তপন মল্লিক চৌধুরী,
স্বাধীনতা উত্তর কালের বাঙালি যতটা নেতাজির অন্তর্ধানে পীড়িত তার একভাগ চিন্তিত নয় সুভাষচন্দ্র বসুর স্বাধীন দেশ ভাবনায়। ফলে নেতাজি কেন্দ্রিক যে কোনও কিছুর সর্বাগ্রে এসে পড়ে নেতাজির অন্তর্ধান রহস্য। দুই নেতাজী গবেষক অনুজ ধর এবং চন্দ্রচূড় ঘোষের দাবি ১৫ বছরের গবেষণালব্ধ ফসল দিয়েই তাঁরা ‘Conundrum: Subhas Bose’s Life after Death’ বইটি লিখেছেন। এবং ওই বইয়ের অনুপ্রেরনাতেই তৈরি হয়েছে ‘গুমনামি’ ছবিটি। বলাই বাহুল্য ‘গুমনামি’ ছবিটিও যে নেতাজির অন্তর্ধান রহস্য থেকে লক্ষ্যভ্রষ্ট হবে সে কথা ভাবার অবকাশ নেই। তদুপরি বাংলা ছবি তো এখন রহস্য জ্বরেই প্রবলভাবে আক্রান্ত। নয় মিশর রহস্যে, তা নাহলে ভাওয়াল সন্নাসী এছাড়া ব্যোমকেশ তো আছেনই। তাই ছবি মুক্তির আগে তর্ক-বিতর্ক যাই ঘটে থাকুক না কেন তা আসলে ছবিটিকে দিয়েছে বহুল পরিমানে প্রচার। লেখকদ্বয় তাঁদের বইতে আগাগোড়াই নেতাজীর বিমান দুর্ঘটনায় রহস্যাবৃত মৃত্যুর বিপক্ষেই যুক্তি খাড়া করার চেষ্টা করেছেন। তারা বলেছেন, ১৯৪৫ সালের ১৮ অগাস্ট তাইহোকু বিমানবন্দরের কাছে বিমান দুর্ঘটনায় সুভাষচন্দ্র বোস মারা যান নি। কেবলমাত্র তাই নয়, সেদিন আদৌ কোনও বিমান ওড়েই নি, এবং নেতাজীরই নির্দেশে অতি সযত্নে বিমান দুর্ঘটনার কাহিনী সাজিয়েছিলেন জাপানি সেনাবাহিনীর শীর্ষ আধিকারিকরা। বাস্তবে নেতাজী মাঞ্চুরিয়া হয়ে প্রবেশ করেছিলেন রাশিয়ায়, সেখান থেকে শেষমেশ নেপাল হয়ে ফিরে এসেছিলেন স্বদেশের মাটিতে।
ছবিটি আমরা দেখি মূলত চন্দ্রচূড় ধরের চোখ দিয়ে। চরিত্রটিকে ছবির পরিচালক দুই লেখকের নাম মিশিয়ে গড়েছেন কিনা জানা নেই। তাহলে ঘটনা দাঁড়ায় তেল আর জলের মিশেল। তবে ছবিতে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নেতাজীর মৃত্যু রহস্য সংক্রান্ত তাঁর যুক্তি প্রাধান্য পেয়েছে, যদিও ছবির আগাগোড়া নেতাজির মৃত্যু রহস্যের তিনটি সম্ভাব্য সমাধান রয়েছে যা কিনা স্বাধীনতার পরবর্তী নেতাজীর তথাকথিত অন্তর্ধানের বিষয়টি নিয়ে ভারত সরকার গঠিত তিনটি কমিশন এবং তাদের রিপোর্ট। সরকারিভাবে এখনও বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যুর তত্ত্বই প্রতিষ্ঠিত। তবে সে তত্ত্বের উলটোদিকে হাঁটে অনুজ এবং চন্দ্রচূড়ের বই এবং অন্যভাবে হলেও ‘গুমনামি’ ছবিটিও। শতাধিক বর্ষ পেরিয়েও যেখানে বাংলা সিনেমা গুছিয়ে গল্প বলতে চায়, কাহিনি নির্মান করতে চায় সেই ছবিতে আমরা দেখি, একটি অ্যাসাইনমেন্টের দৌলতে নেতাজীর অন্তর্ধান রহস্যে কীভাবে আগাগোড়া ওলটপালট হচ্ছে সাংবাদিক চন্দ্রচূড়।
সুভাষ দেখা করতে এসেছেন গান্ধির সঙ্গে, সেখানে নেহরু আছেন। দেশের স্বাধীনতা ঘরের দরজায়। তখনও গান্ধি অহিংসার পথেই থাকতে চান। সুভাষ মনে করেন সশস্ত্র সংগ্রাম ছাড়া স্বাধীনতা সম্ভব নয়। তাই তিনি বিদায় নিতে চান। চন্দ্রচূড়কে নেতাজির রহস্যজনক মৃত্যু নিয়ে অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া হয়। চ্যালেঞ্জ নিয়ে সে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এক গভীর রহস্যময় ছায়াপথ ধরে এগিয়ে চলে সূত্রধর চন্দ্রচূড়। যেন যাবতীয় অসম্ভবকে নস্যাৎ করে এগিয়ে চলেছে স্বাধীনতা অর্জনের দিকে। কখনও মিত্র শক্তির সঙ্গে বৈঠক, কখনও আজাদ হিন্দ ফৌজ। এরপরই তাইহোকু বিমান দুর্ঘটনায় আগুনে ঝলসে মৃত্যু অথবা ফৈজাবাদের ভগবানজি, নেতাজির