তপন মল্লিক চৌধুরী,
সদ্য সুর করা গান নিজেই গাইছেন এক নবীন সঙ্গীতশল্পী এবং সঙ্গীতপরিচালক। গানে প্রাণ মন ঢেলে দিয়েছেন। একাগ্র চিত্তে সেই গান তিনি একসময় শেষ করলেন, তাকালেন আসরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শ্রোতা, ফিল্মিস্তানের কর্ণধার এস. মুখার্জীর দিকে। এস. মুখার্জী শুধু শ্রোতা নন, বিচারকও। কারন তাঁর রায়ের ওপর নর্ভর করছে কলকাতা থেকে আসা ওই তরুণ সঙ্গীত শিল্পী ও সঙ্গীত পরিচালকের ভবিষ্যত। তাঁর বিচারের রায় পেলেই মুম্বাই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে একটা হিল্লে হয়ে যেতে পারে ওই তরুণের । কিন্তু এস মুখার্জী গান শুনলে তো! তিনি তো নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছেন!
পরের দিন আবার হারমোনিয়াম নিয়ে বসলেন সেই তরুণ। গান গাইতে শুরু করলেন। একসময় শেষও হল তাঁর গান। যথারীতি তাকালেন শ্রোতাদের দিকে বলা ভাল এস. মুখার্জীর দিকে। কিন্তু তিনি তো তার নিজের অভ্যাসমতো হুইসেল বাজিয়ে ঘুমাচ্ছেন। এভাবে মাঝে মধ্যে কলকাতা থেকে আসা তরুণটি গান শোনান আর যার জন্য গান গাওয়া তিনি নাক ডেকে ঘুমান- কেটে গেল পাক্কা দু’মাস। প্রযোজকের যেমন গান শোনা হয়না, তেমনি মুম্বাইতে (তখনকার বোম্বে) কাজও শুরু করা হয় না তরুণ সঙ্গীত পরিচালকের। কিন্তু চেষ্টার ক্লান্তি নেই। একদিন রুটিনমাফিক গান শেষ করে হতাশ তরুণ শিল্পী ভাবছেন, ‘এখানে আর নয়। ফিরে যেতে হবে কলকাতায়। যা হওয়ার হবে…’। কিন্তু যেই না অমন ভাবনা হতাশ তরুণ শিল্পীর মাথায় খেলেছে তক্ষুনি তাতে ছেদ টেনে দিলেন ফিল্মিস্তানের কর্ণধার এস মুখার্জী। অনেকটা আকাশবাণীর মতো বলে উঠলেন, ‘গানটা রেকর্ড করিয়ে ফেলুন না’। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে না পেরে তরুণ শিল্পী জানতে চাইলেন, ‘আমাকে কিছু বললেন?’ জবাব এলো, ‘হ্যাঁ, আপনার এ গান আমার খুব পছন্দ হয়েছে। রেকর্ড করিয়ে ফেলুন’। তাঁর কথামতো রেকর্ড করানো হলো। মুম্বাই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে পায়ের নিচে মাটি পেয়ে গেলেন সেদিনের তরুন সঙ্গীত পরিচালক। উপমহাদেশের সঙ্গীতভুবন যাকে শচীন কত্তা নামে চেনে।
সে যুগে রীতি ছিল গীতিকার আগে গান লিখবেন, তারপর সুরকার তাতে সুর দেবেন। কিন্তু শচীন দেব বর্মন রীতিটা উল্টে দিলেন। সেই থেকে শতকরা কমপক্ষে আশি ভাগ গানের সুর হতে থাকল আগে, তারপর লেখা হল গানের কথা। উপমহাদেশের সঙ্গীতে এসডি মুম্বাই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে শচীন দেব বর্মন এই নামেই সমধিক পরিচিত যিনি এ ধরণের যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছিলেন।
