তপন মল্লিক চৌধুরী
বিদ্যাধর সূরজপ্রসাদ নাইপল যে একালের ইংরেজি সাহিত্যের একজন গুরুত্বপূর্ণ লেখক তা নিয়ে সাহিত্য মহলে কোনও প্রশ্ন নেই। সাহিত্য যদি কেবলমাত্র নিখুত আখ্যান হয় তবে গল্প বলিয়ে হিসেবেও তার দক্ষতা নিয়ে কারও দ্বিমত থাকতে পারে না। তবে যেটা ঘটনা, লেখনির জন্য জীবনভর নাইপল যতটা প্রশংসিত হয়েছেন, ঠিক ততটাই নিন্দিত হয়েছেন আফ্রিকা বিদ্বেষ, ইসলাম বিরোধী মন্তব্য, ঔপনিবেশিক মানসিকতার শিকার বলে ভারতীয়দের তিরস্কার, তথাকথিত তৃতীয় বিশ্বের বুদ্ধিজীবীদের হেয় করা, বাঙালিকে অহংসর্বস্ব বলে ঠাট্টা করা, মহিলাদের অবজ্ঞা করা, সমসাময়িক লেখকদের সম্পর্কে বিতর্কিত বক্তব্যের জন্য। এসব নিয়ে তাঁর অবশ্য কোনওদিনই কোনও মাথা ছিল না, বরং তিনি বলতেন, ‘কোনও লেখক যদি বিতর্কই তৈরি করতে না পারেন তাহলে বুঝতে হবে সেই লেখকের মৃত্যু হয়েছ’। বর্ণবিদ্বেষী, লিঙ্গবৈষম্যকারী, ইসলামবিরোধী বলে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ কি কম উঠেছে। জীবনীকার প্যাট্রিক ফ্রেঞ্চকে তিনি খোলাখুলি জানিয়েছিলেন, বিবাহিত জীবনে পতিতাদের সঙ্গে তাঁর নিয়মিত মেলামেশা ছিল। জানিয়েছিলেন তাঁর রক্ষিতার উপর অমানুষিক অত্যাচার করার কথা, বলেছিলেন স্ত্রীর সঙ্গে এমন ব্যবহার করেছিলেন যে বলা যায়, ‘আমি তাঁকে হত্যা করেছি’। তবে একথা স্বীকার করলেও এনিয়ে কখনও তাঁকে আফশোষ করতে দেখা যায়নি। নাইপলের উপন্যাস বললেই সাধারণ পাঠক ধরেই নেয়, রুক্ষ নির্দয় গদ্যে মনুষের জীবনের গ্লানি আর দুর্দশাকে বর্ণনা করার অসাধারণ ক্ষমতা। পাশাপাশি নাইপলের ভ্রমণভিত্তিক যে বেত্তান্ত সেখানেও তিনি তৃতীয় বিশ্বের নানা ধরণের দারিদ্র্যতাকে আকর্ষণীয় হিসেবে উপস্থাপনের কোনও চেষ্টাই করেননি। বরং সেগুলি হয়ে উঠেছে যেন ভয়-ভীতি জাগানিয়া সত্য বর্ণনার উদাহরণ। তথাপি সমালোচকদের মত, নাইপলের লেখায় ছড়িয়ে আছে নানান ভ্রান্তি আর বিদ্বেষ, কখনও কখনও সেখানে মিশেছে গোঁড়ামী, অহেতুক রাগ-বিরক্তি-ঘেন্নায় তিনি ব্যয় করেছেন বহু কথা। তবে অতি তীব্র এবং আক্রমণাত্মক হলেও তারা নাইপলের সহিত্যকর্মের অসাধারণত্ব স্বীকার করে নিয়েই তাঁর লেখার সমালোচনা করেছেন। সমালোচদের ভাষায় নাইপল স্টিরিওটাইপে আটকে পড়া এক বুড়ো, যিনি নিজের ফেলে আসা জায়গাকে গালমন্দ করেছেন সারাক্ষণ। অবশ্যি একথা পুরোপুরি অস্বীকার করা যায় না যে, সমালোচনাকে পাত্তা দেওয়ার মানুষ নাইপল ছিলেন না। অন্যের সঙ্গে বিরোধ সৃষ্টির ক্ষমতা যে তার মজ্জাগত, তাও তিনি জানতেন। বলতেন, এই গুণটি না থাকলে একজন মানুষ আসলে মৃত।
