তপন মল্লিক চৌধুরী,
জুলাই মাসের শেষের দিক থেকেই মনে হচ্ছিল কাশ্মীরে একটা কিছু ঘটতে চলেছে। আগস্টের শুরুতেই আঁচ পাওয়া গেল যখন সেখানে ১০ হাজার অতিরিক্ত সেনা মোতায়েন করা হয়, তীর্থযাত্রার অনুষ্ঠান বাতিল করা হয়, স্কুল কলেজ বন্ধ করে দেওয়া হয়, পর্যটকদের ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়, টেলিফোন ও ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং রাজনৈতিক নেতাদের গৃহবন্দী করা হয়। কাশ্মীরসহ বেশিরভাগ এলাকাতেই এখনো স্বাভাবিক পরিস্থিতি নেই। একটি অঞ্চলের সঙ্গে অন্য অঞ্চলের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। এমনকি অনেকে তাদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেও দেখা করতে পারছেন না। জাতিসংঘ কাশ্মীরের এই পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদবেগ প্রকাশ করে জানিয়েছে, টেলিযোগাযোগ বন্ধ করা, নেতাদের জোর করে আটকে রাখা আর রাজনৈতিক সভা সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞাকে মানবাধিকারের পক্ষে খুবই ক্ষতিকর।
এরকম একটা পরিস্থিতি একদিনে হয় না। প্রস্তুতিটা শুরু হয়েছিল ২০১৫ সাল থেকে। দেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল কাশ্মীরের জন্য ‘ডোভাল ডকট্রিন’ ফর্মুলেট করার পর থেকেই। সেখানে একটি প্রস্তাব ছিল দেশের অন্যান্য অংশ থেকে লোকজন এনে কাশ্মীরে বাস করানো। কেবল তাই নয়; ডোভালের ডকট্রিনে ছিল, কাশ্মীরে হিন্দু পন্ডিতদের জন্য আলাদা কলোনি স্থাপন, কাশ্মীরে শিল্পাঞ্চলের জন্য দেশের অন্যান্য জায়গা থেকে শিল্পশ্রমিকদের এনে বসতি গড়া কিংবা ভারতীয় সেনার প্রাক্তন সদস্যদের এনে কাশ্মীরে জমি দেওয়া।
গত নির্বাচনের আগে বিজেপি তাদের নির্বাচনী ইশতেহারেও সংবধিানের ৩৭০ ধারা ও আর্টিকল ৩৫-এ বাতিল করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। সরাসরি ঘোষণা করেছিল, ভোট দিয়ে জেতালে কাশ্মীরে জমিজমা কেনা যাবে। বিজেপি বা জনসঙ্ঘ বহু বছর ধরেই ভারতীয় সংবিধানের এই ধারাটি বিলোপ করার দাবি জানিয়ে আসছিল। তাদের বক্তব্য ছিল, কাশ্মীর যাতে সম্পূর্ণভাবে ভারতের সাথে সংযুক্ত বা আত্মীকৃত হতে পারে সে জন্যই এই ধারাটি বিলোপ করা দরকার। তবে রাজনৈতিক বিশেষঙ্গরা মনে করছেন সংবিধানের ৩৭০ ধারা বিলোপের পেছনে আসল উদ্দেশ্য হল কাশ্মীরের জনসংখ্যাগত চরিত্র বদলে দেওয়া। এ নিয়ে বিতর্ক থাকতেই পারে কিন্তু ভারতের সংবিধানে আর্টিকেল ৩৭০ নামের ওই অনুচ্ছেদে জম্মু ও কাশ্মীরকে বিশেষ মর্যাদা দেয়া হয়েছিল, ভারতের সঙ্গে কাশ্মীরের ৭০ বছরের সম্পর্ক এর ওপর ভিত্তি করে গঠিত হয়েছিল। স্বাধীনতার সাত দশক পর বিজেপি সরকার তাদের বহু পুরনো রাজনৈতিক এজেন্ডাটি বাস্তবায়ন করল।
ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিকভাবে কাশ্মীরের চরিত্রে কয়েকটি গুরুত্বপুর্ণ বৈশিষ্ট আছে। সীমান্তবর্তী রাজ্য জম্মু ও কাশ্মীর এমন একটি প্রদেশ, যার সংস্কৃতি, ইতিহাস, ভূগোল, রাজনীতি সবই এ দেশের অন্যান্য রাজ্যের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। এই রাজ্যের লাদাখে বৌদ্ধ ও মুসলিমরা থাকেন, কাশ্মীরে থাকেন মুসলিম, পন্ডিত ও শিখরা। আর জম্মুতে জনসংখ্যার ষাট শতাংশ হিন্দু, আর বাকি চল্লিশ শতাংশ মুসলিম। এমন একটি রাজ্যকে সংবিধানের ৩৭০ ধারা মারফত এক সূত্রে বেঁধে রাখার প্রচেষ্টায় এই রাজ্যের সব ভাষা-ধর্ম-সংস্কৃতির মানুষের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা ছিল। আর বিজেপি সরকার গোড়া থেকেই চেয়েছিল কাশ্মীরের আবহমান কালের চরিত্রটা পাল্টে দিতে।
জনসঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতাও আজ থেকে ছেষট্টি বছর আগে কাশ্মীরের সর্বাত্মক ভারতভুক্তির জন্য ৩৭০ ধারা বিলোপের দাবি জানিয়েছিলেন, আজ তাঁর রাজনৈতিক উত্তরসূরীরাই সেই স্বপ্নকে পূরণ করলেন। ৩৭০ ধারা বিলোপের অর্থ কেবল কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা কেড়ে নেওয়াই নয়, ভারত-শাসিত ওই প্রদেশের প্রায় দেড় কোটিরও বেশি মানুষকে অবহেলা এবং বঞ্চনা করা। এতে কাশ্মীরিদের সঙ্গে সম্পর্ক কোনওভাবেই ভাল হতে পারে না, তাদের সঙ্গে দূরত্ব আরও বাড়বে।
একসময় জম্মু ও কাশ্মীর হিসেবে পরিচিত রাজ্যটি ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে উপমহাদেশের স্বাধীনতা লাভের সময় ভারতের সাথে যুক্ত হয়। ভারত ও পাকিস্তান এই অঞ্চলের আধিপত্যকে কেন্দ্র করে কয়েকবার যুদ্ধে জড়ালেও শেষপর্যন্ত দুই দেশই সেখানকার ভিন্ন ভিন্ন অংশের নিয়ন্ত্রণ নিতে সক্ষম হয়। ৩৭০ ধারাটি ভারতের সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল ১৯৪৯ সালের ১৭ অক্টোবর। ১৯৫৪ সালে এর সঙ্গে ৩৫ -এ ধারা যুক্ত করা হয়। এই দুই ধারা বলে জম্মু-কাশ্মীরকে ভারতীয় সংবধিানের আওতাভুক্ত রাখা হয় (অনুচ্ছদে ১ ব্যতিরেকে)। অর্থৎ সারা ভারতে যে সংবিধান বলবৎ ছিল জম্মু-কাশ্মীরের ক্ষেত্রে তা ছিল ভিন্ন।
ভারতের সঙ্গে কাশ্মীরের সংযুক্তিকরণের ভিত্তি হচ্ছে সংবিধানের ৩৭০ ধারা, সেটা ইচ্ছে হল আর বাতিল করলাম এটা হতে পারে না। কারণ, কাশ্মীর ও ভারতের সরকার ‘ইনস্ট্রুমেন্ট অব অ্যাকসেসন’-য়ে শর্তের ভিত্তিতেই সই করেছিল, আর তার মাধ্যমেই কাশ্মীর ভারতে সংযুক্ত হয়েছিল। বিজেপি সরকার একতরফাভাবে বলতে পারে না যে পরিস্থিতি পরিবর্তিত হয়েছে, তাই সেই শর্তগুলির আর প্রাসঙ্গিকতা নেই অতএব বাতিল। ভারতের একশো কোটি মানুষও যদি বলে কাশ্মীর ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, আর কাশ্মীরের মানুষ সে কথা না মানে, তাহলেও কিন্তু আইনি পথে বা গণতান্ত্রিকভাবে ভারত সরকারের দাবি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। সম্ভব একমাত্র গায়ের জোরে।
Be the first to comment