনি রক্ষাকবচ ভারতের অন্যান্য আদিবাসী অঞ্চলেও বিদ্যমান ৷ তার মধ্যে রয়েছে, হিমাচলপ্রদেশ, অরুণাচলপ্রদেশ, আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ ও নাগাল্যান্ডে৷ শুধু মাত্র জম্মু-কাশ্মীরের ক্ষেত্রে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে৷ সংবিধান বিশেষজ্ঞ অমল মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘৩৭০ ধারায় রয়েছে, রাষ্ট্রপতি ইচ্ছে করলে জম্মু-কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বাতিল করতে পারেন৷ সে ক্ষেত্রে সংবিধান সভার অনুমোদন নিতে হবে৷ কিন্তু আপাতত জম্মু-কাশ্মীরে রাষ্ট্রপতি শাসন চলছে।
জম্মু-কাশ্মীরের নিজস্ব পৃথক সংবিধান রয়েছে ৷ আইনের এই ধারায়, কাশ্মীরের মানুষই কাশ্মীরে জমি কিনতে পারবেন ৷ ভারতের অন্য রাজ্যের মানুষ জম্মু-কাশ্মীরে কোনও সম্পত্তি কিনতে পারবেন না ৷ কেন্দ্রীয় সরকার কোনও রকম আর্থিক জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে পারবে না ৷ একমাত্র যুদ্ধ হলে ও শত্রুরাষ্ট্র আগ্রাসী পদক্ষেপ করলেই কেন্দ্র জরুরি অবস্থা জারি করতে পারে ৷
১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার সময় কাশ্মীরের রাজা হরি সিং প্রাথমিক ভাবে স্থির করেছিলেন তিনি স্বাধীন থাকবেন এবং সেই অনুযায়ী ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে স্থিতাবস্থার চুক্তি স্বাক্ষর করবেন। পাকিস্তান সে চুক্তিতে স্বাক্ষরও করেছিলো। কিন্তু জনজাতি এবং সাদা পোশাকের পাক সেনা যখন কাশ্মীরে অনুপ্রবেশ করে, তখন তিনি ভারতের সাহায্য চান, যা কাশ্মীরের ভারতভুক্তির অন্যতম কারণ। ১৯৪৭ সালের ২৬ অক্টোবর হরি সিং ভারতভুক্তির চুক্তি স্বাক্ষর করেন। পরদিন, ২৭ অক্টোবর গভর্নর জেনারেল লর্ড মাউন্টব্যাটেন সে চুক্তি অনুমোদন করেন। ১৯৪৯ সালে নিয়ন্ত্রণরেখা প্রতিষ্ঠিত হয় ৷
৩৭০ ধারা সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল ১৯৪৯ সালের ১৭ অক্টোবর। এই ধারা বলে জম্মু-কাশ্মীরকে ভারতীয় সংবিধানের আওতামুক্ত রাখা হয় (অনুচ্ছেদ 1 ব্যতিরেকে) এবং ওই রাজ্যকে নিজস্ব সংবিধানের খসড়া তৈরির অনুমতি দেওয়া হয়। এই ধারা বলে ওই রাজ্যে সংসদের ক্ষমতা সীমিত। ভারতভুক্তি সহ কোনও কেন্দ্রীয় আইন বলবৎ রাখার জন্য রাজ্যের মত নিলেই চলে। কিন্তু অন্যান্য বিষয়ে রাজ্য সরকারের একমত হওয়া আবশ্যক।
এই ধারা কাশ্মীরের বাসিন্দাদের বিশেষ ক্ষমতা দিয়েছে। ফলে বাইরের প্রদেশের বাসিন্দারা এখানে স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি কিনতে পারেন না। এছাড়া এজন্য জম্মু ও কাশ্মীর সরকার অন্য প্রদেশের নাগরিকদের চাকরিতে রাখতে পারে না। ১৯৫৪ সালে রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদের নির্দেশে ৩৫A ধারাকে ৩৭০ নম্বর ধারার সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়। কাশ্মীরের মেয়েরা অন্য রাজ্যে বিয়ে করলে তাঁদের সম্পত্তির কোনও অধিকার থাকে না।
১৯৫৬ সালে জম্মু-কাশ্মীরের যে সংবিধান গৃহীত হয়েছিল, সেই সংবিধানে নির্দিষ্ট করে জানানো হয়েছিল, জম্মু-কাশ্মীরের স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে বিবেচিত হতে হলে শর্ত কী কী। ভারতভুক্তির শর্ত অনুযায়ী, জম্মু-কাশ্মীরে সংসদ প্রতিরক্ষা, বিদেশ ও যোগাযোগ এই তিনটি বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়ে ক্ষমতাশালী ৷