তখন মুম্বাইতে আরও একটি রীতি চালু ছিল যে, ছবিতে নায়কের সব গান গাওয়ানো হত একজন শিল্পীকে দিয়ে। যেমন মুকেশ গাইবেন রাজ কাপুরের জন্য, কিশোর কুমার দেবানন্দের জন্য আর মোহাম্মদ রফি গাইবেন শাম্মি কাপুর আর দিলীপ কুমারের গান, এটা একেবারে অবধারিত ছিল। এসডি এই নিয়মও মানলেন না। সেকারণে আমরা লক্ষ্য করলাম হৃষীকেশ মুখার্জির ছবি ‘অভিমান’ (১৯৭৩)-এ অমিতাভ বচ্চনকে ঠোঁট মেলাতে দেখা গেল কিশোর কুমার, মোহাম্মদ রফি আর মুকেশের গাওয়া গানে। আবার ‘মঞ্জিল’ ছবিতে (১৯৬০) রফি, কিশোর আর মান্না দে গাইলেন দেবানন্দের জন্য। এমন কি ততদিনে নায়ক -গায়ক গিসেবে সুখ্যাতি পেয়ে যাওয়া কিশোর কুমারকেও ‘নটি বয়’ ছবিতে (১৯৬২) ঠোঁট মেলাতে হল মান্না দে’র গাওয়া গানে। প্রযোজক, পরিচালক, দর্শক কিন্তু এস ডি-র এই সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা ভীষণভাবেই মেনে নিল।
কিন্তু এ ধরণের সাফল্য যে তাঁর মাথা ঘুরিয়ে দেয়নি সেটাও স্পষ্ট বোঝা যায়। তিনি বুঝেছিলেন, তাঁর নিজের কণ্ঠের গান নায়কের ঠোঁটে মানাবে না। তাই কোনোদিন কোনো ছবিতে নায়ককে সরাসরি শচীন দেব বর্মনের গান গাইতে দেখা যায়নি। এমনকি নিজের যেসব জনপ্রিয় বাংলা গানের সুর হিন্দি ছবিতে ব্যবহার করেছিলেন সেগুলোও গাইয়েছেন অন্য শিল্পীদের দিয়ে। আবার ১৯৬৩ সালে যখন তিনি ‘মেরি সুরত তেরি আঁখে’ ছবির জন্য ‘পুছো না ক্যায়সে ম্যায়নে র্যায়েন বিতায়ি’ গানটির সুর করছেন তখন তিনি জেনে বুঝেই সেই গানের সুরের মধ্যে নজরুল ইসলামের ‘অরুণ কান্তি কে গো যোগী ভিখারি’ গানটির সরাসরি প্রভাব রেখে দিলেন। অথচ মুম্বাই ফিল্ম ইতিহাসের সেরা গানগুলোর মাঝেই সেই গান জায়গা করে নিয়েছে।
কেবলমাত্র এই গানটিই নয় ১৯৪৯ সালে ‘দো ভাই’ ছবির জন্য সুর করা গীতা দত্ত-এর কন্ঠে ‘মেরা সুন্দার স্বপ্না বিত গায়া’ গানটি মনে করলে রবীন্দ্রনাথের ‘রোদন ভরা এ বসন্তে গানটির স্পষ্ট অনুকরণ বলেই মনে হবে। কিন্তু সেটা জেনে বুঝেও শচীন দেববর্মন নতুন কথা নিয়ে গানটি তৈরি করেছিলেন। ঠিক পরের বছর ১৯৫০ সালে ‘আফসার’ ছবিতে শচীন দেব আবারও আশ্রয় নিলেন রবীন্দ্রনাথের। ওই ছবিতে সুরাইয়ার কন্ঠে ‘নায়েন দিভানি এক নাহি মানে’ গানটির সুর পুরোপুরি ‘সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে’ গানটির অনুকরণেই করেছিলেন। ১৯৫৪ সালের ছবি ‘ট্যাক্সি ড্রাইভার’-এ তালাত মাহমুদের কণ্ঠে দেব আনন্দের ঠোঁটে ‘যায়ে তো যায়ে কাহা’ গানটি শোনা মাত্রই বুঝতে অসুবিধা হয় না গানটি রবীন্দ্রনাথের ‘হে ক্ষণিকের অতিথি’ গানটির অনুকরণ। অমিতাভ-জয়া জুটির ‘অভিমান’ ছবিটি দেখেননি বা ‘তেরে মেরে মিলন কি ইয়ে র্যায়না’ গানটি শোনেননি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। এই ছবির সব কটি গানই জনপ্রিয় হয়েছিল। তবে ‘তেরে মেরে মিলন কি ইয়ে র্যায়না’ গানটি শোনামাত্র রবীন্দ্রনাথের ‘যদি তারে নাই চিনি গো’ গানটির অনুকরণ মনে হবে। গানটির সুর নতুন কথায় বেঁধেছিলেন শচীন দেববর্মন। কণ্ঠ দিয়েছিলেন কিশোর কুমার ও লতা। ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৭৩ সালে।
Be the first to comment