রাশিয়ায় পালিয়ে যাওয়া… ইতিহাসের ছায়া ধরে ঘটে চলে। সেই পথেই এগিয়ে চলে সাংবাদিক চন্দ্রচূড়; করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে। উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন জায়গায় দেখা সেই সন্ন্যাসী,তাঁর গলার স্বর নেতাজির মতো। পর্দার আড়াল থেকে তিনি কথা বলেন সুভাষচন্দ্রের কাছের মানুষজনদের সঙ্গে। নেতাজির সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা উঠে আসে সেই আলাপচারিতায়। তাহলে ইনিই সুভাষ? চন্দ্রচূড়ের চোখে নেতাজির মতো চশমা, সমস্ত ধ্যানজ্ঞান নেতাজির অন্তর্ধান। কখনো সাদা-কালো, কখনো রঙিন। সময় কখনো ১৯৪৫, একটু অন্যরকম প্রকৃতি, নেতাজির চলার পথ, মহাত্মা গাঁধী, পণ্ডিত নেহরু, কখনো ১৯৮৫, সাধুবাবা, নিভৃত আস্তানা। এরপর ১৯৯৯, মিশন নেতাজি গ্রুপ, চন্দ্রচূড়ের যুক্তি, তর্কবিতর্ক। কলাকৈবল্যের মোড়কটা আসলে রহস্য। বাংলা ছবি তো এখন রহস্যের গোলকধাঁধাতেই ঘুরপাক খাচ্ছে- কখনো মিশর, কখনো ভাওয়াল সন্ন্যাসী, ব্যোমকেশ অনিবার্য, এসেছেন মিতিন মাসি। আর নেতাজি তো বিগত সাত দশক ধরেই রহস্য। প্রসঙ্গত, এ ছবির অভিনয়ের মান বা শিল্পভাবনা কিংবা ডিটেলিং নিয়ে অবশ্যই কিছু বলার থাকে, বিশেষ করে চিত্রগ্রহণ এবং অবশ্যই নেতাজী কিংবা গুমনামি বাবার ভূমিকায় প্রসেনজিতের লুক- সবগুলি খুবই উন্নত মানের।
তবে সাংবাদিক চন্দ্রচূড়; যিনি এই ছবির সিংহভাগ জুড়ে রয়েছেন তিনি বহু জায়গাতেই চূড়ান্ত নাটুকে। পাল্লা দিয়ে তদন্ত দৃশ্যগুলি মাঝেমধ্যেই যাত্রাকেও হার মানিয়েছে। কি দৃশ্য রচনায় কি সংলাপে এমনকি অভিনয় ক্ষেত্রেও। দর্শককে কমিক রিলিফ নাকি কমিশনের প্রতি কটাক্ষ? ছবির নির্মাতা নিজেকেই যে তাদের চেয়ে বেশি খেলো করে ফেলবেন সেটা বুঝতে পারেন নি। আসলে গুমনামি ছবির আপাত লক্ষ্য ছিল নিরপেক্ষভাবে মুখোপাধ্যায় কমিশনের তদন্ত প্রক্রিয়া অনুসরণ কিন্তু কার্যত হয়ে দাঁড়িয়েছে চন্দ্রচূড়ের গবেষণা তথা সংগ্রামের কাহিনী। নেতাজি সুভাষ কি সত্যিই ১৯৪৫-এর ১৮ অগস্ট প্লেন দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিলেন? যুগ যুগান্ত ধরে বিতর্ক আর তীব্র আবেগে তোলপাড় হয়েছে যে মন; ‘গুমনামী’ জমাট বেঁধে থাকা সেই আবেগে ধাক্কা দিয়েছে ঠিকই কিন্তু সেই প্রচলিত গল্প, নাট্য নির্মান। সাধারণ দর্শক হিসেবে যতবারই কমিশনের তদন্ত প্রক্রিয়া নিয়ে আরও একটু গভীর রেখাপাতের জন্য মনযোগী হয়েছি ততবারই আশাহত হয়েছি।
গভীরতার অভাবটা প্রকট হয়ে ওঠে ছবি নির্মাতার ইতিহাস বোধের অভাবে, সিনেমা ভাষার বদলে আখ্যান নির্মানের ভয়ংকর চেষ্টায়। ক্যানভাসটা বড় করলেই তো হয় না, তাকে গোটাতে হয় অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে। সেই ক্ষেত্রে তিনি এতটাই দুর্বল যে তদন্ত প্রক্রিয়ার গভীরে যাওয়ার সুযোগ ঘটে নি। যা কিছু শুনতে পাই, সে তো মোটের ওপর চন্দ্রচূড়ের মুখের কথা, কিন্তু তাঁর বা কমিশনের কার্যকলাপের বিবরণ সেগুলি তো দেখতে পেলাম না। তবে সাদা-কালো এবং রঙিন ফ্ল্যাশব্যাকে নেতাজী এবং গুমনামি বাবার প্রায় ‘থ্রিলার’ আঙ্গিকে উপস্থাপিত জীবনচরিতকে কিন্তু উপভোগ্য বলতেই হবে। মনোগ্রাহী কিছু পরিচিত গান, আগাগোড়া ঝকঝকে উপস্থাপনা। কিছু দৃশ্যের পরিকল্পনা অবশ্যই ব্যতিক্রমী, বিশেষ করে চন্দ্রচূড়ের সঙ্গে গুমনামি বাবার নৈশ কথোপকথন। পুজোতেই দেখে ফেলুন ‘গুমনামি’।
Be the first to comment