সংবিধান অনুযায়ী ১৯৫৪ সালের ১৪ মেতে যাঁরা জম্মু-কাশ্মীরের প্রজা ছিলেন, তাঁদের সকলকে রাজ্যের স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে গণ্য করা হবে। এ ছাড়া, কেউ যদি ১০ বছর বা তারও বেশি সময় জম্মু-কাশ্মীরে থাকেন এবং বৈধ উপায়ে সে রাজ্যে স্থাবর সম্পত্তির মালিক হন, তা হলে তিনিও রাজ্যের স্থায়ী বাসিন্দা বিবেচিত হবেন। ৩৫A ধারা অনুযায়ীই জম্মু-কাশ্মীরের জন্য এই বিশেষ ব্যবস্থা স্বীকৃতি পেয়েছে।
২০১৪ সালে একটি বেসরকারি সংস্থা জম্মু-কাশ্মীর থেকে ৩৫A ধারা বাতিল করার আর্জি জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টে রিট পিটিশন জমা দেয়। জম্মু-কাশ্মীর সরকার পাল্টা হলফনামা জমা দিয়ে এই রিট পিটিশন খারিজ করার দাবি তোলে। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার কোনও পক্ষ নেয়নি। জম্মু-কাশ্মীর সরকার বার বার অনুরোধ করা সত্ত্বেও ৩৫A ধারা বহাল রাখার পক্ষে কেন্দ্র সওয়াল করেনি।
২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে সুপ্রিম কোর্ট জানিয়ে দিয়েছিল, শিরোনামে সাময়িক লেখা থাকলেও ৩৭০ ধারা সাময়িক নয়। ১৯৬৯ সালে সম্পৎ প্রকাশ মামলায় ৩৭০ ধারাকে সাময়িক বলে মানতে অস্বীকার করে সুপ্রিম কোর্ট ।
জম্মু-কাশ্মীরের সংবিধানের ৩ নং অনুচ্ছেদে বলা রয়েছে যে জম্মু কাশ্মীর ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ৩৭০ ধারা থেকেই প্রবাহিত হয়েছে ৩৫A ধারা, যা ১৯৫৪ সালে রাষ্ট্রপতির নির্দেশের মাধ্যমে কার্যকর হয়েছিল। ৩৫A ধারানুসারে, জম্মু-কাশ্মীরের বাসিন্দা বলতে কী বোঝায়, তাঁদের বিশেষ অধিকারগুলি কী কী, এ সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার জম্মু-কাশ্মীর বিধানসভার উপর ন্যস্ত রয়েছে।
২০১৭ সালে ৩৭০ ধারাকে চ্যালেঞ্জ করে দিল্লি হাইকোর্টে মামলা দায়ের করেন বিজয়লক্ষ্মী ঝাঁ নামে এক মহিলা। ২০১৭ সালের ১১ এপ্রিল এই মামলা খারিজ করে দেয় আদালত। তা খারিজ হয়ে যায় ৷ সেই রায়কে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে যান বিজয়লক্ষ্মী। তাঁর দাবি ছিল ৩৭০ ধারাকে অস্থায়ী ব্যবস্থা বলে ঘোষণা করুক আদালত। কারণ এই ব্যবস্থার সময়সীমা শেষ হয়ে গিয়েছে। তাই এবার তা তুলে দেওয়া উচিত।
২০১৮ সালে দেশের শীর্ষ আদালত স্পষ্ট জানিয়ে দেয় সংবিধানের ৩৭০ ধারা অনুযায়ী জম্মু–কাশ্মীর যে বিশেষ সুবিধা পেয়ে থাকে তা কোনও অস্থায়ী বন্দোবস্ত নয়।
২০১৯ সালের ৫ অগাস্ট (সোমবার) রাজ্যসভায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ৩৭০ ধারা রদ করার কথা ঘোষণা করেন ৷ রাজ্যের মর্যাদা হারালো জম্মু-কাশ্মীর ৷ সেখান থেকে ভাঙা হলো লাদাখ ৷ দুটোই হচ্ছে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল ৷ দু’টি জায়গাতেই দু’জন লেফটেন্যান্ট গভর্নর নিয়োগ করা হবে। লাদাখের ক্ষেত্রে আইনসভা থাকছে না, তবে জম্মু-কাশ্মীরের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট আইনসভা থাকবে ৷
Be the first to comment