নাইপল এক নতুন গদ্যরীতির সূচনা করেছিলেন যা তাঁকে সেইসময়ের সব লেখকের থেকে আলাদা করে দিয়েছিল। ১৯৬১ সালে প্রকাশিত উপন্যাস ‘হাউস ফর মিস্টার বিশ্বাস’-ই প্রথম তাঁকে লেখক হিসেবে পরিচিতি এনে দিয়েছিল। অক্সফোর্ড বিশববিদ্যালয়ে পড়ার সময় মাত্র ২০ বছর বয়সে তিনি এই উপন্যাস রচনা করেছিলেন। ভারত থেকে উনবিংশ শতকজুড়ে চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ত্রিনিদাদে আখের ক্ষেতে চাষ করতে। চুক্তির শর্ত ছিল যে, চুক্তির মেয়াদ ফুরোলে এদের দেশে ফেরার জাহাজের টিকিট ধরিয়ে দেওয়া হবে, আর থোক কিছু টাকা। কিন্তু ইতিমধ্যে মহাত্মা গান্ধীর আন্দোলনের ফলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য থেকে উঠে গেল এই চুক্তিবদ্ধ দাসত্ব প্রথা। ত্রিনিদাদের ওই শ্রমিকগুলোর তখন কী হবে? বিদ্যাধরের দাদুও গিয়েছিলেন ওদের সঙ্গে। জন্মসূত্রে ব্রাহ্মণ বলে পুরোহিত হিসেবে। লোকগুলো তখন রাস্তায় ঘাটে শুয়ে থাকত, চুক্তি আর বলবৎ নেই, কাজ নেই, দেশে ফেরার টিকিটও আর পাওয়া যায়নি। এদের সম্বন্ধে কেউ কিচ্ছু জানতো না, এরা কারা, কোত্থেকে এলো, কোথায়ইবা যাবে! এভাবেই পৃথিবীর বহু কোণের ইতিহাস আলোকিত বৃত্তের বাইরে প্রায়ন্ধকারে ছায়া হয়েই পড়েছিল। উপনিবেশিকোত্তর সাহিত্যের একটা মুখ্য অংশই তো সেই অনাদরে পরে থাকা ইতিহাস-কথা। ভি এস নাইপল ওই সাহিত্যেরই ইতিহাস রচয়িতা। ইতিহাসের এই পর্যায়টির যিনি নাম দিলেন, ‘নতুন পৃথিবী’, আর আমরা বললাম পোস্ট-কলোনিয়াল। ‘এ হাউস ফর মিস্টার বিশ্বাস’ আধুনিক ভারতীয় ইংরেজি উপন্যাসের সূচনাবিন্দু। হতে পারে তার পটভূমি ত্রিনিদাদ, কিন্তু মোহন বিশ্বাস থেকে শ্যামা, তুলসী পরিবার সবাই ভারতীয় অভিবাসী পরিবারের সন্তান। ছোট্ট মোহনের ছ’টা আঙুল, তার জন্মের পর কোষ্ঠী তৈরি, গণৎকারের তাকে অপয়া বলে ভবিষ্যদ্বাণী করা—এ সবই ভীষণ ভাবে ভারতীয়।
