রাজ কাপুর ৫০০ টাকা ধার দেন তাঁর ছবির জন্য দুটি গান লিখে দেওয়ার শর্তে

Spread the love

তপন মল্লিক চৌধুরী,

দেশ স্বাধীন হওয়ার কয়েক বছর পরের ঘটনা। মুম্বাইতে ভারতীয় গণনাট্য সংঘের অনুষ্ঠানে তরুন কবি শঙ্করদাস কেসরীলাল তাঁর স্বরচিত কবিতা ‘জ্বলতা হ্যায় পঞ্জাব’ পাঠ করছিলেন । মন দিয়ে কবিতাটি শুনছিলেন তাঁরই বয়সী আরেক তরুন। কবিতা পড়া শেষ হতেই কবির সঙ্গে এসে আলাপ করলেন সেই তরুণ। নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, আমি রাজ কাপুর;  পৃথ্বীরাজ কাপুরের ছেলে। তখনও সেটাই তার পরিচয়। রাজ জানালেন যে তিনি একটি ছবি বানাচ্ছেন; নাম ‘আগ’। এরপর রাজ সরাসরি শঙ্করদাসকে তাঁর ছবিতে গান লেখার প্রস্তাব দিলেন। এবং এর জন্য রাজ তাঁকে ৫০০ টাকা পারিশ্রমিক দেওয়ার কথাও জানান। কিন্তু তরুণ কবি শঙ্করদাস রাজের সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে বললেন, তিনি এ কাজ করতে পারবেন না। কারণ, তিনি বামপন্থী রাজনৈতিক ভাবাদর্শে বিশ্বাসী, টাকার বিনিময়ে তিনি হিন্দি বানিজ্যিক ছবির জন্য গান লিখে নিজের আদর্শকে বিসর্জন দিতে পারবেন না।

কিন্তু চূড়ান্ত অর্থনৈতিক দূরাবস্থায় পড়ে কিছুদিনের মধ্যেই তরুন কবি শঙ্করদাস কেসরীলালকে রাজ কাপুরের কাছে ফিরে আসতে হয়। ঘরে সন্তান্সম্ভবা স্ত্রী, এই মুহূর্তেই তাঁর বেশ কিছু টাকার দরকার। রাজকাপুর তাঁকে টাকা দিলেন এবং তাঁর পরের ছবি ‘বরসাত’-র জন্য দুটি গান লিখে দেওয়ার কথা বললেন। বাস্তবের কঠিন পরিস্থিতিতে কবি রাজের সেই প্রস্তাব মেনে নিতে বাধ্য হলেন। ৫০০ টাকার বিনিময়ে তিনি রাজ কাপুরের ছবি ‘বরসাত’-এর জন্য তরুন কবি শঙ্করদাস কেসরীলাল লিখেছিলেন-‘বরসাত মে হামসে মিলে তুম’।  বলা যেতে পারে এটি ভারতীয় সিনেমার প্রথম টাইটেল মিউজিক। আরেকটি গান চিল ‘পতলি কমর হ্যায়’। তবে কবির অনুরোধ অনুযায়ী গীতিকার হিসাবে শঙ্করদাস কেসরীলাল নামের পরিবর্তে ব্যবহার করা হয় শৈলেন্দ্র। এই নামেই তিনি ১৯৪৯ থেকে ১৯৬৬ পর্যন্ত প্রায় ১৭০ টি হিন্দি ছবিতে হাজারের ওপর গান লিখেছেন।

‘বরসাত’ ছবির জন্য দুটি গান লেখার পর শঙ্করদাস কেসরীলাল শৈলেন্দ্র নামেই হিন্দি ছবির গীতিকার হিসাবে পরিচিত হয়ে যান। তারপরও বহুদিন তিনি মনে প্রাণে বাম রাজনীতির ভাবাদর্শে আস্থা রেখেছিলেন। আইপিটিএ-এর সঙ্গেও সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। বম্বে ইয়ুথ কয়্যারের সঙ্গেও তাঁর যথেষ্ট যোগাযোগ ছিল।  আইপিটিএ-তেই সলিল চৌধুরীর সঙ্গে পরিচয় এবং পরবর্তীতে বিমল রায়ের সঙ্গে আলাপ, শচীন দেব বর্মনের সঙ্গে আলাপও বিমল রায় মারফত। সেই সূত্র ধরেই সলিল চৌধুরীর জন্য ‘মধুমতী’, ‘পরখ’ ছবির জন্য গান লেখেন, শচীন দেব বর্মনের জন্য লেখেন ‘বন্দিনী’ ছবির গান, রাহুল দেব বর্মনের প্রথম ছবি ‘ছোটে নবাব’-এর গান লিখেছিলেন শৈলেন্দ্র। কেবলমাত্র তাই নয়, ছবিতে সুর রচনার জন্য পন্ডিত রবিশঙ্করও আস্থা রেখেছিলেন শৈলেন্দ্র-র মতো গীতিকারের ওপর।

