শ্রীকুমার ভট্টাচার্য,
২৭ মে ভোরবেলা ঘুমটা ভাঙতেই সরাসরি গাত্রোথ্থান। নকুড়মামাটি হয়ে বাইরে বেরিয়ে দেখি বিষ্মকর রঙের ছটায় পঞ্চচুল্লির মাথাগুলো নতুন একটা দিনের আহ্বান জানাচ্ছে। ৬.৩০ মধ্যেই মহেশ এসে আমাদের তৈরী হয়ে থাকতে বলল। ৭.৩০-৮ আমরা বেরিয়ে পড়ব পঞ্চচুল্লি ‘বেস-ক্যাম্পের’ উদ্দেশ্যে। ধান্তু থেকে নাওলা নদী পেরিয়ে দুক্তু গ্রাম, সেখান থেকে সাড়ে চার কিমির হাল্কা চড়াই রাস্তা। ঝকঝকে দিনের সাথে আর একটা সুখবর পৌছে দিল মহেশ…, গাড়ির রাস্তাটা খুলে গেছে, অতএব, ধান্তু থেকে দুক্তু গ্রামের ২ কিমি পথটা গাড়িতেই পৌছনো যাবে। ‘বেস-ক্যাম্পে’ আড়াই দিন থাকার মত গরম জামাকাপড় ছোট ‘স্যাকটায়’ ভরে ৮ নাগাদ রওনা হলাম, বাকি সব মালপত্র ধান্তুতেই রইল। গাড়িতে বসে নাওলা নদীর পাথর আর কোমর সমান জল পেরোনোর অভিজ্ঞতাটা বেশ রোমাঞ্চকর।
দুক্তু গ্রাম থেকে দুজন অতিরিক্ত পোর্টার নিয়ে টুকটুক করে চড়াই ভেঙে ওপরে ওঠা। রাস্তাটার সৌন্দর্য বর্ণনাতীত, পাইন,ফার আর বার্চের ছায়ায় পথচলা। ক্লান্তির কোনো অবকাশ নেই এপথে… শুধুই প্রকৃতির নরম ছোঁয়ায় নিজেকে জারিত করা। কিছু কিছু জায়গায় পাহাড় থেকে হিমবাহ নেমে চলার পথকে মাত্র ৮-১০” করে রেখেছে। এমনই একটা জায়গায়, পাহাড় আমাদের সবাইকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল যে সামান্যতম অসাবধনতায় ঐ অপরূপ শোভা কেমন মৃত্যুফাঁদ পেতে অপেক্ষা করতে পারে। ঐ সরু অংশটায় আমার গজ দশেক পেছনেই হাঁটছিলেন মতিদা। তাঁর একটু পেছনে আসছিল দীপান্বিতা আর পরিমল। হঠাৎই দীপান্বিতার চিৎকারে পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখি, মতিদা ফুট তিনেক নীচে কাদায় পা পিছলে খাদে পড়ে গিয়ে একটা বার্চ আর পাইনের ঝোপে আটকে আছেন। পিঠ থেকে স্যাকটা খুলে পেছনে ছুটে যাওয়ার আগেই দেখি ঐ দুই পোর্টার, নিখিল আর ধর্মেশ ঝাপিয়ে গিয়ে মতিদাকে ধরে ফেলেছে। এক্ষেত্রে কপাল খুব ভালো বলতে হবে- কারণ, আর ফুট পাঁচেকের এদিক ওদিক হলেই গাছহীন অংশে প্রায় ৩০০-৩৫০’ ফুট নীচে পড়ে যেতেন, তখন অমূল্য বেড়ানোর স্মৃতিটা দুর্বিষহ এক ছবির মত আজীবন বয়ে বেড়াতে হত হয়’ত আমাদের। চৌষট্টি বছরের চির নবীন মতিদা গা ঝেড়ে উঠে দাঁড়িয়েই আবার স্বমহিমায় হাঁটতে শুরু করলেন যেন তেমন কিছুই হয়নি। তারপর থেকে অবশ্য দুই সঙ্গী ডাক্তারের সাঁড়াশি চাপে অতীব সাবধানি হতে বাধ্যই রইলেন।
ফেরার পথে দলের মধ্যে দু-একজনের মনে মুনসিয়ারী জায়গাটা দেখার সুপ্ত বাসনা ছিল। সকলের মানসিক বুননের ওপর আমারও অগাধ বিশ্বাস ছিল- যে, একবার বেস-ক্যাম্প পৌছোনোর পর কেউই আর মুনসিয়ারী ঘোরার জন্য বাই তুলবেনা। সেক্ষেত্রে পুরো দু-দুটো দিন ঐ নিঃসীম সৌন্দর্যের মাঝে থাকতে পারবো। হলও তাই, সাড়ে চার কিমি পথ হেঁটে যখন বেস-ক্যাম্পে পৌছলাম তখন উত্তুঙ্গ পঞ্চচুল্লির প্রায় নরম কোল আর KMVN এর ‘ইগলু-হাটে’ থাকার ব্যবস্থা দেখে ওখান থেকে একদিন আগে নেমে আসার চিন্তাটাই স্রেফ উবে গেল সবার মন থেকে। রাজভোগের স্বাদ নিয়ে কোন বান্দা আর নকুলদানার পেছনে দৌড়বে…।
মুনসিয়ারী থেকে পঞ্চচুল্লির দর্শন হয় প্রায় ১৭০ কিমি দূর থেকে, আর এখানে, মাত্র ৪-৬ কিমি দূরেই তিনি দাঁড়িয়ে আছেন। আহা! সমমনষ্ক মানুষগুলোর সাথে এমন নিখুঁত সৌন্দর্যের গভীরে নিজেকে খুবই ভাগ্যবান বলে মনে হচ্ছিল তখন। দিন কাটল নানান গল্প-আড্ডায়, রাতে খাবার খেয়ে দুটো ‘হাটে’ আমরা ভাগাভাগি করে শুতে গেলাম আগামীকাল ভোরে ‘জিরো-পয়েন্টে’ যাওয়ার স্বপ্ন বুকে নিয়ে।
Be the first to comment