‘অ্যা হাউজ ফর মি: বিশ্বাস’, ‘ইন অ্যা ফ্রি স্টেট’, ‘অ্যা বেন্ড ইন দি রিভার’ তার বিখ্যাত রচনা। সবগুলির মূল বিষয় হল ভাগ্য সন্ধানী ও অস্তিত্বের সংকটে পড়া মধ্যবিত্ত পরিবারের মনস্তাত্তিক সংগ্রাম। সুদীর্ঘ ৮৫ বছরের জীবনে নাইপলের সাহিত্যে মানুষের জীবন সংগ্রাম, ইতিহাস ও সমাজবাস্তবতার বহুমাত্রিক প্রতিফলন থাকাটাই স্বাভাবিক। সেখানে ত্রিনিদাদ কিম্বা ভারতের সমাজবাস্তবতার সবথেকে কদাকার দিক বর্ণবাদের মানবিক সংকট যেমন উঠে এসেছে, পাশাপাশি ঔপনিবেশিক শক্তি এবং ইসলামের প্রভাব সম্পর্কেও নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটেছে। তবে ভারতীয় সমাজে ইসলামের আগমন ও প্রভাব সম্পকে নাইপল যে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেছেন তাকে পশ্চিমের ইতিহাস গবেষক ও সমাজতাত্তিকরা মেনে নিতে পারেননি। তাঁরা নাইপলের দৃষ্টিভঙ্গির ভুল ধারণাকে বিশ্লেষন করে দেখিয়েছেন ভারতের স্থানীয় রাজারা কিভাবে ইসলামী সংস্কৃতি, দৃষ্টিভঙ্গি, সমরকৌশল স্বেচ্ছায় গ্রহণ ও আয়ত্ব করেছিলেন। ইতিহাস গবেষকরা দেখিয়েছেন, দাক্ষিণাত্যের সুলতানদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে স্থানীয় রাজারা শুধু যে ইসলামের অনুরাগী হয়ে উঠেছিলেন তাই নয়, সুলতানদের পক্ষ নিয়ে অন্য স্থানীয় রাজাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধও করেছেন। পরিবর্তনশীল ভারতীয় সমাজব্যবস্থা যখন পশ্চিমী অর্থনীতি ও সাম্রাজ্যবাদী নীতির দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত। তখন ভারতে হিন্দু-মুসলমান সহাবস্থানের ইতিহাস সম্পর্কে ভিএস নাইপলের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে ইসলামবিদ্বেষ প্রবল।
তাহলে নাইপলকে আমরা কিভাবে নেব? একজন বদমেজাজী, দুর্মুখ লেখক, যে পলিটিক্যাল কোনও কারেক্টনেসের ধার ধারে না, ভারত নিয়ে যার মত ‘অ্যান এরিয়া অব ডার্কনেস,যেখানে লোকে সর্বত্র মলত্যাগ করে। রেললাইনের ধারে, মাঠের ধারে, রাস্তার ধারে, নদীর ধারে, সমুদ্রতীরে কোত্থাও হাগতে বাকি রাখে না’। মেয়েরা কপালে টিপ পড়ে মাথায় কিচ্ছু নেই বলে… আফ্রিকা থেকে ইসলাম যা মনে এসেছে তাই বলেছেন। আবার ইরাক,ইরান,মালেশিয়া, ইন্দোনেশিয়া,পাকিস্তান ঘুরে বেড়িয়ে মুসলমান জনজীবন নিয়ে দু’পর্বের বই লিখেছেন। ঢাকা লিটারেচার সামিটে তাঁকে ঘিরে উৎসাহের অন্ত ছিলনা বাঙালি মুসলমান বুদ্ধিজীবীদের, জয়পুর লিটারেচার মিটে তাঁর জন্য হাজির ছিল ছ’হাজার ভক্ত। কারণ নাইপল মানে কতগুলি বিতর্কিত মন্তব্যের সম্ভার নয়, অন্যকে আক্রমন নয়, নাইপল একালের ইংরেজি সাহিত্যের অন্যতম প্রাণপুরুষ, তাঁর কলমেই উত্তর-ঔপনিবেশিক সাহিত্যভাষা নতুন মাত্রা পেয়েছে।
Be the first to comment