রাজ কাপুরের ছবি ‘আওয়ারা’ তে শংকর-জয়কিষাণের সুরে শৈলেন্দ্র-র লেখা ‘আওয়ারা হুঁ’ এবং ‘মেরা জুতা হ্যায় জাপানি’ তো একসময় প্রায় জাতিয় সংগীতের পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল। ছবিটি যেমন উপমহাদেশের সীমানা পেরিয়ে রাশিয়া, চীনসহ কয়েকটি দেশে ‘আওয়ারা’ ছবিটি যেমন জনপ্রিয় হয়েছিল একই সঙ্গে ওই গান দুটিও। এছাড়া উল্লেখ করার মতো শৈলেন্দ্র-রঅসংখ্য গান রয়েছে। ‘ও সজনা বরখা বহার আয়ি’- ‘পরখ’, ‘অবকে বরষ ভেজ ভইয়াকো বাবুল’- ‘বন্দিনী’, ‘অ্যায় মেরে দিল অউর চল’- ‘দাগ’, ‘ধরতি কহে পুকার কে’- ‘দো বিঘা জমিন’, ‘জাগো মোহন প্যারে’- ‘জাগতে রহো’, ‘আজিব দস্তা হ্যায় ইয়ে’- ‘দিল অপনা প্রীত পরায়া’, ‘পুছো না ক্যায়সে ম্যায়নে রৈনে বিতায়ি’- ‘মেরি সুরত তেরি আঁখে’, ‘সজনওয়া বৈরি হো গয়ি হমার’- ‘তিসরি কসম’ এমন অসংখ্য হিন্দি ছবির গানের জন্যই অমর হয়ে আছেন শঙ্করদাস কেসরীলাল ওরফে শৈলেন্দ্র।

খেয়াল করার মতো বিষয় হল শৈলেন্দ্র যেসব ছবির জন্য যেকটি গান লিখেছেন

তার ভাষা, ছন্দ- অলংকার এমনকি গানের চলন গড়নও একটির থেকে আরেকটি পুরোপুরি আলাদা। গান লেখার সময়ে তিনি বার বার নিজেকে যেমন ভেঙেছেন একই সঙ্গে ভেঙেছেন তাঁর সমাজ-শ্রেণি এবং স্বকীয়তাকে। যে কারণে তাঁর গানের ভাবনা এবং ভাষার পরিবর্তন গটেছে বার বার। ছবির জন্য গান রচনার ক্ষেত্রে তিনি সব সময়েই লক্ষ্য রাখতেন ছবির আখ্যান, প্রেক্ষাপট এবং চরিত্র বিশেষ করে ছবির যে মানুষটি ওই গানে লিপ দিচ্ছে তার ওপর। ছবির মধ্যবিত্ত চরিত্র যখন গান গাইছে তখন তিনি যে ভাষা ব্যবহার করছেন তার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ভাষায় লিখছেন কৃষক বা ভিক্ষুকের লিপের গানে। এমনকি ছবির চরিত্র যখন বিহারের মানুষ তখন তিনি হিন্দি ভাষায় মিশিয়েছেন ভোজপুরি, আবার শিক্ষিত এবং উপরতলার মানুষের জন্য ব্যবহার করেছেন উর্দু।  

রাজ কাপুরের ‘মেরা নাম জোকার’ ছবির জন্য শৈলেন্দ্র জীবনের শেষ যে গানটি লেখেন-‘জিনা য়ঁহা মরনা য়ঁহা ইসকে সিবা জানা কঁহা’ সেটিও তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনার একটি। সারা জীবন বানিজ্যিক হিন্দি ছবির জন্য গান লিখলেও অন্য ছবির কথা ভাবতেন। তাই সারা জীবনের সর্বস্ব সঞ্চয় দিয়ে ‘তিসতি কসম’-এর মতো একটি ছবি প্রযোজনা করেছিলেন। ভাল গান, ভাল কথা এমনকি অন্য ছবির তকমা জুটলেও ছবি তৈরির দীর্ঘ সময় ধরে তিক্ততা এবং হতাশা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন  মদ্যপানের পরিমান। নিজের ছবির প্রিমিয়ারেও যান নি, ছবি বানিজ্যিকভাবে অসফল হওয়ায় তার দায়ও একার ঘাড়ে নিয়ে প্রায় আত্মহননের পথেই পা বাড়ান। 

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*